অ্যালকোহল উন্মুক্ত করার পক্ষে যা বললেন মন্ত্রী-এমপি
চোরাই পথে মাদক আনা ও কেনাবেচা বন্ধে অ্যালকোহল আমদানিতে ছাড় দেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন মন্ত্রী-এমপিসহ পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
মাদক কেনাবেচা বন্ধে বিকল্প পথ খুঁজে বের করারও পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত কর্মসূচিও তুলে ধরা হয়।
বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কার্যপত্র থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
কমিটির সভাপতি মো. শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটি সদস্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ অংশ গ্রহণ করেন।
বিষয়টির ওপর সুনির্দিষ্ট মতামত ও সুপারিশ চান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনির সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন। তিনি সংসদীয় কমিটির কাছে প্রস্তাব করে বলেন, ‘মাদক এবং অ্যালকোহল দুইটি ভিন্ন জিনিস। অ্যালকোহলের প্রতি কিছুটা ছাড় দিলে ড্রাগ সেবন কিছুটা কমতে পারে। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট মতামত ও সুপারিশ প্রয়োজন।'
পরে সে বিষয়ে নিজের মতামত তুলে ধরে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ বলেন জানান, বাংলাদেশে অ্যালকোহল উপর ৬০০ শতাংশ ট্যাক্স নির্ধারণ করা আছে। বাংলাদেশের সমস্ত ক্লাবে অ্যালকোহলের লাইসেন্স আছে। কিন্তু তারা কেউ আমদানি করে না কারণ, ট্যাক্স দিতে হয় বেশি। ক্লাবগুলো বেআইনীভাবে চোরাই পথে আসা মদ বিক্রি করে। যার কারণে দাম কম, ক্রেতাও বেশি। এতে করে সরকার প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাহলে মদ আমদানির উপর ট্যাক্স বৃদ্ধি করে কী লাভ হলো। আবার ট্যাক্স কমিয়ে দিলে অথবা মদ উম্মুক্ত করে দিলে ইসলামপন্থী বিভিন্ন দলগুলো আন্দোলনে নেমে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
এ বিষয়ে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম বলেন, মাদক নির্মূল করতে হলে কিছু নীতি পরিবর্তন করতে হবে। চোরাই পথে মদ ও বিয়ার ঢাকা শহরের সকল ক্লাবে বিক্রি হয়। ক্লাবগুলোর বৈধ লাইসেন্স রয়েছে আমদানি ও বিক্রয় করার জন্য। কিন্তু ট্যাক্স দিয়ে কেউ আমদানি করে না।
মুসলিম দেশ হিসেবে উম্মুক্তভাবে না হলেও কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিলে যুব সমাজকে মাদকাসক্ত থেকে কিছুটা কমিয়ে আনা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। ফেনসিডিল-ইয়াবা বন্ধে সীমান্ত এলাকায় অনেক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও ঠেকানো যাচ্ছে না বিধায় নতুন করে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, আমেরিকা ও কানাডায় গাঁজাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বাংলাদেশে মাদক কখনো বন্ধ করা যাবে না, তবে হয়তো কিছুদিনের জন্য কমিয়ে রাখা যেতে পারে। কারণ, মাদকের বিকল্প কিছু একটা সামনে নিয়ে আসতে হবে। তাই অ্যালকোহল, মদ, গাঁজা এগুলো সম্পর্কে আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, মদ, বিয়ার বা অ্যালকোহলের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে দিলে যদি রাজস্ব বৃদ্ধি পায় তাহলে তাই করা উচিত। ড্রাগ, আইস, ইয়াবা ও এলএসডি এগুলো ভয়াবহ ক্ষতিকর মাদক। কোনো মাদকে অ্যালকোহলের পরিমাণ ৫ শতাংশের নিচে থাকলে তা সরকারিভাবে বৈধ করা আছে। মদ, বিয়ার, গাঁজা ইত্যাদি মাদক যদি ৫ শতাংশের নিচে অ্যালকোহল থাকে তাহলে এগুলো বৈধ ঘোষণা করে দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। 'গিয়ার' নামে ড্রিঙ্কসে ৪ দশিমক ৯ শতাংশ দিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। তিনি যুব সমাজকে মাদকের নেশা থেকে বাঁচাতে এই সবকিছু বিবেচনা করার জন্য সরকারের নিকট অনুরোধ জানান।
