জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আচরণ বিধিমালা বদলে যাচ্ছে। প্রার্থীর প্রচারে পোস্টার ব্যবহার বাতিল করে শুধু কাপড়ের ব্যানার বহাল রাখা হচ্ছে। আচরণবিধিতে প্রথমবারের মতো যুক্ত করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার।
প্রস্তাবিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন আচরণ বিধিমালা, ২০২৫-এর খসড়ায় এসব বিধান রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, আগামী সংসদ নির্বাচন নতুন আচরণবিধিতে করতে চায় ইসি।
খসড়া অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার আচরণবিধিতে যুক্ত হলে ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালাতে পারবেন প্রার্থীরা। ভোট গ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা আগে সব ধরনের অনলাইন প্রচার বন্ধ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারে মানহানিকর প্রচার করলে ডিজিটাল বা সাইবার সুরক্ষা আইনের আওতায় শাস্তি হবে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন প্রস্তুতি, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও তদারকি এবং উপকারভোগী পর্যায়ে আলোচনাবিষয়ক কমিটি প্রস্তাবিত খসড়া নিয়ে একাধিক বৈঠক করেছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার আচরণ বিধিমালায় যুক্ত করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, খসড়া আচরণ বিধিমালার নির্বাচনী প্রচারের অংশে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে কোনো রাজনৈতিক দল, অন্য কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান প্রতীক বরাদ্দের আগে গণসংযোগ এবং ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার ছাড়া অন্য কোনো প্রকার প্রচার শুরু করতে পারবেন না। ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের ক্ষেত্রে প্রার্থী বা তাঁর এজেন্ট বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম, অ্যাকাউন্ট আইডি, ই-মেইল আইডি প্রচার শুরুর আগে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে। ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারে ব্যক্তিগত চরিত্র হনন করে কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি, কোনো ধরনের তিক্ত বা উসকানিমূলক বা মানহানিকর কিংবা লৈঙ্গিক, সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি দেওয়া, কনটেন্ট বানানো বা প্রচার করা যাবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারে বিধি লঙ্ঘন করলে ডিজিটাল বা সাইবার সুরক্ষা আইনের আওতায় শাস্তি হবে।
জানা যায়, খসড়া আচরণ বিধিমালায় সরকারি সুবিধাভোগী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকায় উপদেষ্টা ও তাঁদের সমমর্যাদার ব্যক্তিদের যুক্ত করা হয়েছে। তাঁরা হলেন প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী ও তাঁদের সমপদমর্যাদার কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসহ সমপর্যায়ের ব্যক্তি। ফলে তাঁরা নির্বাচনের সময় সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অনুকূলে অনুদান ঘোষণা বা বরাদ্দ বা অর্থ অবমুক্ত করতে পারবেন না। সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনী কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে পারবেন না।
আচরণ বিধিমালার খসড়ায় জাতীয় সংসদ ভেঙে যাওয়ার আগে ও পরের সময়কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। খসড়ায় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন থেকে তফসিল পর্যন্ত সময়কে ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’; তফসিল ঘোষণা থেকে ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশের সময়কে ‘নির্বাচনকালীন সময়’ এবং ফলাফলের গেজেট প্রকাশের পর থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত সময়কে ‘নির্বাচন-পরবর্তী সময়’ উল্লেখ করা হয়েছে।
২০০৮ সালে আচরণ বিধিমালা তৈরির সময় সংসদ ভেঙে যাওয়া থেকে নির্বাচনের পরবর্তী সময় পর্যন্ত পুরোটাকেই ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’ গণ্য করা হয়েছিল। তখন এই পুরো সময়েই আচরণ বিধিমালা কার্যকর থাকার বিধান ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে সংবিধান সংশোধনের পর তৎকালীন ইসি নির্বাচন-পূর্ব সময়ের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনে। প্রস্তাবিত খসড়া আচরণ বিধিমালায় আগের নিয়ম বহাল রাখা হয়েছে।
খসড়ায় প্রচারে পোস্টার বাতিল করে ব্যানার শব্দ রাখা হয়েছে। ব্যানারের অর্থ বোঝানো হয়েছে কাপড়ের তৈরি প্রচারপত্র। প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহৃত ব্যানার হবে সাদা-কালো ও আয়তন হবে অনধিক ৩ মিটার গুণ ১ মিটার। এতে শুধু প্রার্থীর ছবি ও প্রতীক ব্যবহার করা যাবে। তবে রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী হলে এর সঙ্গে দলীয় প্রধানের ছবি ব্যবহার করা যাবে। ব্যানারে কোনো অনুষ্ঠান, জনসভায় নেতৃত্বদান, প্রার্থনারত অবস্থার ছবি ব্যবহার করা যাবে না। প্রচারে লিফলেট ও হ্যান্ডবিল বিতরণ করা যাবে। তবে এসব প্রচারপত্রে পলিথিনের আবরণ বা প্লাস্টিক ব্যানার (পিবিসি ব্যানার) লেমিনেটিং ব্যবহার করা যাবে না। নির্বাচনী প্রচারে কোনো প্রকার স্থায়ী বা অস্থায়ী বিলবোর্ড ভূমি বা অন্য কোনো কাঠামো বা বৃক্ষ ইত্যাদিতে স্থাপন বা ব্যবহার করা যাবে না।
জনসভার দিন, সময় ও স্থানের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ন্যূনতম ৭২ ঘণ্টা আগে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। জনসভার কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা আগে স্থান ও সময় সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে জানাতে হবে। আগের আচরণবিধিতে শুধু ৪৮ ঘণ্টা আগে স্থান ও সময় সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষকে জানানোর নিয়ম ছিল।
খসড়া আচরণ বিধিমালায় আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের জন্য প্রার্থিতা বাতিলের বিধান যুক্ত হয়েছে। আরপিওতে এই ক্ষমতা ইসিকে দেওয়া হয়েছে। মাইক ব্যবহারের ক্ষেত্রে শব্দের মান ৬০ ডেসিবেল রাখার এবং বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়। প্রার্থীকে প্রতি সাত দিন পর পর নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব রিটার্নিং কর্মকর্তা বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারা ইসলাম সরকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, নির্বাচনী আচরণ বিধিমালায় কিছু সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এটি এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। আচরণ বিধিমালা সংশোধন নিয়ে কাজ চলছে।