‘আমি নেব ৩০০ ভেতরে দেব ১২০০’
রহিমা বেগম ও হাজেরা খাতুন (ছদ্ম নাম)। তারা দুজনেই যাবেন জর্ডান। তাই জরুরি ভিত্তিতে দুটি পাসপোর্টের জন্য পৃথক পৃথক ফাইল হাতে নিয়ে ঘুরছেন তারা।
পাসপোর্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তিকে দেখা যায়, রহিমা ও হাজেরার সঙ্গে কথা বলছেন। তারা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কানে কানে কথা বলছিলেন। ওই সময় ওই দুই নারী জরুরি ভিত্তিতে তাদের পাসপোর্ট করার কথা জানান ওই ব্যক্তিকে।
এক পর্যায়ে মধ্য বয়সী মামুন নামের ওই ব্যক্তি মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন কারও সঙ্গে। ওই পাশে কে আছেন চিনতে না পারলেও বোঝা যাচ্ছে পাসপোর্ট অফিসের কোনো কর্মকর্তা। তিনি বলছেন, ‘ভাই দুইটা ফাইল আছে নতুন। দুইটা ৫ হাজার টাকা নিছি। কাজটা করে দেন।’
তার এই কথার সূত্র ধরে রহিমা বেগম ও হাজেরা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, আমরা আজকেই পাসপোর্টের ফাইল পুরণ করেছি, আজকেই জমা দেব। দুই পাসপোর্টর জন্য ওনাকে ৫ হাজার টাকা দিয়েছি। ভেতরে শুধু জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে তার জন্য এই ৫ হাজার টাকা।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একটি খণ্ড চিত্র হচ্ছে এটি। রহিমা ও হাজেরাদের মতো বহু মানুষ প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এই পাসপোর্ট অফিসে ধরনা দিচ্ছেন পাসপোর্ট অফিসে দালালদের কাছে।
মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) ঢাকাপ্রকাশ-এর পক্ষ থেকে সরেজমিন আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে মানুষের ভোগান্তি, অনিয়ম, অর্থের লেনদেনসহ এমন অসংখ্য চিত্র পান ঢাকাপ্রকাশ-এর রিপোর্টাররা।
চাকরির জন্য বিদেশ যাওয়া, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানান কাজে পাসপোর্ট খুবই জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় সেবা। কিন্তু এই সেবা পেতেই মানুষের গলদঘর্ম অবস্থা। জরুরি এই সেবাটি পেতে পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তবে সেই ভোগান্তির একটা সহজ সমাধান হচ্ছে টাকা। পাসপোর্ট অফিসে টাকায় সব সমাধান পাওয়া যায়।
দুপুরে রনি নামে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় পাসপোর্ট অফিসের সামনে। তিনি পাসপোর্ট অফিসে দূতিয়ালির কাজ করেন। রনি নিজেই জিজ্ঞেস করেন পাসপোর্ট করাবেন নাকি? জবাবে হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন নতুন পাসপোর্ট নাকি নবায়ন। নবায়নের কথা শুনে রনির জবাব ১৫০০ টাকা দিলে আমি জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
রনির সঙ্গে দীর্ঘ আলাপের পর জানা যায় এই ১৫০০ টাকার ভাগ ভেতরের কর্তারাও পান। তিনি জানান, আপনার কাছ থেকে যে ১৫০০ টাকা নেব সেই টাকার ১২০০ টাকা দিতে হবে ভেতরে, আমি পাব মাত্র ৩০০ টাকা।
অনলাইনে পাসপোর্ট জমার তারিখ পেতে তো অনেক সময় লাগে। দুই মাস পরে তারিখ দেয়। তাহলে আপনি কিভাবে আজকে দেবেন? জানতে চাইলে রনি বলেন, ‘ডেট টেট কিছু নাই। তারিখ সব বুকড করা। আমরা টাকা দিয়ে তারিখ বুকড করে রেখেছি। আপনার টাকা নেওয়ার পর যদি কাজ না করতে পারি ডাবল টাকা জরিমানা দেব।’
তিনি বলেন, ‘সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারি যে সকল পাসপোর্ট সেগুলোর ব্যাংকে টাকা জমা দিলে আজকেই জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। আর যদি নরমাল হয় তাহলে কালকের তারিখে জমা দিতে পারবেন। কোন ঝামেলা হবে না।’
শুধু রনি না। এরকম আরও অন্তত ১০ থেকে ১২ জন আছেন যারা লাইনের পাশে এসে জানতে চাইছেন, ভাই পাসপোর্ট করাবেন? আপা পাসপোর্ট করাবেন? আজকেই জমার দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেব।
পাসপোর্ট অফিসের ভোগান্তি পদে পদে। মোস্তাক নামের এক যুবক সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারিতে টাকা জমা দিয়ে পাসপোর্ট নবায়ন করতে দিয়েছিলেন। তার বাড়ি রংপুর। মঙ্গলবার পাসপোর্ট অফিসের সামনে দেখা হয় মোস্তাকের সঙ্গে।
তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমি সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারিতে পাসপোর্ট নিতে ৮ হাজার ৬২৫ টাকা জমা দিয়েছি। আজ ২৩ আগস্ট ডেলিভারি ডেট। তথ্যকেন্দ্রে জানতে চাইলাম। তারা আমার রিসিট নিয়ে চেক করে লিখে দিলেন এসএমএস আসেনি। অর্থাৎ তার মোবাইল ফোনে পাসপোর্ট সংগ্রহের কোনো এসএমএস না যাওয়ায় নির্ধারিত তারিখে মেলেনি পাসপোর্ট।
মোস্তাক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমি রংপুর থেকে এসেছি। কারণ, সেখানে পাসপোর্ট সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারি হলেও ৯ দিন সময় লাগে। আমি কোরিয়া যাওয়ার জন্য ২৬ আগস্ট রেজিস্ট্রেশন করব। আজ বা কালকের মধ্যে পাসপোর্ট না পেলে রেজিস্ট্রেশন করা মুশকিল হয়ে যাবে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ূব চৌধুরী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আপনি তথ্য প্রমাণ দেন। আমার অফিসে যদি কেউ এই ধরণের কাজে জড়িত থাকে শাস্তি দেব। যে ব্যক্তি টাকা চেয়েছে তার ছবি ও বক্তব্য দিলে তাকে ধরে এর সঙ্গে কারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করব।’
এনএইচবি/এমএমএ/