সকলের মতামত শুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, মাদক বন্ধে সরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। যুব সমাজকে মাদক থেকে সরিয়ে আনতে হলে বিকল্প ব্যবস্থা অবশ্যই দরকার। তবে আমাদের বুঝতে হবে ক্ষতিকর ড্রাগ কোনটা? এলএসডি, ইয়াবা, হিরোইন এগুলো ক্ষতিকর বিধায় যারা সেবন করে তাদের ব্রেন ও লিভার দুই বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। তাই এগুলো থেকে যুব সমাজকে সরানোর উপায় খুঁজে বের করার বিকল্প কী আছে তা নিয়েও সরকার কাজ করছে বলে তিনি জানান। যমুনা গ্রুপের 'হান্টার' ড্রিংকসে ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ ঘোষণা দিয়ে পণ্য বাজারজাত করছে। সবগুলো বিষয়ের উপর সরকার সার্বিক বিবেচনা করেই পদক্ষেপ নেবে। এগুলোর দিকেও সরকার নজর রাখছে বলে তিনি জানান।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি শামসুল হক টুকু বলেন, অ্যালকোহল সেবন উন্মুক্ত করার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। অ্যালকোহল আমদানিতে ট্যাক্স কমানোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়া যায়। তবে সে সঙ্গে চোরাই পথে বা অবৈধপথে আমদানি হলে লাইসেন্স বাতিলসহ আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অ্যালকোহল কী পরিমাণ মাত্রায় সেবন করা যায় তার জন্য বিভিন্ন নীতিনির্ধারক এবং বিশেষজ্ঞ রয়েছে। ড্রাগ অর্থাৎ মাদক বলতে যেটা বুঝাচ্ছে সেটার কারণে দেশের তরুন সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তরুণ সমাজকে রক্ষা করার জন্যই মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকতে হবে। যে সকল মাদক সেবন করলে যুব সমাজ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে যেমন-ইয়াবা, এলএসডি, আইস, হেরোইন ইত্যাদি বন্ধ করার জন্য কঠোর হওয়ার অনুরোধ করেন।
পাঁচ শতাংশের নিচে অ্যালকোহল যুক্ত বেভারেজ/পানীয় যে সকল প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করছে, তাদের নির্দেশ দেওয়া দরকার যে, সে সকল বোতল বা ক্যান এ অবশ্যই দৃশ্যমান করে অ্যালকোহলের মাত্রা লিখে দিতে হবে। যাতে অনুমোদিত মাত্রার অ্যালকোহল নিশ্চিত হলেও কেউ অজান্তে অ্যালকোহল গ্রহণ করতে না পারে। নেশা জাতীয় ড্রাগ, ইয়াবা যারা অবৈধভাবে দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসছে, যারা বহন করছে, যারা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের এবং দ্রুততম সময়ে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন হলে আইনও সংশোধন করা দরকার। চোরাই পথে মাদকের প্রবেশ ঠেকাতে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। পুলিশের হাতে ইয়াবা ধরা পড়লে বিজিবি'র উপর কিছুটা হলেও দায় এসে যায়। হয়তো কিছু চেক পয়েন্টে আরো সতর্ক থাকার দরকার ছিল, তেমনি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও আরও তৎপর থাকলে ইয়াবার প্রবেশ ঠেকানো যেত। অর্থাৎ সবগুলো সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। মাদকের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে না পারলে দায় সবার।
সংসদ সদস্য বেগম রুমানা আলী বলেন, যে সকল মাদক হালকা ক্ষতিকর সেগুলোর ব্যবহার উন্মুক্ত করা যেতে পারে এবং যেগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে ক্ষতি হয় সেগুলোকে অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়।
এসএম/এমএমএ/