ভবিষ্যৎ পেশাজীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় ৫৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হতাশায় ভোগেন বেশি: জরিপ
প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত
উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারেন না অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান, হলের পরিবেশ নিয়ে অসন্তষ্টি, জ্যেষ্ঠ সহপাঠী ও শিক্ষকদের বুলিং, যৌন হয়রানি, ভবিষ্যৎ পেশা নিয়ে দুশ্চিন্তা, মন খুলে কথা বলতে না পারার কারণে হতাশা এবং বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন অনেক শিক্ষার্থী।
প্রচণ্ড মানসিক অস্থিরতা ও প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পারার কারণে ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর মনে আত্মহত্যার চিন্তা আসে। ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভবিষ্যৎ পেশাজীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
শুক্রবার (৭ জুন) আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ’ শিরোনামে জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়। চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সারা দেশের ৮৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১ হাজার ৫৭০ সংখ্যক শিক্ষার্থীর ওপর জরিপটি চালানো হয়। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৫২ শতাংশ ছাত্রী ও ৪৮ শতাংশ ছাত্র। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৫ শতাংশের বয়স ছিল ১৭ থেকে ২৬ বছর। বাকি শিক্ষার্থীদের বয়স ২৭ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ২৩ শতাংশ ছিলেন তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
জরিপে বলা হয়, উন্নত ক্যারিয়ার গড়তে শিক্ষার্থীদের প্রায় ৩১ দশমিক ৭ শতাংশই উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এছাড়াও ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যারিয়ার হিসেবে সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখছেন। তবে শিক্ষা জীবনের মাঝামাঝিতে এসেও এখনও নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে কিছুই ভাবছেন না প্রায় ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী।
প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে হতাশার বিভিন্ন উপসর্গে ভোগেন। তাদের ক্লান্তি, ওজন কমে যাওয়া, কোনো কিছু উপভোগ না করা, ঘুমের ধরনের পরিবর্তন, আত্মহত্যার চিন্তা, কাজে মনোযোগ দিতে না পারা ইত্যাদি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা এ ধরনের উপসর্গের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন।
বিষণ্নতার কারণ ও আত্মহত্যার ভাবনা: শিক্ষার্থীদের একটি অংশ জানিয়েছেন, জ্যেষ্ঠ সহপাঠী ও শিক্ষকদের বুলিং, যৌন হয়রানি তাদের বিষণ্নতার দিকে ধাবিত করে।
৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছেন সহপাঠী ও সিনিয়র সহপাঠীদের হাতে, এ হার প্রায় ৮৬ শতাংশ। প্রায় ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে অসন্তষ্ট। ৫৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা মন খুলে কথা বলার মতো কোনো শিক্ষক পান না।
জরিপে বলা হয়, প্রচণ্ড মানসিক অস্থিরতা ও প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে উঠতে না পারা থেকে অনেকের মনে আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে কিন্তু আত্মহত্যা চেষ্টা করেননি ৩৯ শতাংশ, আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে এবং উপকরণও জোগাড় করেছেন ৭ শতাংশ। তবে প্রায় ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তাদের মাথায় কখনো আত্মহত্যার চিন্তা আসেনি। এ ছাড়া মা–বাবার সঙ্গে অভিমান, প্রেমঘটিত বিষয়, অর্থনৈতিক সমস্যা, অন্যরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায় আত্মহত্যা করার চিন্তা এসেছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
হতাশায় এগিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা:
সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার উপসর্গ নিয়ে তুলনা করতে গিয়ে দেখা যায়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার উপসর্গ অনুভব করার হার বেশি। ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন তারা এই ধরনের বিষণ্নতার উপসর্গগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন। বাকি ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের মাঝে হতাশার উপসর্গ দেখা যায় নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার চিত্র তুলনামূলক কম। ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তারা হতাশার উপসর্গগুলো অনুভব করেছেন। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তারা এই ধরনের উপসর্গের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন।
ক্যাম্পাসে বুলিং ও যৌন নিগ্রহ:
ক্যাম্পাস জীবন বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে আড্ডাবাজি, খুঁনসুটি, হৈ-হুল্লোড়; এক কথায় প্রাণবন্ত মুহূর্তের চিত্রপট। কিন্তু এই সুখস্মৃতির মুহূর্তগুলোর পাশাপাশি ক্যাম্পাস জীবনে হতাশার গল্পও থাকে অনেকের। সহপাঠী, সিনিয়র কিংবা শিক্ষক কর্তৃক ক্যাম্পাসে শারীরিক বা মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হওয়াই ক্যাম্পাস বুলিং।
জরিপে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারী মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন ৩১ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী। যার মাঝে বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ, র্যাগিং এর শিকার হয়েছেন ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হননি ৬৮ দশমিক ৯ শতাংশ।
হলের পরিবেশও প্রভাব ফেলছে বিষণ্নতায়: বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেকেই হল বা ডর্মেটরিতে অবস্থান করে। হলে থাকা-খাওয়া ও পড়াশুনার পরিবেশও একজন শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে। হলের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির ক্ষেত্রে ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ জানিয়েছেন তারা পুরোপুরি অসন্তুষ্ট। সন্তুষ্টির কথা বলেছেন মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকিরা জানিয়েছেন তারা মোটামুটি সন্তুষ্ট।
৭০ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন হলের পরিবেশ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ডিপার্টমেন্ট অব সোশাল সায়েন্সেস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ওবায়দুল্লাহ আল মারজুক, এডিডি ইন্টারন্যাশনালের কমিউনিটি ভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্পের ব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ আল হারুন এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সামাজিক সংস্কার, অসচেতনতা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার অপ্রতুলতার বিষয়টিও প্রকাশ পেয়েছে জরিপে। প্রায় ৩৬ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয় না। ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এই সম্পর্কে কিছু জানেন না। এজন্য ক্যাম্পাসে কাউন্সেলিং ইউনিটের ব্যবস্থা করা, মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করা, নিরাপদ বাসস্থান ও উন্নতমানের খাদ্যব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক উন্নয়ন, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ও শিক্ষাসংক্রান্ত মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী বলেন, পরিবার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব রয়েছে শিক্ষার্থীরা কেন হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগছে, তা বোঝা ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। বিশেষ করে হলের পরিবেশ নিয়ে যে অস্থিরতা সেই সমস্যার সমাধান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তিশালী একটি পক্ষের সদিচ্ছা দরকার। শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে, শুধু ১০০ মিটার দৌড়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোই অর্জন নয়, আরও নানাভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়।
তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে হতাশায় ভুগলে চিকিৎসা নিতে হবে। কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আত্মহত্যার চিন্তা যেন না আসে, সে লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের ছোট থেকে মানসিক দৃঢ়তা বাড়ানোর প্রশিক্ষণ দিতে হবে।