তুমুল বিরোধিতার মুখে ইসি গঠন আইন পাস
বহুল প্রতীক্ষিত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২' পাস হয়েছে সংসদে। নির্বাচন কমিশন গঠন বিলের বিরোধীতা করে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য, বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য, গণফোরামের সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা বিলটি পাস না করে জনমত যাচাই করতে বলেন। তারা বলেন এই বিল সংবিধানের মূল স্প্রিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা করা হলে সংবিধানে খারাপ নজির হয়ে থাকবে। এবারই প্রথম একটি বিল পাস করতে গিয়ে এতোটা বিরোধের মুখে পরেন আইনমন্ত্রী, তার বক্তৃতায় সেই সুরও মেলে। আইনমন্ত্রী বলেন, অনেক দিন পর এমপিরা আমাকে পানি খাইয়ে দিয়েছে।
তবে এবারই প্রথম একটা আইন পাস করতে গিয়ে বিরোধী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ২২টি সংশোধনী গ্রহণের রেকর্ড গড়েছেন আইনমন্ত্রী। জাতীয় পার্টি, বিএনপি, ওয়াকার্স পার্টি, গণফোরাম, জাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংশোধনী গ্রহণ করে বিলটি পাস করা হয়। যা ইতিহাসে নতুন দিগন্ত। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সমাপনী বক্তৃতায় বলেছেন, এবারই প্রথম এতোগুলো সংশোধনী নিয়ে বিল পাস হলো। এটা এখন বিরোধী দলের করা আইনই হয়ে গেলো।
বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
তবে এ বিলে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাব তুলে ধরেন। প্রস্তাব উত্থাপনকারী সংসদ সদস্যরা কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী জনমত যাচাই ও বাছাইয়ের উপর দুই মিনিট করে আলোচনার সুযোগ পান। এ ছাড়া সংশোধনী প্রস্তাবের আলোচনাতেও সময় পান প্রস্তাব উত্থাপনকারী সংসদ সদস্যরা। পরে মন্ত্রী তাদের বক্তব্যের জবাব দিয়ে কতিপয় সংশোধনীসহ স্থিকৃত আকারে বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এরপর স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর বিলটি কণ্ঠভোটে দিলে তা সর্বাধিক ভোটে পাস হয়।
এসময় সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রীসহ উপস্থিত সকল সংসদ সদস্য টেবিল চাপড়ে অভিনন্দন জানান।
প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা শেষে পাস হয় বহুল প্রতীক্ষিত নির্বাচন কমিশন গঠন আইন। এখন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সইয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হবে সব ধাপ। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি আইন হলো। ফলে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটল। আগামী নির্বাচন কমিশন গঠন হবে এ আইনের ভিত্তিতে। আর নতুন নির্বাচন কমিশন আয়োজন করবে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচন।
নির্বাচন কমিশন গঠন আইন কখন, কীভাবে এলো:
রাজনৈতিক দলসহ সুশীল সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে আইন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনটির খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ২৩ জানুয়ারি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক খসড়া বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। সেদিনই বিলটি যাচাই-বাছাই করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয় এবং ৭ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। পরদিন অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কিছু দফায় পরিবর্তন এনে বিলটি চূড়ান্ত করে ২৬ জানুয়ারি বিলের চূড়ান্ত রিপোর্ট উত্থাপন করেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার। সব ধাপ শেষ করতে ১১ দিন সময় লাগে তবে এর মধ্যে কার্য দিবস ছিল ৯ দিন। এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো দীর্ঘ ৫০ বছরের অপেক্ষার পালা।
নির্বাচন কমিশন গঠন আইনে কোথায় কী আছে
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করার কথা বলা আছে। আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের শূন্য পদে নিয়োগদানের জন্য এ আইনে বর্ণিত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নাম সুপারিশ করার উদ্দেশ্যে নিম্নবর্ণিত ছয় সদস্য সমন্বয়ে কমিটি গঠন করবেন। সেই অনুসন্ধান কমিটিতে যারা থাকতে পারবেন যথা: (ক) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনিত আপিল বিভাগের একজন বিচারক, যিনি অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি হবেন; (খ) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনিত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক; (গ) বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরক্ষক ও নিয়ন্ত্রক; (ঘ) চেয়ারম্যান বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন এবং (ঙ) রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনিত দুইজন বিশিষ্ট নাগরিক। এরমধ্যে একজন নারী সদস্য থাকবেন।
আইনে বলা হয়েছে, তিনজন সদস্যের উপস্থিতিতে অনুসন্ধান কমিটির সভার কোরাম গঠিত হবে। অনুসন্ধান কমিটির সভায় উপস্থিত সদস্যগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। ভোটের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের দ্বিতীয় বা নির্ণয়ক ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে। অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করবেন।
অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলী
অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। এ বর্ণিত যোগ্যতা-অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। অনুসন্ধান কমিটি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে এ আইনে যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুসন্ধান করবে। এ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে। অনুসন্ধান কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে রাষ্ট্রপতির কাছে দুইজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারের যোগ্যতা
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের জন্য কোনো ব্যক্তিকে সুপারিশ করার ক্ষেত্রে তার নিম্নরূপ যোগ্যতা থাকতে হবে। (ক) তাকে বাংলাদেশের নাগরি হতে হবে। (খ) তার বয়স ন্যূনতম ৫০ বছর হতে হবে। (গ) কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধাসরকারি, বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় তার অন্যূন ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারের অযোগ্যতা
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগদানের জন্য কোনো ব্যক্তিকে সুপারিশ করা যাবে না,
যদি-(ক) তিনি কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষিত হন;
(খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় হতে অব্যাহতি লাভ না করে থাকেন;
(গ) তিনি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন;
(ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন;
(ঙ) তিনি International Crimes (Tribunals) Act, 1973 Act No. XIX of 1973) বা Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972 (President's Order No. 8 of 1972) এর অধীনে যেকোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হন বা
(চ) আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ব্যতীত তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।
এ আইনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অনুসন্ধান কমিটি কার্য সম্পাদনে প্রয়োজনীয় সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবে। আইনের (৯) দফায় হেফাজত সম্পর্কে বলা হয়েছে- প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ইতোপূর্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি ও তৎকর্তৃক সম্পাদিত কার্যাবলি এবং উক্ত অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ বৈধ ছিল বলে গণ্য হবে এবং উক্ত বিষয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
আইনের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে যা বলা হয়েছে
বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বিধান রয়েছে যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন। সংবিধানের উক্তরূপ বিধান বাস্তবায়নকল্পে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা আবশ্যক। সেলক্ষ্যে 'প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২' শীর্ষক বিলের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।
এসএম/এসএন