‘বাংলা বানানকে নতুন যুগের উপযোগী করে সংস্কার করার সময় এসেছে’
একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা ভাষা নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। অথচ বছরজুড়ে এ নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য নেই। ফলে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন কতটা হয়েছে? বিকৃত বা ভুল বাংলা শব্দ ব্যবহার করা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করতে কী করছে বাংলা একাডেমি? অনলাইনে কেন পুরো বাংলা অভিধান এখনও দেওয়া যায়নি? এসব বিষয় নিয়ে জার্মানির সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহাম্মদ নূরুল হুদা।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন কতটা হয়েছে?
মুহাম্মদ নূরুল হুদা: কতটা হয়েছে তার কোন সমীক্ষা বাংলাদেশে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে, আমাদের সরকারি অফিস আদালতের নথিতে শতভাগ হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে, যেখানে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ হয় সেখানে বাংলার বাইরে সম্পূরক একটা ভাষা আছে, যেটাকে আমরা বলি কর্মের ভাষা ইংরেজি সেটাও ব্যবহার হচ্ছে এটাও ঠিক। আবার বিভিন্ন সাইবোর্ডে দেখা যাবে বাংলা আছে, কোথাও কোথাও ইংরেজি আছে। কিন্তু এটা খুব বেশি নয়। গত ৫০ বছরে ইংরেজি ব্যবহারের বিষয়টি খুবই কমে এসেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটা এই-পরিভাষার জন্য অপেক্ষা করা যাবে না, বাংলা চালু করতে হবে৷ আমরা কিছু বানানে ভুল করব, লেখায় ভুল করব, এই ভুল করতে করতে আমাদের প্রমিত বাংলায় আসতে হবে। এই যাত্রায় আমরা বহুদুর এগিয়েছি।
একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই নানা ধরনের তৎপরতা দেখা যায়৷ এটা বছরব্যাপী করা যায় না?
মুহাম্মদ নূরুল হুদা: এখন তো বছরব্যাপী হচ্ছে বলা যায়। আগে বরং শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক ছিল। এখন সারা বছরে হচ্ছে, তারপরও একুশে ফেব্রুয়ারি আসলে যে আলোচনাটা হয়, তার রেশ সারা বছরই থাকে। মঙ্গলবার মেলার উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যদি সম্ভব হয় সবগুলো জেলাতেই সহিত্য সম্মেলন করতে হবে। এর সঙ্গে আমরা বইমেলা জুড়ে দেব। এতে সৃষ্টিশীলতার বিষয়টা সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়বে৷ শুষ্ক মৌসুমের ছয় মাস যদি জেলাগুলোতে এটা করা যায় তাহলে মানুষের মনে বাংলা প্রচলনের বিষয়টি স্থায়ী রূপ পাবে।
বাংলা বিকৃত করা দুই ধরনের। একটি জেনে বিকৃত করা, আরেকটি না জেনে বিকৃত করা। আপনি তো শুধু নাটক-সিনেমার কথা বলছেন, কিন্তু রেডিওর যে জকি আছে তারা দ্রুততার সঙ্গে যে বাংলা বলে তাতে বিকৃত হচ্ছে। এটা বন্ধে অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। সব মানুষের মনোযোগ যদি শুদ্ধ বাংলার দিকে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
বাংলা একাডেমি যে বইগুলো প্রকাশ করে, সেখানে কি অভিধান অনুযায়ী সব শব্দ ব্যবহার হয়?
মুহাম্মদ নূরুল হুদা: অবশ্যই অভিধান অনুযায়ী সব শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে৷ তবে ডিকশনারির বাইরে কখনও কখনও নতুন শব্দ তৈরি হয়। এই শব্দ তৈরি করে কবি, ভাষাবিদ এবং পণ্ডিতেরা। তাদের কাছ থেকে কোন শব্দ পাওয়া গেলে সেগুলো ডিকশনারিতে আনা হয়। যেমন ধরা যাক, ঘেরাও। এই শব্দটি আগে বাংলাতে খুব একটা প্রচলিত ছিল না। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ঘেরাও যখন শুরু হল, মাওলানা ভাসানীর মুখ থেকে আমরা অনেকবার এই শব্দটি শুনেছি। পরে এটা ডিকশনারিতে চলে এসেছে। ফলে অভিধানের বাইরের কোন শব্দ সাধারণত মানুষ ব্যবহার করে না।
অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ডিকশনারির অনলাইন সংস্করণ আছে। বাংলা একাডেমির নেই কেন?
মুহাম্মদ নূরুল হুদা: আমার মনে হয়, বাংলা অভিধানের সব শব্দ নিয়ে অনলাইনে ডিকশনারি করার মতো কোন সফটওয়্যার এখনও দেশে নেই। এর মূল কারণ হল, বাংলায় যে ৪৯টি অক্ষর আছে, এর সঙ্গে আকার-একার সব মিলিয়ে বিষয়টা একটু জটিল। তবে প্রচেষ্টা চলছে৷ আমাদের ডিকশনারিটা অনলাইনে আছে, তবে মুদ্রিত ডিকশনারির মত ততটা বিস্তৃত নয়। শব্দার্থ হিসেবে আছে। ফলে জটিলতাটা কাটেনি। আমার মনে হয়, দু'এক বছরের মধ্যে এই জটিলতাও কেটে যাবে।
বাংলা একাডেমির বিক্রয়, বিপণন ও পুনর্মুদ্রন বিভাগের পরিচালক ড. জালাল আহমেদ জানান, অমর একুশে বইমেলার স্টল বন্টনের ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইনে লটারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে অনিয়মের যে অভিযোগ ছিল, সেটি সম্পূর্ণ দূর হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি। সেখানে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় কেন ডিজিটাইজেশনের বাইরে থেকে গেল?
