বেনজীরের পাসপোর্টেও মহা জালিয়াতি
ছবি: সংগৃহীত
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদ নিজের পাসপোর্ট করতে নজিরবিহীন জালিয়াতি করেছেন। পুলিশ পরিচয় আড়াল করে পাসপোর্টে নিজেকে ‘বেসরকারি চাকরিজীবী’ পরিচয় দিয়ে নিয়েছেন সাধারণ পাসপোর্ট। সরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে নীল রঙের অফিশিয়াল পাসপোর্ট করেননি তিনি। সুযোগ থাকার পরও নেননি ‘লাল পাসপোর্ট’।
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের আলোচিত দুই ভাই হারিস আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ জোসেফ যে প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট করেছিলেন, ঠিক সেই একই কায়দায় পাসপোর্ট নেন বেনজীর।
চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য একটি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা গেছে।
জানা যায়, বেনজীর তার পুরনো হাতে লেখা পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করেন ২০১০ সালের ১১ অক্টোবর। রহস্যজনক কারণে নীল রঙের অফিশিয়াল পাসপোর্ট না নিয়ে সাধারণ পাসপোর্ট নেন তিনি। এ সময় আসল পরিচয় আড়াল করে নিজেকে বেসরকারি চাকরিজীবী বলে পরিচয় দেন। আবেদন ফরমে পেশা হিসাবে লেখেন ‘প্রাইভেট সার্ভিস’।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর বেনজীরকে নবায়নকৃত এমআরপি (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) দেওয়া হয় (নম্বর এএ১০৭৩২৫২)। মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ছিল ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর। মেয়াদপূর্তির আগেই ২০১৪ সালে ফের তিনি পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করেন। কিন্তু এবারও যথারীতি নিজেকে বেসরকারি চাকরিজীবী বলে পরিচয় দেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেনজীর তখন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার। এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেই তিনি অফিশিয়াল পাসপোর্ট নেননি। তার দ্বিতীয় দফায় নবায়নকৃত পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (পাসপোর্ট নম্বর বিসি ০১১১০৭০)। পরে ২০১৬ সালে তিনি ফের পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন জমা দেন। এ সময় তিনি ছিলেন র্যাব মহাপরিচালক। এবারও যথারীতি তিনি বেসরকারি পাসপোর্টের আবেদন করেন। তখনই ধরা পড়ে তার তথ্য গোপন ও জালিয়াতির ঘটনা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বেনজীর নিজে পাসপোর্ট অফিসে হাজির হননি। আবেদন ফরম নিয়ে আসেন তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা। কিন্তু র্যাব মহাপরিচালকের বেসরকারি পাসপোর্ট দেখে সংশ্লিষ্ট পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। পরে বিষয়টি পাসপোর্ট অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালকের নজরে আনা হলে বেনজীরের আবেদনপত্র আটকে যায়। তখন বেনজীরকে বিভাগীয় অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দাখিল করতে বলা হয়। কিন্তু এনওসি জমা না দিয়ে পাসপোর্ট নবায়নের চাপ দেন বেনজীর।
সূত্র জানায়, সন্দেহজনক বিবেচনায় বেনজীরের বেসরকারি সাধারণ পাসপোর্ট গ্রহণের পক্ষে যথাযথ ব্যাখ্যা চেয়ে র্যাব সদর দপ্তরে চিঠি দেয় পাসপোর্ট অধিদপ্তর। কিন্তু এতে কাজ হয়নি। ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর র্যাব সদর দপ্তর থেকে তার উদ্দেশ্য হাসিলের পক্ষে চিঠি দেওয়া হয়। র্যাব সদর দপ্তরের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) আব্দুল জলিল মন্ডল অবিলম্বে তার পাসপোর্ট প্রতিস্থাপনের অনুরোধ করে চিঠি দেন। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেনজীরকে পাসপোর্ট দিতে বাধ্য হয় পাসপোর্ট অধিদপ্তর (ডিআইপি)। যার নম্বর বিএম০৮২৮১৪১।
যে কারণে বেনজীর লাল পাসপোর্ট নেননি?
