কবীর চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকীর আলোচনা
‘অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে হবে’
মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী নাগরিক আন্দোলনের পুরোগামী নেতা বরেণ্য বুদ্ধিজীবী একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর শততম জন্মদিন ৯ ফেব্রুয়ারি বুধবার। এ দিনে শুরু হয়েছে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে নির্মূল কমিটির বছরব্যাপী অনুষ্ঠান।
এ উপলক্ষে বুধবার বেলা ২টায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ‘মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক কবীর চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা, আলোচনা সভা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। দিনের কর্মসূচি শুরু হয় সকাল ১০টায় মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সমাধিতে পুষ্পস্তবক প্রদানের মাধ্যমে।
নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে ভার্চ্যুয়াল স্মারক বক্তৃতা করেন সাংবাদিক আবেদ খান।
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউটের সাম্মানিক সভাপতি নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী সমাজকর্মী আরমা দত্ত এমপি, নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, নির্মূল কমিটির সহসভাপতি মমতাজ লতিফ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, লেখক গবেষক মফিদুল হক, নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. আমজাদ হোসেন, প্রজন্ম ’৭১-র সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, নির্মূল কমিটির যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি সৈয়দ এনামুল ইসলাম, নির্মূল কমিটির বহুভাষিক সাময়িকী ‘জাগরণ’ হিন্দি বিভাগের সম্পাদক ভারতের সমাজকর্মী তাপস দাস, তুরস্কের টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিটির সাধারণ সম্পাদক লেখক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা শাকিল রেজা ইফতি এবং নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা কাজী মুকুল।
সভার প্রারম্ভে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী নাগরিক আন্দোলনের পুরোগামী নেতা অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর (১৯২৩-২০১১) জীবন ও কর্ম সম্পর্কে প্রামাণ্যচিত্র ‘নাই বা হলো পারে যাওয়া’র অংশবিশেষ প্রদর্শিত হয়।
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘২০১১ সালে মৃত্যুর পূর্বে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন শিক্ষা কমিশন যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল অবিলম্বে সেই অসাম্প্রদায়িক মানবিক শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার দর্শনের প্রতিফলন থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনের নেতা ও সংগঠকদের কাছে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী শুধু একটি পরিচিত নাম নয়- সাহস ও প্রেরণারও অফুরন্ত উৎস। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমৃত্যু তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন ’৭১-এর ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং তাদের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের আন্দোলনের। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা গোলাম আযমের বিচারের জন্য যে ঐতিহাসিক গণআদালত বসেছিল, যেখানে সমাগম হয়েছিল পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের তার অন্যতম বিচারক ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। খালেদা জিয়ার সরকার তাঁকে ও জাহানারা ইমাম সহ গণআদালতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করেছিল। শাসকশ্রেণীর ক্রোধ ও প্রতিহিংসা কখনও তাঁকে দমন করতে পারেনি। অন্যায়ের সঙ্গে কখনও আপোষ করেননি তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সতের বছরে দুই শতাধিক আলোচনা সভা ও জনসমাবেশে পৌরহিত্য করেছেন তিনি, নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজপথের মিছিলে।’
স্মারক বক্তৃতায় আবেদ খান বলেন, ‘আমরা কবীর চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকী পালন করব তাঁর কর্ম ও দেখানো পথের চর্চার মাধ্যমে। পঁচাত্তরের পর যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললে নানাভাবে নির্যাতিত হতে হতো তখন তিনি আমাদের পথ দেখিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে তিনি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য তিনি কখনো কারো সাথে আপোষ করেননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা এখনো চক্রান্ত করে যাচ্ছে। বস্তুত, বাংলাদেশ এখনো চেতনাগতভাবে পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারেনি। স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল না করা পর্যন্ত বাংলাদেশ পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে না। তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে বাংলাদেশের অর্জনগুলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদেরকে ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করেই সামনে অগ্রসর হতে হবে।’ বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মৌলবাদীরা যে অপপ্রচার, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে তা আমাদের সকলকে একত্রিত হয়ে রুখতে হবে। করোনার কারণে আমাদেরকে ঘরে আবদ্ধ থাকতে হলেও আমরা কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারি। সুতরাং আমরা যদি যার যার জায়গা থেকে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিপক্ষে লড়াই করি তাহলে আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত।’’
রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘তিনি আমাদের জন্য তাঁর যে কর্মময় জীবন রেখে গেছেন তা আমাদের জন্য পাথেয় এত কাজের ফাঁকেও তিনি নির্মূল কমিটির মতো এতবড় সংগঠনের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। তাঁর শেষ সম্বল গুলশানের বাড়িটি বিক্রয় করে তিনি বাংলা একাডেমিসহ নানা সংগঠনে অর্থ দান করে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন লড়াই করে গিয়েছিলেন। অকুতোভয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী যে পথে চলেছিলেন সে পথে আমরা যদি চলতে পারি তাহলেই মুক্তিযুদ্ধে চেতনা নির্ভর বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।’
আরমা দত্ত বলেন, ‘অধ্যাপক কবীর চৌধুরী কখনো মৌলবাদীদের আস্ফালনের ভীত হয়ে তাদের সাথে আপোষ করেননি। তিনি আমাদের যে পথ দেখিয়ে গেছেন আমরা যেন সে পথে আজীবন চলতে পারি এ কামনাই করি।’
শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের মনোজগতের প্রসার পিছিয়ে পড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। সমৃদ্ধ জাতি গঠন ও টেকসই উন্নয়নে অবশ্যই মানুষকে শুদ্ধাকারী ও মননশীল হতে হবে। আজ সংবেদনশীল উদার মানবিক চেতনাবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে বাড়ছে প্রচণ্ড ধর্মান্ধতা। সাম্প্রদায়িকতায় ছেয়ে গেছে দেশ। হিংসা বিদ্বেষে ভরা অপসংস্কৃতির ভাষণ চলছে। যার ফলে জঙ্গিবাদসহ নানা রকম অশুভ তৎপরতায় দেশ ভরে যাচ্ছে। তাই অবকাঠামোর উন্নয়নের সাথে একইভাবে থাকতে হবে উপযুক্ত শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর-এর প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি, লেখক গবেষক মফিদুল হক বলেন, ‘পঁচাত্তর পরবর্তী তামসিক বাংলাদেশকে আজকে উন্নয়নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাঁদের ভূমিকা রয়েছে তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের ক্ষেত্রে কবীর চৌধুরী যে লড়াই করেছিলেন তা আজও আমাদের জন্য পাথেয়। শিক্ষা সংস্কৃতির জন্য তিনি যে কাজগুলো করে গিয়েছিলেন তা তাঁর চলে যাওয়ার পর অনেকটা স্তিমিত হয়ে গেছে। আজকে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা ও সংস্কৃতি সপ্তাহ আর পালন করা হয় না। এমনভাবে প্রগতিশীল কাজগুলো এখন স্তিমিত হয়ে গেছে। আমরা চাই, কবীর চৌধুরীর ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি যেন দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়।’
এপি/