মুহাম্মদ নূরুল হুদা: এর অনেকগুলো কারণ আছে। ডিজিটাইজেশন বলতে আমরা বুঝি টেলিফোনে কথা বলা, বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ করা, ফেসবুকে লেখা এসব। পৃথিবীর বাইরের সঙ্গে যে যোগাযোগ সেটা তো ইংরেজিতে করলেই হয়। বাংলাদেশে এটা করতে হলে যে মনোযোগটা দরকার সেটা আমাদের সব মহলেই একটু কম আছে বলে আমার মনে হয়। এটা বাড়াতে হবে৷ পাশাপাশি অনুশীলনটাও বাড়াতে হবে। তার সঙ্গে বাংলা বানানকে নতুন যুগের উপযোগী করে আবার সংস্কার করার দিন আসছে। এর আগেও বারবার সংস্কার হয়েছে। এখন ডিজিটাল যুগে সহজে যাতে এটাকে ধারণ করা যায় সেই কাজটি করার সময় এসেছে।
মাঝে মধ্যেই ডিকশনারিতে পরিবর্তন আসে, কিন্তু দেশের বাইরে থাকা বিপুল সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এটা জানতে পারেন না। তাদের পক্ষে সব সময় এটা কেনাও সম্ভব হয় না। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিকৃত শব্দ চলে যাচ্ছে না?
আমি মনে করি, শব্দ কখনই বিকৃত হয় না, ভুল শব্দ হয়। বিকৃত হলেই এটা ভুল হয়ে যাবে? শব্দ বানান যদি আমি ‘স’ দিয়ে লিখি এটা ভুল হবে। এই ভুলটা ব্যক্তি চেতনার উপর নির্ভর করে। কে কতটা মনোযোগী সেটার উপর নির্ভর করে৷ আরেকটা বিষয় আমি দেখেছি, ফেসবুক যারা ব্যবহার করেন তারা মুখের ভাষা ব্যবহার করেন। অথবা ব্যকরণ অনুযায়ী একটা গ্রামার যেভাবে লিখতে হয়, তারা সেভাবে লেখেন না। তারা একটু মনোযোগী হলেই শুদ্ধ করে লিখতে পারেন। দেশের বাইরে যারা আছেন তারা কিন্তু অনলাইনে বাংলা একাডেমির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এখন অনলাইনে যে ডিকশনারিটা আছে সেটা ফলো করলেও ভুল হওয়ার কথা না। যেমন ধরেন এখন ‘বাড়ি’ বানান এটা, কিন্তু কেউ যদি ‘বাড়ী’ বানান এটা লেখে সেটাও ভুল না। এটা হল আগের প্রচলন, পরের প্রচলন। এটা বলা যেতে পারে প্রমিত বাংলা বানান না। ফলে শুদ্ধ একটা ব্যাপার, প্রমিত একটা ব্যাপার আর না জেনে লেখা আরেকটা ব্যাপার৷ আমি মনে করি, আমাদের যে বিশাল ডিকশনারি এটা অনলাইনে দিলে জটিলতা বাড়বে। বরং মুদ্রিত ডিকশনারি সঙ্গে রাখা দরকার। লন্ডন, জার্মানি, নিউইয়র্ক যেখানেই বলেন সেখানে বাংলা ডিকশনারি পাওয়া যায়৷ ফলে এটা সংগ্রহ করা খুব কঠিন কাজ না। হয়ত অনলাইনে আরো বিশুদ্ধভাবে করা যায়। সেটা এখন সময়ের ব্যাপার।
সবাইকে বাংলা একাডেমির অভিধান অনুযায়ী বাংলা শব্দ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে কি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে না?
মুহাম্মদ নূরুল হুদা: সেটা তো আমরা বলেছি, অভিধান অনুযায়ী ভাষা ব্যবহার করতে গেলে দু'টি কাজ করতে হবে, একটা অর্থ জানা এবং আরেকটা হল বানানটা ঠিক রাখা। বানান ঠিক রাখা আর বানান প্রমিত রাখা কিন্তু এক কথা নয়। প্রথম যে ডিকশনারিটা ছিল এখন কিন্তু সেটার বানান অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। সর্বশেষ যে অভিধানটা এসেছে এটা কিন্তু সব বানানই আগের বানান থেকে আলাদা। আমাদের উচিত হবে বাংলা একাডেমির অভিধান ফলো করা। কেউ যদি প্রমিত বানান না লিখে আগের কোন বানান লেখে এটাকে ভুল বলা যাবে না। এটা গ্রহণ করতেও কোন অসুবিধা নেই। সর্বশেষ বানান গ্রহণ করতে একটু সময়ের দরকার হয়।