জঙ্গিবাদ নির্মূলে সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন
জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলে সরকার ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। তারা মনে করেন দেশ থেকে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের দুষ্টচক্র রুখতে হলে সরকারকে যেমন অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে তেমনি আমাদের নাগরিক সমাজকেও একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
বুধবার (১৯ জানুয়ারি) একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে এক ভার্চ্যুয়াল আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংগঠনের সভাপতি লেখক সাংবাদিক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে আলোচ্য বিষয় ছিল: ‘জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি।
এ ছাড়া সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউটের সভাপতি নাট্যজন মুক্তিযোদ্ধা রামেন্দু মজুমদার, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম, নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি চলচ্চিত্রনির্মাতা নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ, প্রজন্ম’৭১-র সভাপতি শহীদ সন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, সর্ব ইউরোপীয় নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক যুক্তরাজ্যের মানবাধিকারকর্মী আনসার আহমদ উল্লাহ, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট লীনা পারভিন, নির্মূল কমিটির নিউইয়র্ক শাখার সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকারকর্মী স্বীকৃতি বড়ুয়া, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিটি, তুরস্ক-এর সাধারণ সম্পাদক লেখক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা শাকিল রেজা ইফতি, নির্মূল কমিটির বহুভাষিক সাময়িকী ‘জাগরণ’-এর হিন্দি বিভাগের সম্পাদক ভারতের সমাজকর্মী তাপস দাস, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল এবং বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শাখার নেতৃবৃন্দ।
সভাপতির বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি জঙ্গি মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ ও জাতিগঠনের অঙ্গীকার নিয়ে আমাদের আন্দোলন যাত্রা শুরু করেছিল আজ থেকে ৩০ বছর আগে। দীর্ঘ তিন দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আরম্ভের মাধ্যমে আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হলেও বাংলাদেশ থেকে আমরা মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘উপমহাদেশের দেশসমূহে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার উত্থান কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এক দেশে এর বিস্তার ঘটলে অন্য দেশেও তার অভিঘাত ঘটে। যে কারণে আমরা দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিক আন্দোলনসমূহের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। ৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতি অর্জনের পাশাপাশি ধর্ম ও জাতিসত্তার নামে বিভিন্ন দেশে চলমান গণহত্যা, গৃহযুদ্ধ ও ছায়াযুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত যেভাবে গঠন করতে চাইছি একইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যারা ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার জন্য সংগ্রাম করছেন তাদের সম্মিলনেরও বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। জঙ্গি মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস নির্মূলনে সরকার ও নাগরিক সমাজকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘নির্মূল কমিটির আন্দোলনের শুরু থেকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে অনেক কিছু আমাদেরকে দেখিয়ে যাচ্ছে। আমরা জঙ্গিবাদের বিষদাঁতগুলো ভেঙে দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছি। কিন্তু সম্পূর্ণ নির্মূল করতে পারিনি।
তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদ নির্মূলে আমরা আমাদের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পেয়েছিলাম। শিক্ষক, ছাত্রসমাজ ও জনতা সবাই জঙ্গিবাদ নির্মূলে আমাদের সহযোগিতা করেছিল। গত ৩০ বছরে নির্মূল কমিটি যে কাজ করেছে জঙ্গিবাদ দমনে তা আমাদের পাথেয় হয়ে আছে। নির্মূল কমিটি মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে ঘুরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। এতে সবাই সাড়া দিয়েছে। এমনকি মা তার ছেলেকে আমাদের কাছে ধরিয়ে দিয়েছেন, এ রকম ৮টি ঘটনা ঘটেছে। জঙ্গিরা নিহত হলে তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজন লাশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। কোন ধর্মেই সন্ত্রাসবাদ ও মানুষ হত্যার অনুমতি দেয় না। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সহযোগিতা আমাদেরকে জঙ্গিবাদ নির্মূলে সফলতা এনে দিয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে নির্মূল কমিটি জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ঘটনাগুলো জনগণের সামনে নিয়ে আসে, যা সরকারকে সহযোগিতা করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। আমরা জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ নির্মূল করতে না পারলেও তাদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দিয়েছি।’
ড. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে এ দেশকে স্বাধীন করেছিল। বঙ্গবন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেন বাহাত্তরের সংবিধানের মাধ্যমে। কিন্তু মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে এদেশে পুনরায় সাম্প্রদায়কতার অপরাজনীতি আরম্ভ করে। মৌলবাদীরা রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটানো থেকে শুরু করে শিক্ষা মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িকীকরণ করে যার ফলে দেশে ব্যাপকভাবে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটে। ’৭৫-এর পর বাংলাদেশে হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসা চালু হয়। বর্তমানে যার সংখ্যা প্রায় ৪৪ হাজার। মৌলবাদীরা নারীদের স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ করে তারা নানাভাবে ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে নারীদের স্বাধীনতা খর্ব করে। আমাদেরকে এদের বিস্তার যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করতে হবে।’
শুভেচ্ছা বক্তব্যে রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘ধর্মের নামে রাজনীতি বন্ধ না করা গেলে বাংলাদেশ কিছুতেই সামনের দিকে এগোতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধ ও ’৭২-এর সংবিধানের মাধ্যমে আমরা যে চেতনাকে নিয়ে এগিয়েছিলাম তা যদি অব্যাহত থাকত তবে বাংলাদেশ এতদিনে সারা বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থিত হতো। দেশ থেকে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের দুষ্টচক্র রুখতে হলে সরকারকে যেমন অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে তেমনি আমাদের নাগরিক সমাজকেও একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে বর্তমানে যে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা চলছে তা প্রতিরোধে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও একজোট হয়ে কাজ করতে হবে যেন রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ না ঘটে।
শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির কাছে নির্লজ্জ পরাজয়ের জন্য পাকিস্তানের কোন লজ্জা বা অনুশোচনা হয়নি বরং ওরা আরও বেশি বর্বরতা ও হিংস্রতার আশ্রয় নিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানের এই চক্রান্ত প্রকাশ করে ওদের মুখোশ উন্মোচন করা উচিত। দেশ বিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধীদের নাগরিকত্ব হরণ করা এখন সময়ে দাবী।'
এসএম/এমএমএ/