২০২০ সালে ৩০তম আইজিপি হিসাবে পুলিশবাহিনীর প্রধান পদে দায়িত্ব নেন বেনজীর। নিয়মানুযায়ী সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা হিসাবে তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট পাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি মর্যাদাপূর্ণ লাল পাসপোর্টও নেননি। আইজিপি হয়েও তিনি ফের বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন করেন। কিন্তু ততদিনে দেশে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ই-পাসপোর্ট চালু হওয়ায় বেনজীরের আবেদন নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়।
সূত্র জানায়, এ সময় বেনজীর আহমেদ আশ্রয় নেন নজিরবিহীন প্রতারণার। চলাচলে অক্ষম হিসাবে গুরুতর অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে ডিআইপির মোবাইল ইউনিট চেয়ে পাঠান। পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তার বাসায় গিয়ে ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ নেওয়াসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন। অতিগোপনে করা হয় এসব কাজ। ২০২০ সালের ৪ মার্চ তার আবেদনপত্র জমা হয়ে যায়। ১ জুন বেনজীরের নামে ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট ইস্যু করা হয় (নম্বর বি০০০০২০৯৫)। একই প্রক্রিয়ায় সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের দুই ভাই হারিস আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ জোসেফের পাসপোর্ট করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিথ্যা তথ্যে পাসপোর্ট দেওয়া ছাড়াও বেনজীরের পাসপোর্টে আরও কয়েকটি বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। যেমন: সরকারি চাকরিজীবীদের ৫ বছরের বেশি মেয়াদের পাসপোর্ট দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও তাকে দেওয়া হয়েছে ১০ বছর মেয়াদি। এছাড়া আইজিপির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তার নামে সাধারণ পাসপোর্ট ইস্যুর আগে বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানোর কথা থাকলেও তা মানা হয়নি।
পাসপোর্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়মানুযায়ী যে কোনো সরকারি চাকরিজীবী চাইলে অফিশিয়াল পাসপোর্টের বদলে সাধারণ পাসপোর্ট নিতে পারেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। পেশা হিসাবে সরকারি চাকরিজীবী কথাটি উল্লেখ করতে হয়। সরকারি চাকরি করে কোনোভাবেই বেসরকারি চাকরি বা অন্য কোনো পেশা উল্লেখ করার সুযোগ নেই। এছাড়া পুলিশ প্রধানের মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে ‘বেসরকারি চাকরিজীবী’ পরিচয়ে পাসপোর্ট নেওয়া রীতিমতো বেআইনি এবং দণ্ডনীয় অপরাধ।
সূত্র বলছে, সরকারি চাকরি করেও নানা কারণে অনেকে সাধারণ পাসপোর্ট নিয়ে থাকেন। এর একটি বড় কারণ ভিন্ন কোনো দেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার সুবিধা নেওয়া। কারণ, সরকারি পাসপোর্ট থাকলে অন্য কোনো দেশে বসবাস বা নাগরিকত্ব গ্রহণ বেশ জটিল। এছাড়া অফিশিয়াল পাসপোর্টধারীদের দেশের বাইরে যেতে হলেও বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ থেকে বহির্গমনসংক্রান্ত অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু বেসরকারি পাসপোর্টে এসব জটিলতা কম। তাছাড়া সাধারণ পাসপোর্টে বিদেশ গমন অনেকটা বাধাহীন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাসপোর্ট কর্মকর্তা বলেন, আইজিপি হয়েও বেনজীরের মর্যাদাপূর্ণ কূটনৈতিক পাসপোর্ট না নেওয়া অস্বাভাবিক। এর ভিন্ন কারণ থাকতে পারে। হয়তো ইতোমধ্যে তিনি ভিন্ন কোনো দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। এ কারণে ইচ্ছা থাকলেও তিনি লাল পাসপোর্ট গ্রহণ করতে পারেননি। এছাড়া যে কোনো সময় দেশ ত্যাগের সুযোগ খোলা রাখতে হয়তো তিনি সাধারণ পাসপোর্ট নেওয়াকে নিরাপদ মনে করেছেন।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটা ন্যক্কারজনক প্রতারণা ও জালিয়াতি। যারা জালিয়াতিপূর্ণ পাসপোর্ট ইস্যু করেছে, তারাও দায় এড়াতে পারেন না। তারা তো বেনজীর আহমেদকে চেনেন না, এমন নয়। কাজেই দুপক্ষের যোগসাজশেই এটা হয়েছে। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, জালিয়াতিসহ বহুমাত্রিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রক হিসাবে পাওয়া বিশেষজ্ঞ নলেজ তিনি অপরাধ সংঘটনের কাজে ব্যবহার করেছেন। সরকারি কর্মকর্তারা পূর্বানুমোদন ছাড়া বিদেশে যেতে পারেন না। এটা এড়ানোর জন্য সরকারি চাকরির তথ্য গোপন করে পাসপোর্ট নেওয়াটা একটা কারণ। অন্য কারণ হচ্ছে- বেসরকারি চাকরিজীবী হিসাবে তিনি যতটা সহজে বিদেশে ভ্রমণ, বিনিয়োগ ও স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পাবেন, সরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে অফিশিয়াল পাসপোর্ট করলে সেই সুযোগ পাবেন না। কাজেই ভয়াবহ ধরনের অপরাধের পরিকল্পনা যে তার শুরু থেকেই ছিল, এটা তারই পরিচায়ক।