‘দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলার অধিকার রাখে না যুক্তরাষ্ট্র’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাবের ৭জন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাইডেন এর গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশের আমন্ত্রণ না জানানো নিয়ে বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো বেশ উল্লসিত।
এ ব্যাপারে সরকারের মূল্যায়ন এবং এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের বক্তব্যে মনে হয় আমরা যেন অপরাধী। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে সব ঠিক হয়ে যাবে, সামনের গণতন্ত্র সম্মেলনে আমাদের ডাকা হবে এ ধরনের মন্তব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের মুখ থেকে আমরা শুনেছি। ফলে মনে হয় এই নিয়ে সরকারের মধ্যে নিশ্চয়ই কোন অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে, এটা তারই ইঙ্গিত দেয়।
মার্কিন মুল্লুক নিজের দেশের অভ্যন্তরে প্রতিদিন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেই চলেছে বলে দাবি করে ওয়াকার্স পাটির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেছেন, যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় পাকিস্তানিদের পক্ষে দাড়িয়েছিল। তাদের অস্ত্র অর্থ সহায়তা করেছিল। অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি আটকাতে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিল। তারা বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলার অধিকার রাখে না। বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে এই দেশের মানুষই কথা বলতে পারে।
বুধবার (২৬ জানুয়ারি) বিকালে একাদশ জাতীয় সংসদের ১৬তম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
রাশেদ খান মেনন বলেন, নারায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ব্যতিক্রমী নির্বাচন হয়েছে। সেই নির্বাচনে মানুষের মাঝে আস্থা ফিরে এসেছে। এটা দেখি দিয়েছে সরকাকে বহাল রেখেই এরকম ব্যতিক্রম নির্বাচন করা সম্ভব। প্রয়োজন সদিচ্ছা ও নির্বাচনী আইন এবং আচারণ বিধি মানা। অর্থ পেশা শক্তি ও প্রশাসনের ভূমিকা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরের সংবিধানের পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন। সংসদ নেত্রীকে অনুরোধ আগামী অধিবেশনে যেন সংবিধান পর্যালোচনার জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করে দেন। যেখানে ধর্মীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে সব বিষয়ে আমরা নতুন করে ভাবতে পারব। তা ছাড়া ৭০ বিধির প্রশ্নে সংবিধানে সংশোধন অতি জরুরি বলেও মনে করেন মেনন।
তিনি বলেন, বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সরব কেবল নয়, সরকার উৎখাতের স্লোগান দিচ্ছে। কিন্তু এসব নিয়ে কথা বলার সময় তারা নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখে না। ২০০৬ সালে দেড় কোটি ভুয়া ভোটার এবং নিজের লোককে প্রধান উপদেষ্টা করার জন্য যে ষড়যন্ত্র তারা করেছিল তারই পরিণতে এদেশে আর একটি সেনা শাসন দেখতে হয়েছিল। আমি জানি না এবার তাদের লক্ষ্য কী, কী তাদের উদ্দেশ্য? সেটা খোলসা করে বলছে না। কিন্তু তাদের কার্যাবলিতে স্পষ্ট তারা একটা অস্বাভাবিক সরকার চায়।
তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। মনোনয়ন বাণিজ্য, অর্থ, ধর্ম ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ মুক্ত নির্বাচনী ব্যবস্থার কথা তারা বলে না। তারা এটা বহাল রাখতে চায়। বাম দাবিদার বন্ধুরা নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের কথা বললেও তাদের মূল দাবি এখন নির্বাচনকালীন সরকার। ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য অর্থ পেশী শক্তি বিশেষ করে প্রশাসন থেকে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে জনমনে আস্থার সম্পূর্ণ বিনষ্ট করেছে।’
