ইসি গঠন আইন নিয়ে যা বললেন আইন প্রণেতারা
পাস হলো বহুল প্রতীক্ষিত 'প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২'। এই আইনটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে আখ্যায়িত করেছেন আইন প্রণেতারা বা সংসদ সদস্যরা। তাদের দাবি, আইনটি পাস করার আগে সংবিধানে ৪৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এই আইনে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে না বলেও মত দেন আইন প্রণেতারা।
বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) দুপুরে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার আইন-২০২২, পাস করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। আইনটি জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাব দেন বিরোধীদলীয় একাধিক সংসদ সদস্য। কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী প্রস্তাব উত্থাপনকারী প্রত্যেক সদস্য কথা বলার সুযোগ পান। সেই আলোচনায় অংশ নিয়েই আইন প্রণেতারা এই আইনের তুমুল বিরোধীতা করেন। যদিও আইনমন্ত্রী তার বক্তব্যে সকলের কথার জবাব দিয়ে জনমত ও বাছাই কমিটির প্রস্তাব নাকোচ করে দেন। পরে স্পিকার জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে দিলে তা নাকোচ হয়ে যায়। এরপর আইনটি পাসের প্রক্রিয়ায় যান আইনমন্ত্রী। পরে সংশোধনী আকারে বিলটি সর্বাধিক কণ্ঠভোটে পাস হয়।
জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাব দিয়ে আলোচনা করেন, বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, দলটির মহাসচিব ও সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু, সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি, পীর ফজলুর রহমান, বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ, গণফোরামের মোকাব্বির খান, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু, বেগম রওশন আরা মান্নান ও রুমিন ফারহানা। নিচে সকলের আলোচনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো।
মোকাব্বির খান বলেন, 'দেশবাসীর প্রত্যশা ছিল সংবিধানের আলোকে এমন একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে যেখানে দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হবে এবং অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, রাষ্ট্রপতি নিবন্ধিত দলগুলাকে ডেকেছিলেন, আমরা সেখানে ১৭ কোটি মানুষের আকাঙ্খা আলোকে দাবি উত্থাপন করেছিলাম। আমরা মনে করেছিলাম রাষ্ট্রপতি এবার হয়তো ব্যাতিক্রম কিছু করবেন। কিন্তু যারা সংলাপে গিয়েছিলেন তারা এই ধরনের আইন চান নাই। মানুষ তার আকাঙ্খা প্রত্যাশা থেকে বঞ্চিত হবে।'
মুজিবুল হক বলেন, 'আমরা আশা করেছিলাম বিলটা গণতান্ত্রিকভাবে আসুক। এই বিল আনার পর বর্তমান নির্বাচন কমিশন শতভাগ আমলা নির্ভর। এখনও যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতেও বিচারপতি। দেশে কি বিচারপতি আর আমলা ছাড়া বিশ্বাস করার মতো মানুষ নাই? রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কি বিশ্বাস করেন না? স্পিকারকে বিশ্বাস করেন না? সংসদ সদস্যদের কি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়? শ্রীলঙ্কায় সাংবিধানিক পদের লোকগুলো সাংবিধানিক কাউন্সিল করে নিয়োগ করতে পারে। নেপালেও একই অবস্থা। কেন আমরা না। আপনাদের তো ক্যান্টনমেন্টে জন্ম হয় নাই। দেশ স্বাধীন করার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছেন। আপনারা