গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের লাশ পড়ে আছে: মাহবুব তালুকদার
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে এমন নির্বাচনে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের লাশ পড়ে আছে বলে মন্তব্য করেছেন আলোচিত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। সোমবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন ভবনে প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
সংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ‘নির্বাচন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে আমার কথা–এটাই আমার সর্বশেষ প্রেস ব্রিফিং’ শিরোনামে লিখিত বক্তব্যে বিদায়ী এই কমিশনার বলেন, ‘একজন সাংবাদিক মানবাধিকার সম্পর্কে অভিমত জানতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে কথা বলা অমূলক। মানবাধিকার নেই, মানবিক মর্যাদা নেই, গণতন্ত্র না থাকলে এসব থাকে না। বিশ্বে সম্মানজনক রাষ্ট্র হিসেবে আসীন হতে হলে গণতন্ত্রের শর্তসমূহ অবশ্যই পূরণ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভোটাধিকার ও মানবাধিকার একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা থেকে এর উৎপত্তি। বর্তমান অবস্থায় উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আইন প্রণেতাগণ আইন প্রণয়নের চেয়ে উন্নয়নেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু উন্নয়ন কখনও গণতন্ত্রের বিকল্প ব্যবস্থা নয়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে ওই নির্বাচনে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের লাশ পড়ে আছে। এই লাশ সৎকারের দায়িত্ব কে নেবে? কথাটা রূপকার্থে বলা হলেও এটাই সত্য।’
মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘নির্বাচনের নামে সারা দেশে এমন অরাজকতা কখনো কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তৃণমূল পর্যায়ে এই নির্বাচন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। অন্যদিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হওয়া নির্বাচন বলা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিদায়কালে আত্মবিশ্লেষণের তাগিদে বলি, নির্বাচন কমিশনের বড় দুর্বলতা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনিয়ম, পক্ষপাতিত্ব, জালিয়াতি ইত্যাদি সম্পর্কে ভূক্তভোগীরা যে সকল অভিযোগ করেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। লিখিতভাবে যেসব অভিযোগ পাঠানো হয়, তারও যথাযথ নিষ্পত্তি হয় না। অধিকাংশ অভিযোগই আমলে না নিয়ে নথিভূক্ত করা হয় বা অনেক ক্ষেত্রে নথিতেও তার ঠাঁই হয় না। আমাদের কার্যকালের শেষ পর্যায়ে এসে বিগত কয়েক মাসে অবশ্য এর কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে গত পাঁচ বছরে যা কিছু বলেছি , তাতে কোনো ফলোদয় হয়েছে বলে মনে হয়। না। আগেও বলেছি , নির্বাচন কমিশন গঠন আইন বাধ্যতামূলক। তবে আইনটি সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে, সংকটের সমাধান হবে না।’
তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণের কোনো পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে না। এতে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমি সব সংকটের সমাধান দেখতে চাই। নির্বাচনে জনমানসের প্রতিফলন একান্ত অপরিহার্য। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্র জনমানসের প্রতিফলন একান্ত অনুপস্থিত। এতে বিশেষভাবে টাকার খেলাই প্রতিভাত হয়। রাজনীতি ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীদের করতলগত হয়ে যাচ্ছে। আমার প্রশ্ন, আইন প্রণেতারা ভবিষ্যতে আইন ব্যবসায়ী হয়ে যাবেন না তো? অবাধ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাধাবিঘ্নগুলো দূর করতে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন। এজন্য সংবিধান ও বিধিবিধানের পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। বসন্তের প্রথম দিনে ও ভালোবাসা দিবসে আপনাদের সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে বিএনপির মুখপাত্র হয়ে কথা বলার অভিযোগের প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার দাবি করেন বিএনপির যে কি সুর তা আমি জানি না। তবে নীরব জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র হয়ে সবসময় কথা বলি।’
তিনি বলেন, ‘নীরব জনগোষ্ঠীর ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে সারফেসে আসেনা রাজনৈতিক দলগুলো বলে না সেসব অশ্রুত ভাষা আমি বলার চেষ্টা করেছি।
সাংবাদিকদের তিনি মিস করবেন কিনা এমন প্রশ্নে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন আমি অবশ্যই আপনাদের মিস করবো আপনারাও কোনদিন আমাকে ভুলবেন না।’
তিনি বলেন, ‘আমি পাঁচ জনের একজন গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গণতন্ত্রের সংখ্যালঘু হিসেবে হেরে গেলাম, এমন ঘটনা রয়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচন কমিশনের কথা বলতে গিয়ে আমাকে বক্তব্য রাখতে দেওয়া হয়নি; কিন্তু মতামত প্রকাশের অধিকার কিন্তু সংবিধান আমাকে দিয়েছে।’
এসএ/