নির্বাচন কমিশন গঠন বিলের রিপোর্ট উত্থাপন
বহুল প্রতীক্ষিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিধান রেখে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২' এর চূড়ান্ত রিপোর্ট সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে।
বুধবার (২৬ জানুয়ারি) স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার চূড়ান্ত রিপোর্ট উত্থাপন করেন।
এর আগে গত ২৩ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশনে বিলটি উত্থাপন করেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। সেদিন মন্ত্রী বিলটি যাচাই-বাছাই করে রিপোর্ট সংসদীয় কমিটিতে প্রেরণ করেন। এর পরদিন সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিলে আংশিক পরিবর্তন পাসের জন্য চূড়ান্ত করে। সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট উত্থাপনের পর এখন পাসের অপেক্ষায় সিইসি ও ইসি নিয়োগ বিল। এর মধ্য দিয়ে শেষ হবে দীর্ঘ ৫০ বছরের অপেক্ষার পালা। আগামী নির্বাচন কমিশন গঠন হবে এই আইনের ভিত্তিতে।
পাসের অপেক্ষায় থাকা প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার বিলে অনুসন্ধান কমিটি গঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের শূন্য পদে নিয়োগদানের জন্য এই আইনে বর্ণিত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নাম সুপারিশ করার উদ্দেশ্যে নিম্নবর্ণিত ৬ সদস্য সমন্বয়ে কমিটি গঠন করবেন। সেই অনুসন্ধান কমিটিতে যারা থাকতে পারবেন যথা: (ক) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনিত আপিল বিভাগের একজন বিচারক, যিনি অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি হবেন; (খ) প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনিত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক; (গ) বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরক্ষক ও নিয়ন্ত্রক; (ঘ) চেয়ারম্যান বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন এবং (ঙ) রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনিত দুইজন বিশিষ্ট নাগরিক।
বিলে বলা হয়েছে, তিনজন সদস্যের উপস্থিতিতে অনুসন্ধান কমিটির সভার কোরাম গঠিত হবে। অনুসন্ধান কমিটির সভায় উপস্থিত সদস্যগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহিত হবে। ভোটের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের দ্বিতীয় বা নির্ণয়ক ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে। অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করবেন।
অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলী:
অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। এই বর্ণিত যোগ্যতা-অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করবে। অনুসন্ধান কমিটি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে এই আইনে যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুসন্ধান করবে। এতদুদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের নিকট হতে নাম আহ্বান করতে পারবে। অনুসন্ধান কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে রাষ্ট্রপতির নিকট দুইজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারের যোগ্যতা:
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের জন্য কোনো ব্যক্তিকে সুপারিশ করার ক্ষেত্রে তার নিম্নরূপ যোগ্যতা থাকতে হবে। (ক) তাকে বাংলাদেশের নাগরি হতে হবে। (খ) তার বয়স ন্যূনতম ৫০ বছর হতে হবে। (গ) কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধাসরকারি, বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় তার অনুন্য ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারের অযোগ্যতা:
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগদানের জন্য কোনো ব্যক্তিকে সুপারিশ করা যাবে না, যদি-(ক) তিনি কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষিত হন; (খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় হতে অব্যাহতি লাভ না করে থাকেন; (গ) তিনি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন; (ঙ) তিনি International Crimes (Tribunals) Act, 1973 Act No. XIX of 1973) বা Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972 (President's Order No. 8 of 1972) এর অধীনে যেকোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হন বা (চ) আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ব্যতিত তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। এই আইনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অনুসন্ধান কমিটি কার্য সম্পাদনে প্রয়োজনীয় সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবে।
আইনের (৯) দফায় হেফাজত সম্পর্কে বলা হয়েছে- প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ইতোপূর্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি ও তৎকর্তৃক সম্পাদিত কার্যাবলি এবং উক্ত অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ বৈধ ছিল বালে গণ্য হবে এবং উক্ত বিষয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
পরিবর্তন আনা হয়েছে যে দুই দফায়:
বিলের দফা-৫ এর ক্রমিক (গ) এর প্রথম লাইনে উল্লেখিত 'বা বেসরকারি পদে' শব্দগুলির পরিবর্তে 'বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায়' কমা ও শব্দগুলি প্রতিস্থাপন হবে।
এ ছাড়া বিলের দফা (৬) এর ক্রমিক (ঘ) এর দ্বিতীয় লাইনে উল্লেখিত 'অন্যূন ২ বছরের শব্দগুলি, সংখ্যা ও বন্ধনী বিলুপ্ত হবে।
আইনের উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে:
বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বিধান রয়েছে যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন। সংবিধানের উক্তরূপ বিধান বাস্তবায়নকল্পে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা আবশ্যক। সেলক্ষ্যে 'প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২' শীর্ষক বিলের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।
উত্থাপিত বিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ প্রদানের নিমিত্ত অনুসন্ধান কমিটি গঠন, অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের জন্য যোগ্যতা-অযোগ্যতা সংক্রান্ত বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া, প্রস্তাবিত বিলে অনুসন্ধান কমিটি কর্তৃক রাষ্ট্রপতির নিকট প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নাম সুপারিশ করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের নিকট হতে নাম আহ্বান করার বিধান রাখা হয়েছে। বিলটিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ইতঃপূর্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি ও তৎকর্তৃক সম্পাদিত কার্যাবলি এবং উক্ত অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগের হেফাজত সংক্রান্ত বিধানও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিলটি আইনে পরিণত হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদান স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হবে, গণতন্ত্র সুসংহত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে এবং জনস্বার্থ সমুন্নত হবে মর্মে আশা করা যায়।
এসএম/টিটি