কেন বিচারপতি আর আমলাদের উপর নির্ভর করবেন? এই বিলের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি রাখেন কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কর্তৃক যে দুই জন সেখানে, আমরা নিশ্চিত কোনো আমলাই দেওয়া হবে। সেই দুইজনের নিয়োগের ভার রাষ্ট্রপতির হাতে না দিয়ে স্পিকারকে দায়িত্ব দেন। আর সংসদের দুইজন সদস্যকে যেন রাখা হয়। তাতে কিছুটা হলেও আমরা বলতে পারব আমাদের অংশগ্রহণ আছে। সংসদ হচ্ছে সকল কর্মকাণ্ডের মূল। আর সেই সংসদের কোনো অংশগ্রহণ থাকবে না এটা খুবই দুঃখজনক।'
ফখরুল ইমাম বলেন, 'সংবিধানের ৪৮(৩) ধারায় স্পষ্ট লেখা আছে রাষ্ট্রপতি মাত্র দুইজন ব্যক্তিকে নিয়োগ করতে পারেন। একজন হলেন প্রধানমন্ত্রী আর একজন হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি। এখন আসছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে কে নিয়োগ করবে? সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে আইন তৈরি করবেন। কিন্তু ওখানে বলেন নাই সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা অতিক্রম করে আইন তৈরি করবেন। আইনমন্ত্রী বলেছিলেন এটা অনেক সময় লাগবে, তখন বিষয়টি অনুধাবন করেই বলেছিলেন। সময় লাগবে কেন? কারণ সংবিধানকে সংশোধন করতে হবে। সংবিধানকে সংশোধন না করে ৪৮(৩) কে পাশ কাটিয়ে কোনো আইন তৈরি করা যাবে না। যদি আইন তৈরি করা হয় তাহলে এটা সংঘর্ষিক হবে সংবিধানের সঙ্গে।'
তিনি বলেন, 'আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যদি কণ্ঠভোটে পাস করিয়ে দেন তাহলে এটা সব থেকে বাজে উদাহরণ হবে।'
রুমিন ফারহানা বলেন, '১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন প্রণয়ন বাধ্যতামূলক। কিন্তু সকল অংশীজনের মতামত ছাড়া তাড়াহুড়ো করে এত জনগুরুত্বপূর্ণ একটি আইন পাস করা আই ওয়াশের বেশি কিছু নয়। এই আইন যে শুধু বিএনপি বা অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রত্যাখান করেছে তাই নয়, সুশিল সমাজ আইনজ্ঞ সাবেক নির্বাচন কমিশনারসহ অনেকেই এটির কঠোর সমালোচনা করেছে। খসড়া আইনটির সঙ্গে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুসন্ধান কমিটি গঠনের জন্য জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই বললেই চলে। তাই অনুসন্ধান কমিটি গঠনের আইন বললেই ওত্যুক্তি হয় না। এই কমিটিতে সরকারি দল সংসদের প্রধান বিরোধী দল, তৃতীয় সংখ্যা গরিষ্ঠ দল থেকে একজন করে প্রতিনিধি যদি থাকত তাহলে স্বচ্ছতা থাকত। এখনকার মতো সেটিও কোনো স্বাধীন কমিশন হবে না হবে সরকারের নির্বাচন বিষয়ক মন্ত্রণালয়। নিয়োগটি দিন শেষে হবে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দে। কমিশন গঠন করছেন নাকি সরকারের পছন্দের লোকদের বসাচ্ছেন স্পষ্ট নয়। সুতরাং সার্চ কমিটি গঠন থেকে কমিশন গঠন পর্যন্ত পুরোটাই অস্পষ্ট।'
হারুনুর রশীদ বলেন, 'আইনের ব্যাপারে জনগণের ধারণা একেবারে সুস্পষ্ট যে, সরকার আইন প্রণয়নের নামে জনগণের সঙ্গে প্রহসন করছে। কোনো সন্দেহ নাই যে, আইনটির সঙ্গে ২০১৭ সালে ২৫ জানুয়ারি যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলেন তার সঙ্গে খুব একটা অমিল নাই। আইন প্রণয়ন হয় জনগণের কল্যাণের জন্য মানুষের সুবিধার জন্য কিন্তু যদি সেই আইন মানুষের কল্যাণের চাইতে অকল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে যদি সে আইন যে প্রতিষ্ঠানের জন্য করা হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠান যদি প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় যদি সেই আইন মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য হয়। আইন যদি জনকল্যাণে না হয়, জনগণের কাছে যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে সেটি করার চাইতে না করাই ভালো।'
