‘মেট্রোরেল চালু হলে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে’
মেট্রোরেল চালু হলে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছেন মেট্রোরেল ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘যানজটে প্রতি বছর ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ৩৪ হাজার কোটি ক্ষতি হচ্ছে। এমআরটি লাইন-৬ চালু হওয়ার পর যে ট্রাভেল টাইম বাঁচবে দেখা গেছে ৩৮ মিনিটে যেতে পারবে যে পথ যেতে লাগতো ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। তাতে পরিমাণ ভেহিক্যাল অপারেশন খরচ হতো এমআরটি লাইন-৬ চালু হলে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।’
বুধবার (১৫ জুন) দুপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এমআরটি লাইন-৬ (মেট্রোরেল) এর অগ্রগতি ও সম্ভাবনা শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় এসব কথা বলেন তিনি।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীর সভাপতিত্বে সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নান।
রাজধানীতে চলাচলের জন্য নিবদ্ধিত যানবাহনের সবশেষ পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে চলাচলের জন্য নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা সর্বশেষ ২০২২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ। এই যানবাহন ঢাকা মহানগরীতে চলাচল করার জন্য নিবন্ধিত। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ঢাকায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ৬ দশমিক ১২ কিলোমিটার গতিতে মানুষ যাতায়ত করতে পারে, এটা আস্তে আস্তে আরও বাড়ছে। বিভিন্ন স্টাডি থেকে দেখেছি ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা প্রতি বছরে যানজট এবং যানজটের প্রভাবে ক্ষতি হচ্ছে। এমআরটি লাইন চালু হওয়ার পর যে ট্রাভেল টাইম বাঁচবে যেখানে তিন থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা সময় লাগতো সেখানে ৩৮ মিনিটে যেতে পারবে। ফলে যে পরিমাণ ভেহিক্যাল অপারেশন খরচ তাতে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
তিনি বলেন, এমআরটি লাইন ঢাকার পূর্ব পশ্চিমে যাতায়ত অনেক সহায়ক হবে। ৬টি এমআরটি লাইন বাস্তবায়নে ২০৩০ সাল পর্যন্ত নির্ধারিত আছে সেভাবে কাজ চলছে। এমআরটি লাইন যখন বাস্তবায়ন শেষ হয়ে যাবে ২০৩০ সালে তখন প্রায় সাড়ে ৫০ লাখ যাত্রী এই এমআরটি লাইন দিয়ে যাতায়ত করতে পারবেন। যানজট নিরসনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, এমআরটি লাইন-৬ এই ডিসেম্বরে চালু করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। আগারগাঁও পর্যন্ত চালু করা হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনে বর্তমানে তিনটা পর্যায়ে কাজ হচ্ছে। প্রথম অংশের কাজ প্রায় ৯২ ভাগ শেষ করেছি। দ্বিতীয় অংশে ৮০ ভাগ এবং ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক কাজ ৮১ ভাগ হয়েছে। মতিঝিল পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি ৮০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের সব জায়গাতে ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ২০ ভাগ আমাদের হাতে আছে দিন রাতে করে যাচ্ছি। সেটিও দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।
ডিপোর অভ্যন্তরে প্রায় ১৯ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এমআরটি নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে হবে। সেজন্য বিভিন্ন উৎস থেকে বিদ্যুৎ নিয়েছি। অর্থাৎ ন্যাশনাল গ্রিড যদি ফেইল না করে এমআরটিতে কখনও বিদ্যুৎ ফেল করবে না। তারপরও নিজস্ব সিস্টেমেও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছি। যদি ন্যাশনাল গ্রিড ফেল করে তারপরেও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ট্রেনটা নিকটস্থ স্টেশনে পৌছাতে পারবো। ডিপোতে আর কোন কাজ বাকি নাই। ডিপোর প্যাকেজ ২০ জুন শেষ হবে। ভেতরে সামান্য একটু কাজ বাকি আছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট করার কথা ছিল সেটা পরিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। ৯ টা মেট্রো স্টেশনের ভেতরে কিছু কাজ দিনরাতে পুরোদমে চলছে। ৯টা স্টেশনের মধ্যে উত্তরা, উত্তর উত্তরা, দক্ষিণ এবং পল্লবী স্টেশনে গমন বর্হিগমন স্ট্রাকচার পুরোপুরি শেষ করেছি। বাকি ৫টার কাজ চলছে। ২/৩ মাসের ভেতর পুরো অংশের কাজ শেষ করতে পারবো।
