বিশিষ্টজনদের মতামত
সার্বজনীন-নিরপেক্ষতা নয়, সাহসী লোক দরকার ইসিতে
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিরপক্ষেতা আর সার্বজনীনতা না খুঁজে সাহসী লোক খুঁজে বের করার মত দিয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। তারা বলেছেন, নিরপেক্ষ বলতে কাউকে পাওয়া যাবে না, যে ব্যক্তি সাহস করে তার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন তাদের ইসিতে আসা উচিত। এক্ষেত্রে নির্বাচন পরিচালনার সময় সরকার প্রধানও যদি আচারণবিধি লঙ্ঘন করেন তাকেও বলার সাহস যে ব্যক্তি রাখতে পারবেন তাকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
রবিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বিকালে সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জের কনফারেন্স রুমে ২৩ বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে বৈঠকে করে সার্চ কমিটি। যদিও ২৩ জনের মধ্যে মাত্র ১৮ জন উপস্থিত ছিলেন। সার্চ কমিটির সভাপতি বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সভায় সভাপতিত্ব করেন।
আলোচনার শুরুতে সার্চ কমিটির প্রধান ওবায়দুল হাসান বলেন, সার্চ কমিটিতে যতগুলো নাম এসেছে সবগুলো নাম প্রকাশ করা হবে। সেক্ষেত্রে ৫০০ নাম আসলেও সেগুলো প্রকাশ করা হবে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি, সিপিবি, বাসদসহ যারা এখনও নাম দেয়নি তারা সোমবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিকাল ৫ টা পর্যন্ত নাম দিতে পারবেন। দ্বিতীয় দিনের অংশগ্রহণকারী বিশিষ্টজনদের একটা দাবিতে ঐক্যমত ছিল যে যারাই নির্বাচন কমিশনে আসবে তাদের অবশ্যই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হতে হবে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘দেশে এখনও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের লোক রয়েছে। তাই কোনো ব্যক্তি এককভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাশাপাশি সৎ ও যোগ্য এবং সাহসী ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে।’
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে প্রধানমন্ত্রীকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে- এমন সৎ ও সাহসী ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনে আসতে হবে। আমরা সেটাই বলেছি। আমরা আজ কিছু নাম প্রস্তাব করেছি। ইসিতে যারাই আসুক তাকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে। তিনি বলেন, ‘সার্চ কমিটির বৈঠকে বলেছি, নিরপেক্ষ না খুঁজে সাহসী ও সৎ খুঁজতে হবে। সময় লাগলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে বলেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সার্চ কমিটিতে নির্বাচন কমিশনের জন্য ১০ জনের নাম প্রস্তাব করেছি। আমাদের তালিকায় নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদেরও নাম রয়েছে।’
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘তারা (অনুসন্ধান কমিটি) প্রস্তাবিত সব নাম প্রকাশ করবে। মজুমদার সাহেব (সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার) সাহেব বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলো কার কার নাম প্রস্তাব করেছেন, সেটা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে। কিন্তু আমরা সেটার বিরোধিতা করেছি, বলেছি সবার নাম যাক, তবে কে কোন নাম প্রস্তাব করেছে, সেটা বলা বাঞ্ছনীয় নয়। তাহলে একটা মার্কা হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ লোক পাওয়া কঠিন। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হলেই চলবে।
তিনি আরও বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন কমিশন চেয়েছি। সেখানে আমলাতন্ত্র ও জুডিশিয়ারির যে ধারায় কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হয় সেটা বাদ দিতে বলেছি। আমরা চাই কমিশনে সিভিল সোসাইটি এবং নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব থাকুক।
এই ইতিহাসবিদ বলেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তি পাওয়া যাবে না। নিরপেক্ষ বলেও কোনো ব্যক্তি নেই। সবকিছু সার্চ কমিটির ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী নন এমন কাউকেও কেউ চাইবে না। আবার নির্বাচন কমিশন চাইলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এর কারণ এর সঙ্গে রাজনৈতিক দলসহ অনেকগুলো বিষয় জড়িত। তাই আমি মনে করি, সার্চ কমিটিকে এমন ব্যক্তি খুঁজে বের করতে হবে- যিনি সৎ ও সাহস নিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবেন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এমন অবস্থায় যারা সৎ, সাহসী তাদের নিয়োগ দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিগত দুটি নির্বাচনের মতো নির্বাচন হলে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশ বড় ধরনের বিপদের মুখে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে সৎ ও সাহসী ব্যক্তির বিকল্প নেই।
সাখাওয়াত হোসেন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দেওয়া নামগুলোর মধ্য থেকে কমিশনে নিয়োগ না দেওয়ার আহ্বানও জানান। তিনি বলেন, ‘কোনো কমিশনার রাজনৈতিক দলের প্রস্তাব অনুসারে এলে ওই দলের প্রতি তার আনুগত্য তৈরি হবে।’
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘প্রথম ধাপে কোন দল কার নাম প্রস্তাব করেছে সেগুলো প্রকাশ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্বচ্ছতার সঙ্গে সুনামের অধিকারী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে হবে। জাতি এখন ভয়াবহ সংকটের মধ্যে আছে, সেই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরা তাদের কাছে জানতে চাই—এই নির্বাচন কমিশনারদের খুঁজে বের করার পেছনে তারা কী ধরনের প্রক্রিয়া এবং কোনো ধরনের মানদণ্ড ব্যবহার করবেন।’
তিনি বলেন, ‘স্বনামধন্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে। এই মানদণ্ডগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এ মানদণ্ডগুলো চিহ্নিত করার মাধ্যমে আস্থার সংকট দূর হবে। শুধু নাম প্রকাশ করলে হবে না, কোন দল কার নাম প্রকাশ করলো, কীভাবে করলো সেই বিষয়গুলো সবার সামনে প্রকাশ করতে হবে।’
অর্থনীতিবিদ ড. খলিকুজ্জামান বলেন, ‘ইসিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী লোকদের নিয়োগ দিতে হবে। এ ব্যাপারে ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। পাশাপাশি নারী ও সংখ্যালঘু সদস্যও কমিশনে রাখতে হবে।
দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের গোলাম কুদ্দুছ, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ আলী জহির, সাবেক অ্যাডিশনাল আইজিপি নুরুল আলম, গীতিকার ও সুরকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত, সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন, অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, প্রজন্ম৭১-এর আসিফ মুনির, ডা. নুজহাত চৌধুরী, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ও অর্থনীতিবিদ ড. তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ।
সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে ছিলেন, বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামান, মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক (সিএজি) মুসলিম চৌধুরী, সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সাচিবিক সহায়তা দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
এসএম/এমএ/এএস