তিনি বলেন, 'নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি করে কোনো লাভ হবে না। অবশ্যই আইনটি ৪৮(৩) এর সাথে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিতর্কের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানদের প্রধানদের বিতর্কের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন। এই ব্যক্তিগুলো সকলেই প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগপ্রাপ্ত। তাই প্রধানমন্ত্রীর আনুগত্য করাই একেবারে দায়িত্ব এবং কর্তব্য। সংবিধান প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিতর্কিত করবেন। জনগণ হতাশ, জনগণ এটি চায় না। জনগণের দাবি হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার অবশ্যই হতে হবে একটি তত্ত্ববধায়ক এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন।
রওশন আরা মান্নান বলেন, 'সংবিধানে সুস্পষ্ট অনুচ্ছেদের আইন করার উদ্যোগ নেয়নি। তাড়াতাড়ি এই আইন পাস করা ঠিক হবে না। তাহলে আবারও দেশে নানান বিতর্ক সৃষ্টি হবে।'
শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, 'ওয়েস্ট মিনিস্টার ফার্ম অব গভর্নমেন্ট যেখানে প্রধানমন্ত্রী সর্বময়। তিনি সমস্ত ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেন নারীকে পুরুষ বানানো ছাড়া আর পুরুষকে নারী বানানো ছাড়া। যদি সেটা মেনে নিয়ে এই আইন করে তাহলে ঠিক আছে। তবে রাষ্ট্রপতি শব্দটা কেন আনলাম, রাষ্ট্রপতি শব্দটা কেন দিলাম। আর যদি প্রধানমন্ত্রী তার ক্ষমতার একটা অংশ রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে দেবেন যেটা সংবিধানের ৪৮(৩) এ দুটি ক্ষমতা দেওয়া আছে। তার সাথে আর একটি ক্ষমতা দেবেন তাহলে সেটি স্পষ্ট করে বলতে হবে অর্থাৎ অনুচ্ছেদ (৪৮), (৯৫) এবং (৫৬) এর রেফান্সে আছে, তার সাথে ১১৮ যুক্ত করতে হবে। সংবিধান সংশোধন না করে এই করা অসাংবিধানিক হবে।'
কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, 'অনেক আইন বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, ১৫ পৃষ্ঠার আইন মাত্র ১৫ মিনিট লাগল করতে। এখন আনার পর এত তাড়াহুড়া করে আনা হলো একথা ঠিক না। আইন করে কিছু হবে না, যতদিন পর্যন্ত একে অপরের প্রতি বিশ্বাস বা আস্থা না স্থাপন করতে পারব, ততদিন পর্যন্ত আইন করে কিছু হবে না। জাতীয় পার্টির আগাগোড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে।'
রেজাউল করিম বাবলু বলেন, 'মানুষের জন্য আইন হয়, আইনের জন্য মানুষ নয়। এই আইনটা বাস্তবায়ন করার পূর্বে অবশ্যই সংবিধান সংশোধন করা অতিব জরুরি ছিল। সংবিধান সংশোধন না করে আইন করায় আজীবন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে।'
পীর ফজলুর রহমান বলেন, '৯ ধারা যুক্ত করে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি না আনলেই পারতেন। এই সংসদে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ রয়েছে। তারপরও অনেকের আগ্রহ রয়েছে আরও আলোচনা করলে আরও সমৃদ্ধ হতো। সংবিধানের (৪৮) অনুচ্ছেদ পরামর্শের বিষয়টা সাংঘর্ষিক কি-না বিবেচনায় নেওয়া উচিত। আসলে নির্বাচনের কোনো পদ্ধতিই এখন পর্যন্ত সার্বজনীন সত্যতে পরিণত হয় নাই।'
এসএম/টিটি