মেট্রোরেলের গতি সম্পর্কে বলেন, এই ট্রেন বৈদুতিক সিস্টেমে চলবে। যে গতি দেওয়া আছে তাতে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার ডিজাইন করা তবে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে পারবে। সিগনালিং সিস্টেম যন্ত্র গুলো বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে এসেছি। এখানে ৫ জি তরঙ্গ ব্যবহার করবো। লিফট এবং স্কেলেটর উপরের দিকে শেষ করেছি। নিচের অংশ শেষের দিকে করবো। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল যেটা বলা হচ্ছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর সেটা নির্ধারিত সময়ের আগেই উদ্বোধন করা হবে। সব কাজ প্রায় ৮০ ভাগ কাজ শেষ করে ফেলেছি। এখন গমন বর্হিগমন কাজগুলো হচ্ছে। বাক কাজগুলো শেষ পর্যায়ে আছে। এরইমধ্যে ১৪ সেট মেট্রো টেন ডিপোতে এসে পৌঁছেছে। আরও দুইটা এখন শিপমেন্টের জন্য প্রক্রিয়াধিন আছে। আগারগাঁও পর্যন্ত চলাচলারে জন্য ১০ টা মেট্রো টেন হলে আমাদের কমফোর্টলি সিডিউল ঠিক রাখতে পারবো। এখন ট্রায়াল রান হবে যেটা যাত্রীবিহীন হবে এটা সম্পটন্ন করার পর ডিসেম্বর মাসে উদ্বেধনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে সরকার।
এমআরটি লাইন-৬ অর্থনৈতিক প্রভাব: রাজধানী ঢাকা সব কিছুর কেন্দ্র বিন্দু। এখান থেকে মোট জিডিপির ৩৬ শতাংশ অবদান রাখে। এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৫০ হাজার লোক বসবাস করে। এমআরটি লাইন-৬ চালু হলে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এই সাশ্রয়কৃত অর্থ এমআরটি লাইন-৬। আরও ৫টা লাইন যখন চালু হবে এই সাশ্রয়কৃত অর্থ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহার করতে পারবো। অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
সামাজিক প্রভাব:
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বিদেশে যারা কর্মরত আছেন তারা যেন বাংলাদেশে এসে যেন অনুভব করেন যে ওই দেশের মেট্রোরেলের চাইতে বাংলাদেশের মেট্রোরেল কোন অংশে কম না, আরও বেশি। শারীরিক প্রতিবন্ধী যারা আছেন তারা যেন যাতায়ত করতে পারেন সেজন্য যতগুলো সুবিধা দরকার উন্নত দেশের ন্যায় সেটা মেট্রো স্টেশন এবং ট্রেনের ভেতরে করা হয়েছে। মেট্রোরেলের একটা কোচ মহিলাদের জন্য নির্ধারিত থাকবে। এই কোচে মহিলারা যাতায়াত করতে পারবে। তবে অন্য কোচেও যাতায়াত করতে চাইলে তারা তা করতে পারবে। মেট্রো স্টেশনের প্লাটফর্মে মহিলাদের পৃথক বাথরুমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সেখানে বাচ্চাদের ডায়াপার পরানো এবং দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গর্ভবতী মহিলা এবং বয়স্করা যাতে যাতায়ত করতে পারে সেজন্য মেট্রো ট্রেনে মেট্রো স্টেশনে উঠা নামার বিষয়ে সব কিছুর ব্যবস্থা রাখা আছে। উঠা নামার তিনটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, সিঁড়ি, স্কেলেটর, লিফট।
পরিবেশগত প্রভাব: মেট্রো রেল যখন চলাচল করবে এখান থেকে শব্দ দূষণ করবে না। এটাকে আরও উন্নত করার জন্য বিভিন্ন স্থাপনের পাশ দিয়ে নিয়েছি। মেট্রো চালু হলে কম্পন সৃষ্টি হবে না। মেট্রো লাইনে দুই পারে শব্দ নিরোধ দেওয়াল করা হয়েছে। এখান থেকে শব্দ এবং কম্পোন দুষন হবে না। দৈনিক ৫০ লাখ যাত্রী এই নেটওয়ার্কে যাতায়াত করতে পারবেন। যানজট নিরসনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে মেট্রো রেল। কার্বন নি:র্সন কমাতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করবে। শুধু যদি এমআরটি লাইন-৬ চালু হয় তাহলে ২ লাখ ২ হাজার ৭২৬ টন কার্বণ নি:সরন হ্রাস হবে।
কর্মসংস্থান: তরুন প্রজন্মে কর্মসংস্থানে ভালো ভূমিকা রাখবে মেট্রোরেল। আমরা গড় হিসেব করে দেখেছি প্রতিটা লাইনে প্রায় ২ হাজার প্রকৌশলী মাঠ প্রকৌশলী এবং ম্যানেজমেন্ট কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। তাতে ৬ টা লাইন ধরলে ১২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।
ঢাকাবাসীকে মেট্রোরেলের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, মেট্রোরেল আসছে আপনারা প্রস্তুত হোন।
এসএম/