২ বছরেও ভ্যাকসিন উৎপাদনে যেতে পারেনি ইডিসিএল
দুই বছরেও ভ্যাকসিন তৈরির কারখানা নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরুই হয়নি। অতিমারি কোভিড-১৯ এর আঘাতের পর পরই ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়টি গুরুত্ত্বসহকারে বিবেচনায় নেয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিক মানের টিকা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার।
কিন্তু বার বার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগে নূন্যতম অগ্রগতি নেই। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তিনি বলেছেন, সরকারের বর্তমান মেয়াদ শেষ হতে আর কয়েক মাস বাকি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন তৈরির কাজে কোন অগ্রগতি নেই।
ভ্যাকসিন তৈরিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) কারখানাটির সক্ষমতাকে বিশেষ বিবেচনায় নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইডিসিএল সরকারের একমাত্র ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।
সেসময় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ভ্যাকসিন উৎপাদন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য দু'টি কমিটি গঠন করা হয়। একটি হচ্ছে কোভিড-১৯ প্রতিরোধী ভ্যাকসিন উৎপাদন উপদেষ্টা কমিটি। এই কমিটির উপদেষ্টা করা হয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রীকে। এ ছাড়া কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
এছাড়া ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে। এ ছাড়া সদস্য হিসেবে রয়েছেন- ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য) স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, আইইডিসিআর এর পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (এমএনসিএন্ডএএইচ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ডিন ড. আব্দুর রহমান, সদস্য সচিব এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
এর আগে বিজ্ঞানী ড. সনজন কুমার দাস পরামর্শ দেন, স্টীলের তৈরি অবকাঠামোর অভ্যন্তরে তৈরিকৃত ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা সম্ভব। একটি ফিল্ড এন্ড ফিনিস ল্যান্ড করতে ১০ হাজার বর্গফুট অবকাঠামো পর্যাপ্ত। ফিল এন্ড ফিনিস যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে ৩ থেকে ৬ মাস সময় প্রয়োজন হতে পারে।
এবিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, ইডিসিএল এ যে অবকাঠামো রয়েছে তা পরিবর্তন করে সেখানে ৬ মাসের মধ্যে ভ্যাকসিন তৈরির অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব এবং দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দক্ষ ছাত্র রয়েছে, যাদেরকে নিয়োজিত করে ভ্যাকসিন বোতলজাত করা যেতে পারে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভ্যাকসিন উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ হিসেবে সরকারকে কার্যকর ও নিরাপদ ভ্যাকসিন সরবরাহের জন্য ফেইস-১ ফরর্মুলেশন ফিল্ড ফিনিশিং এন্ড প্যাকেজিং ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ প্রকল্পে আরডিপিপি পুনরায় সংশোধন করে ভ্যাকসিন উৎপাদন ইউনিট অর্ন্তভুক্ত করে কাজটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ইডিসিএল এর পরিচালক বলেন, ভ্যাকসিন তৈরি এবং গবেষণা প্ল্যান্ট প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষে জমির মূল্যহার নির্ধারণের বিষয়টি চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে ৬টি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রস্তাবনা দাখিল করেছে, যা টেকনিক্যাল কমিটি কর্তৃক যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
আমেরিকান কোম্পানি ডার্টিক ইন্টারন্যাশনালের সাথে ভ্যাকসিনের কাঁচামাল আমদানির জন্য একটি সমঝোতা স্বাক্ষরের কার্যক্রমও প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
বিজ্ঞানী সনজন কুমার দাস বলেন, আমেরিকান কোম্পানি ভার্টিক ইন্টারন্যাশনাল, ভ্যাকসিনের কাঁচামাল অর্থাৎ প্রোটিন তৈরি করে এবং ভ্যাকসিন তৈরির লক্ষ্যে টেকনোলজি ডেভলপড করে থাকে।
তিনি আরও বলেন, হেপাটাইটিস ও করোনার বেশ কিছু ভ্যাকসিন প্রোটিন দিয়ে তৈরি হচ্ছে। আর প্রোটিন দিয়ে তৈরি ভ্যাকসিন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা সম্ভব। তাই আমেরিকান কোম্পানিটির সঙ্গে ভ্যাকসিন তৈরিতে কারিগরি সহায়তা ও ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল প্রোটিন সরবরাহের জন্য একটি সমঝোতা চুক্তি করার প্রক্রিয়াকে যথাযথ বলে মনে করেন তিনি।
এই বক্তব্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ভ্যাকসিনের কাঁচামাল প্রোটিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আমেরিকান কোম্পানি ভার্টিক ইন্টারন্যানালের শুধুমাত্র কাঁচামাল উৎপাদানের অভিজ্ঞতা থাকলেও তাদের ভ্যাকসিন উৎপাদনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা প্রয়োজন কি না সেটাও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, বাংলাদেশের পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক দিকগুলো বিচেনায় নিয়ে ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার। বিশেষ করে মাইনাস তাপমাত্রায় ভ্যাকসিন সংরক্ষণ এবং তা মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ প্রক্রিয়া অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। ভ্যাকসিনের কাঁচামাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভার্টিক ইন্টারন্যাশনালের সাথে সমঝোতা চুক্তি করার পাশাপাশি ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ১১ ধরনের ভ্যাকসিন বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে এবং এ খাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। কিন্তু গোপালগঞ্জে প্রস্তাবিত ভ্যাকসিন প্লান্ট তৈরি করা হলে ভবিষ্যতে সেখানেই সকল ধরনের ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বার বার তাগিদ দেওয়ার পরেও ভ্যাকসিন উৎপাদন কার্যক্রমে অগ্রগতি না দেখে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘আগামী নির্বাচনকালীন সময় বাদ দিলে বর্তমান সরকারের মেয়াদ আর মাত্র এক বছর বাকি আছে। তাই গোপালগঞ্জে ইডিসিএল কর্তৃক ভ্যাকসিন তৈরি এবং গবেষণা প্লান্ট প্রতিষ্ঠাপূর্বক এখান থেকে ১২ ধরণের ভ্যাকসিন উৎপাদন কার্যক্রম চলতি অর্থ-বছরের মধ্যে শুরু করার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি আরও বলেন, এই প্রতিষ্ঠান থেকে উৎপাদিত ভ্যাকসিন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করা সম্ভব হবে। যেহেতু প্লান্টটি করার ক্ষেত্রে অর্থের কোনো সমস্যা নেই, সেহেতু দ্রুত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে এর কার্যক্রম তরান্বিত করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেন। তিনি বাংলাদেশে উৎপাদিত অ্যাকসিন বিদেশে রপ্তানির লক্ষ্যে ড্রাগ রেগুলেটরি অথরিটির ম্যাচুরিটি লেভেল-৩ উন্নীত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
এসএম/এএস