একাত্তরের কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমদ আর নেই
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক সচিব, রাষ্ট্রদূত ও কলাম লেখক মহিউদ্দিন আহমদ মারা গেছেন। সোমবার (২০ জুন) সন্ধ্যায় ঢাকার উত্তরার বাসা শিউলিতলায় তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
মহিউদ্দিন হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে প্রবাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াইয়ে যোগ দেওয়া কূটনীতিকদের একজন। ইউরোপের দেশগুলোতে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনের কাজে যোগ দেন।
অবসরপ্রাপ্ত এই কূটনীতিক লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতা এবং ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। তিন সপ্তাহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পর চারদিন আগে মহিউদ্দিন আহমদকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
তার স্ত্রী বিলকিস মহিউদ্দিন সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, 'উনি আর নেই। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।' মহিউদ্দিন আহমদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মহিউদ্দিন লন্ডনে তৎকালীন পাকিস্তান হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন। ১ অগাস্ট ট্রাফালগার স্কয়ারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এক সমাবেশে তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করার ঘোষণা দেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন হয়েই দেশে ফেরার সময় ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি তাকে স্বাগত জানাতে হিথ্রোতে উপস্থিত ছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ।
পেশাদার কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমদের চাকরিজীবন ছিল নানা উত্থান পতনে ভরা। এইচএম এরশাদ সরকারের সময়ে তাকে পাঠানো হয়েছিল অন্য মন্ত্রণালয়ে। বঙ্গবন্ধুর ছবি রাখার ‘অপরাধে’ বিএনপি সরকার তাকে চাকরিচ্যুত করেছিল। পরে শেখ হাসিনা সরকারে এসে মহিউদ্দিন আহমদকে চাকরিতে ফেরান, সচিব হিসাবে পদোন্নতি দেন।
অবসরে যাওয়ার পর নিয়মিত কলাম লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ।
ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় নূরপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া মহিউদ্দিনের পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় বাবা আব্দুর রশিদ মাস্টারের প্রতিষ্ঠিত জিএম হাট স্কুলে। ফেনী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন।
১৯৬৪ সালে অনার্স পাসের পর মহিউদ্দিন আহমদ বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের বছর মাস্টার্স করে দেশে ফেরেন।
ফেনী কলেজের অর্থনীতির প্রভাষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করলেও বছরখানেক পর করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্সে যোগ দেন মহিউদ্দিন আহমদ। এরপর ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যোগ দেন পররাষ্ট্র দপ্তরে। এখান থেকেই তার কূটনৈতিক জীবন শুরু হয়।
১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়ে মহিউদ্দিন আহমদ ছিলেন লন্ডনে পাকিস্তান হাই কমিশনের দ্বিতীয় সচিব। এপ্রিলে মুজিবনগর সরকারের ‘অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ’ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে তার দেখা হয় লন্ডনে বিবিসি কার্যালয়ে। সেখানে তিনি বিচারপতির কাছে
পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করার বিষয়ে তার নিজের ইচ্ছার কথা জানালে বিচারপতি আবু সাঈদ তাকে আরও অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন। কিন্তু ১অগাস্ট ট্রাফালগার স্কয়ারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিশাল এক সমাবেশে উপস্থিত থেকে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করার ঘোষণা দেন মহিউদ্দিন আহমদ।
লন্ডন থেকে তার পোস্টিং হয় দিল্লি হাই কমিশনে। সেখানে দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর যান পোস্টিং হয় জেনিভায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর মহিউদ্দিনকে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর তাকে প্রথমে ইন্দোনেশিয়ায় ও পরে জেদ্দা মিশনে পাঠানো হয়। ১৯৮৫ সালের মে মাস থেকে ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।
এরশাদের আমলে মহিউদ্দিন আহমদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠদান হয়। এরপর পর পাঠানো হয় শিল্প মন্ত্রণালয়ে। এরশাদের পতনের পর আবার তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফেরত এনে দায়িত্ব দেওয়া হয় নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মিশনের উপ স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ছবি রাখার অপরাধে ১০ মাসের মাথায় তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে খালেদা জিয়ার সরকার এবং ফেব্রুয়ারি মাসে রিটায়ার্ড করিয়ে চাকরিচ্যুত করে।
চাকরিচ্যুতির পর তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আার পর তাকে সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে ফরেন সার্ভিস একাডেমির অধ্যক্ষ পদে পদায়ন করে। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে সচিব হিসেবেই সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধ, অর্থনীতি, পররাষ্ট্র নীতি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, দারিদ্র্য, উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে নিয়মিত কলাম লিখতেন।
মহিউদ্দিন আহমদ স্ত্রী ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন। মঙ্গলবার সকাল ৯টায় উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টর জামে মসজিদে তার প্রথম জানাজা হবে। সকাল সাড়ে ১০টায় ফরেইন সার্ভিস একাডেমিতেও আরেক দফা জানাজা হবে। এরপর তার কফিন নেওয়া হবে দীর্ঘদিনের কর্মস্থল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেখানে জানাজা ও গার্ড অব অনার দেওয়ার পর মহিউদ্দিন আহমদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে ফেনীর গ্রামের বাড়িতে। সেখানে আসরের পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী বিলকিস মহিউদ্দিন।
এনএইচবি/এএজেড