নির্বাচন কমিশন আইন যেটা পাস হতে যাচ্ছে তা নিয়ে কথা বলেছেন মেনন। তিনি বলেছেন, আইনটি অসম্পূর্ণ। এটা সংশোধন করতে হবে। না হলে এই বিতর্ক অব্যাহত থাকবে। এ বছর সংবিধানের ৫০ বছর পূর্তি হবে। বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, তা সংসদীয় ব্যবস্থার অন্যতম শ্রেষ্ট সংবিধান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার আমলেই সংবিধানের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সংশোধনী সংবিধানের মূল বিষয়টি পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। সামরিক শাসকরা নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে আর পাকিস্তান আমলের রাজনীতি ফিরে আনতে ওই সংবিধানকে ভোঁতা ছুড়ি দিয়ে জবাই করেছিল। সংবিধানের দ্বাদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনীতে সেই সংবিধানের মূল চরিত্র কিছুটা ফিরিয়ে আনলেও এমন সব বিধি বর্তমান। যা সরকার পরিচালনায় প্রধান নির্বাহী একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সংবিধানকে ধর্মীয় রূপ দিয়েছে। বিএনপি দ্বাদশ সংশোধনীর সময় রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর ভারসম্য বিধান নিয়ে প্রয়াত নেতা আব্দুস সামাদ এর নেতৃত্বে যে প্রস্তাব দিয়েছিল তারা সেটা তখন মানেনি।
সরকারের সমালোচনা করে বলেন, করোনাকালে ধনীর সংখ্যা বেড়ে গেল আবার দরিদ্র হলো আরও অনেক। বৈষম্য নিয়ে কোনো কথা নেই। বৈষম্য নিরসনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ দেখি নাই। বঙ্গবন্ধু যে সাম্য এবং সমতার কথা বলেছেন তা থেকে যোজন যোজন দূরে পিছিয়ে পড়েছি।
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছিল কিন্তু টিআইবি’র প্রকাশিত দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় নিচের দিক থেকে আফগানিস্তানের উপরে কেবল। এ জন্য নিশ্চয়ই লজ্জিত। এই সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ফুয়েল না দিলে ফাইল নড়ে না, এখন সেই ফুয়েলের দাম এবং দুর্নীতির ফুয়েলের দাম এতই বেড়েছে যে ফাইল নড়ানো মুশকিল হয়ে যায়।
মেনন বলেন, ‘করোনা মোকাবেলায় পাশের দেশ ভারত এবং নেপাল থেকে আমরা অনেক সফল, কিন্তু টিকা প্রদানে দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের উপরে মাত্র। টিকা সংগ্রহের জন্য আর্থিক সুবিধা দিতে গিয়ে যে কেলেঙ্কারি হয়েছিল তার কোনো হিসাব পাইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে আমাদের টিকা দিয়েছেন। দেশীয় টিকা উৎপাদনে যে চুক্তি হয়েছিল তার কোনো ফলাফল দেখছি না। রাষ্ট্রপতি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পরামর্শে উপাচার্য নিয়োগ করে থাকেন। ফলে তাদের কুকর্মের দায় তার উপরে এসে পড়ে। উপাচার্যরা কি ধরনের স্বৈরাশাসক দুর্নীতিবাজ হয়ে ওঠেন চাকরি বাণিজ্য হয়ে উঠে তার উদাহরণ দেখেছি। বর্তমানে অনশনরত শিক্ষার্থীর বিপক্ষে শাহজালালা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ভিসিরা দল পাকিয়েছেন। একজন উপচার্যের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হতে পারে না। শিক্ষার্থীদের জীবন ধ্বংস হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি র্যাব সৃষ্টি করেছিল । সেই র্যাব সম্পর্কে তারা আজ বদনাম দিচ্ছে। র্যাব সম্পর্কে তখনই বলেছিলাম যেন একটা নিপীড়ক বাহিনী হয়ে না ওঠে। তার জন্য কথা বলেছি, আওয়ামী লীগ বলেছে, ওয়াকার্স পার্টি বলেছে আমরা বলেছি। এখনও যখন এই সরকাররে আমলে বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড গুমের ঘটনা ঘটছে তখন জোট শরীক ওয়াকার্স পার্টিসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন তার প্রতিবাদ করেছে এবং এখনও করছে। মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড আপাতত বন্ধ রয়েছে বলে মনে হয়। এই বিচার বর্হিভুত হত্যাকাণ্ড কোন যুক্তিতেই সমর্থনযোগ্য নয় তাকে বন্ধ করতে হবে।
এসএম/এমএমএ/