দুর্নীতি-অপচয়ের দায় ভোক্তাদের ওপর চাপাতেই পানির মূল্য বৃদ্ধি: ক্যাব
নিজেদের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও অমিতব্যয়িতার দায় জনগণের ঘাড়ে চাপাতেই ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বাড়াতে চাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কী-নোটে এ দাবি করা হয়েছে।
গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার অনলাইনে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে ক্যাব।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাব বলছে, গ্যাস-বিদ্যুতের পর ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ালে ভোক্তাদের দুর্ভোগের মাত্রা আরও বাড়বে। সরকার দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রের বদলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে চালাতে চাচ্ছে।
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মানুষকে স্বস্তিতে থাকতে দেওয়া কল্যাণ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। অথচ সরকার দেশকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে চালাতে চাইছে। ঢাকা ওয়াসা ভোক্তাদের ওপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে নিজেদের লাভ দেখায়। পুরস্কার নয়, তারা তিরস্কার পাওয়ার যোগ্য। উন্নয়নের মহাসড়কে জনগণ নিষ্পেষিত হলে সব উন্নয়নই ম্লান হয়ে যাবে।
ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শামসুল আলম বলেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মতো অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য কত বাড়বে, সেটার কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। যে যেভাবে পারছে, দাম বাড়াচ্ছে। বর্তমানে সরকারি কোম্পানিগুলো যেভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়িয়ে জনগণকে লুণ্ঠন করছে, তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ে বেশি। মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভোক্তাদের দুর্ভোগ উপেক্ষা করলে পরিণতি ভয়াবহ হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মতো জীবনের মৌলিক তিনটি চাহিদাকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মধ্যবিত্তের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়ছে। করোনার এ দুঃসময়ে দ্রব্যমূল্যের দামও ক্রমাগত বাড়ছে।
সাজিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সভায় ক্যাবের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। সভার ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন ক্যাবের মুখপত্র ভোক্তাকণ্ঠের সম্পাদক কাজী আবদুল হান্নান।
এর আগে বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলন করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান।
ঢাকা ওয়াসার ১৩ সদস্যের বোর্ডে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুজন অতিরিক্ত সচিব, পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধি ছাড়াও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সদস্য হিসেবে থাকেন।
বর্তমানে প্রতি এক হাজার লিটার পানির জন্য আবাসিক গ্রাহকরা ঢাকা ওয়াসাকে দেন ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। বাণিজ্যিক সংযোগের জন্য এই দাম ৪২ টাকা।
ওইদিন তাকসিম এ খান আরও জানান, এখন থেকে প্রতি হাজার লিটার পানি কিনলে গুনতে হবে ১৫ টাকা থেকে ২১ টাকায়। ওয়াসা নিজস্ব ক্ষমতাবলে প্রতি বছর পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর ক্ষমতা রাখে। এর চেয়ে বেশি বাড়ানোর ক্ষমতা তাদের নেই। তাই সরকারকে ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। দাম বাড়ানোর পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি জানান, ভর্তুকি কমাতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভবিষ্যতে পানির দাম আরও কয়েকগুণ বাড়ানোর অশনিসংকেত দেন তাকসিম এ খান। বলছেন, সরকার ভবিষ্যতে ওয়াসাতে ভর্তুকি আরও কমাবে। ফলে পানির মান না বাড়িয়ে প্রতি বছর দাম বাড়ানোর দিকেই যাচ্ছে সংস্থাটি। আর পানির দাম রাজধানীর এলাকাভেদে বিভিন্ন রকম হওয়ার কথাও জানায় ওয়াসা।
কেন ঘাটতি
তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়ে ঢাকা ওয়াসা প্রতি হাজার লিটার পানির উপাদন খরচ ২৫ টাকা দেখিয়ে বলেছে, তারা ১০ টাকা কমে ১৫ টাকায় বিক্রি করছে। সরকার এ টাকা ভর্তুকি দেয়, যা আর দিতে চায় না। এ অবস্থায় এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান সংস্থাটির অমিতব্যয়িতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি-অপচয়ের সব দায়ভার ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে ভর্তুকি কমানোর পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে কোনো সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না।
কিন্তু ঢাকা ওয়াসা হচ্ছে একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান, লাভ বা বাণিজ্য এর উদ্দেশ্য নয়। অথচ সেবার চেয়ে বাণিজ্যের দিকেই এর নজর এখন বেশি। দেশে বিভাগীয় শহরগুলোতে আরও ৬টি ওয়াসা আছে। তাদের পানির দাম ঢাকা ওয়াসার চেয়ে প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগ। হাজার লিটারের ইউনিট প্রতি খরচ এত বেশি না বলেই তারা পারছে।
অন্যদিকে সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কোথাও পৌর কর্তৃপক্ষ, কোথাও পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং পানি সরবরাহ করে। সেগুলোর বেশির ভাগই প্রকল্প হিসেবেই সরকারি টাকায় পরিচালিত হয়। সেগুলোতে যে বিপূল ভর্তুকি দেওয়া হয় তাও কি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে? যদি তা না হয় তবে ঢাকায় ভর্তুকি বন্ধ করে সরকার কি এক দেশে পানি সরবরাহ বাবদে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে?
বিষয়টি তাহলে কি
বর্তমানে আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। ওয়াসার বোর্ড মিটিংয়ে প্রস্তাব ছিল আবাসিকে এ দর ২১ টাকা ২৫ পয়সা করা। আর বাণিজ্যিক সংয়োগের ক্ষেত্রে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম বর্তমানের ৪২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৮ দশমিক ৮ টাকা করা। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন দর কার্যকর করতে অনুমোদন চায় ওয়াসা। কিন্তু এই মূল্যবৃদ্ধির কথা প্রকাশ হলে চারদিকের সমালোচনার মুখে এমডি ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব কমিয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠাবেন বলে জানান।
সামগ্রিক বিষয়টি খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, পানির দাম ২০ শতাংশ বাড়লে ভোক্তাপর্যায়ে কার্যত বৃদ্ধি পাবে ৪৬ শতাংশ। প্রতিটি পানির বিলে সমপরিমাণ সুয়ারেজ বিল দিতে হয়। আর মোট বিলের ওপর ১৫ শতাংশ দিতে হয় ভ্যাট। ফলে ১০০ টাকার পানির বিলে বর্ধিত ২০ টাকা, সুয়ারেজ বিল বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ২৪০ টাকা। বর্ধিত ৪০ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাটে আরও ৬ টাকা মিলিয়ে মোট বিলে ২০ শতাংশ এর ভার দাঁড়াবে ৪৬ টাকা। যার অর্থ হচ্ছে পানির ১০০ টাকা বিলে ভোক্তাকে গুনতে হবে ২৪৬ টাকা।
আরএ/