স্বল্প আয়ের আবাসনকে নীতি প্রণোদনা দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

স্বল্প আয়ের আবাসনকে নীতি প্রণোদনা দেওয়ার পাশাপাশি নাগরিক সুবিধা প্রদান করে সবার জন্য মানসম্মত আবাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) সংলাপে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শুক্রবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব বসতি দিবস উপলক্ষে আইপিডি আয়োজিত ‘ঢাকা মহানগরীতে সবার জন্য মানসম্মত আবাসন প্রেক্ষিত ও করণীয়’ শীর্ষক নগর সংলাপে এমন অভিমত ব্যক্ত করেন বিশেষজ্ঞরা।
সংলাপের মূল প্রবন্ধে আইপিডি’র পক্ষ থেকে নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঢাকার আবাসনের উপর ক্রমাগত চাপ ফেলেছে, যা একই সঙ্গে ঢাকামুখী অভিগমনেরও অন্যতম কারণ। আমাদের শিল্পায়ন-অর্থনীতি-বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে আবাসন পরিকল্পনার সংযোগ করতে পারিনি।
সংলাপের সূচনা বক্তব্যে আইপিডির পরিচালক ও শেলটেক কনসালটেন্টস লিমিটেডের প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, আবাসনকে শুধুমাত্র ‘থাকার জায়গা’ হিসেবে বিবেচনা না করে ব্যাপক অর্থে আবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পনা কৌশল নির্ধারণ করা উচিত। ফলে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুযায়ী কত উচ্চতার ভবন পাওয়া যাবে, সেই সংকীর্ণ আলোচনায় সীমাবদ্ধ না থেকে মানসম্মত আবাসন তৈরির প্রয়োজনীয় কর্মকৌশল নির্ধারণে আলোচনা ব্যাপৃত হওয়া উচিত।
আইপিডি’র উপদেষ্টা পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকার আবাসন চাহিদা ও যোগানের আলোচনায় প্রাধান্য পাওয়া উচিত মূলত নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবাসন সংকটের বিষয়টি। অথচ ড্যাপ নিয়ে ভবনের উচ্চতা কিংবা ‘এফএআর (ভূমির সাপেক্ষে ভবনের মোট মেঝের ক্ষেত্রফলের অনুপাত)’ সংক্রান্ত আলোচনার মূল কেন্দ্রে আছে উচ্চবিত্ত কিংবা উচ্চ মধ্যবিত্তরা।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষসহ অনেক সরকারি আবাসন প্রকল্পে খেলার মাঠ বা নাগরিক সুবিধাদির জন্য বরাদ্দকৃত জমিকে অবৈধভাবে প্লটে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, বৈশ্বিক শহরগুলোর তুলনায় ড্যাপে এফএআর মান তুলনামূলক বেশি দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানের শহরগুলোর তুলনা তুলে ধরেন তিনি। মালয়েশিয়াতে প্লটকেন্দ্রিক উন্নয়নকে নিরুৎসাহিত করে ব্লক ডেভেলপমেন্ট করে একদিকে যেমন উন্মুক্ত স্থান, নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে, পাশাপাশি নিম্নআয়ের লোকদের জন্য আবাসন ইউনিট তৈরি করা হয়েছে।
এবারের ড্যাপে এ ধরনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে দাবি করে আশরাফুল ইসলাম বলেন, আগের রুরাল সেটেলমেন্ট জোনসহ অনেক এলাকায় আগের চেয়ে বেশি উচ্চতার ভবন করার প্রস্তাবনাও আছে ড্যাপে। অসত্য তথ্য দিয়ে যারা ড্যাপকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাচ্ছে, সামগ্রিক জনস্বার্থের চেয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থেই কথা বলছেন তারা। মানসম্মত আবাসন ও বাসযোগ্য নগর গড়তে যেকোনো ভালো প্রস্তাবনা ড্যাপে আত্তীকরণ করার সুযোগ আছে বলে মন্তব্য করেন রাজউকের এই পরিকল্পনাবিদ।
আইপিডি’র পরিচালক পরিকল্পনাবিদ ড. চৌধুরী মো. জাবের সাদেক বলেন, ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে ৪০ শতাংশ লোক ঢাকা থেকে বের হয়ে যাবে বলে যে ধরনের মন্তব্য করা হচ্ছে তার সঙ্গে আবাসন ও পরিকল্পনাগত বাস্তবতার কোনো সংযোগ নেই। ঢাকা শহরের জন্য মানসম্মত আবাসন নিশ্চিতে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর যথাযথ সংস্কার ও পুনর্গঠন প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন এই বিশেষজ্ঞ।
আবাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শাম্মী আকতার সেতু বলেন, ২০১৬ সালের জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা অনুযায়ী ‘জাতীয় গৃহায়ন পরিষদ’ গঠিত হওয়ার কথা, কিন্তু অদ্যাবধি এই পরিষদ কার্যকর হয়নি, ফলে সবার জন্য আবাসন নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভবপর হয়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক ড. নীলোৎপল অদ্রি বলেন, দেশে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে সামাজিক আবাসনের কিছু উদ্যোগ চলমান আছে, তবে তার গতি বাড়াতে হবে ও নগর এলাকায় যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে যা জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালায়ও আছে। এ ছাড়া ‘পুনর্বাসন নীতিমালা (রিসেটেলমেন্ট প্ল্যান)’ করার মাধ্যমে যেকোনো প্রকল্প কিংবা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আবাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা বলেন, আবাসিক এলাকায় ও আবাসিক ভবনে আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত প্রবাহ ও সবুজায়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় যথাযথ প্রবিধান যুক্ত করতে হবে।
আরইউ/এসজি
