নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিল্ডের সেমিনারে নানাবিধ সুপারিশ
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রক্রিয়া সহজীকরণে ‘ডিসিমিনেশন সেমিনার অন পলিসি রিকমেন্ডেশনস টু মেক ট্রেডিং অ্যাক্রস বর্ডার ইজিয়ার ফর উইমেন-ওনড বিজনেসেস’ শীর্ষক সেমিনার আয়োজন করেছে বেসরকারি খাতের থিংকট্যাঙ্ক বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি)।
সোমবার (৬ জুন) তারিখে বিল্ড ও আইএফসির যৌথ উদ্যোগে ঢাকায় এ সেমিনার আয়োজিত হয়।
বাংলাদেশে সামগ্রিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিস্থিতি নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশের নারী উদ্যোক্তারা পুরুষদের তুলনায় বেশি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। এর প্রধান কারণগুলো হলো, আমদানি-রফতানি নীতিমালা ও প্রক্রিয়া সংক্রান্ত জ্ঞানের স্বল্পতা, তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে সীমিত জ্ঞান ও সেবপ্রদানকারী সংস্থা সম্পর্কে কম জানা।
নারী উদ্যোক্তাদের এসব সমস্যা নিরসণে যুক্তরাজ্য সরকারের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) সহায়তায় পরিচালিত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট ফান্ড ২ (বিআইসিএফ ২) প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বাণিজ্য প্রক্রিয়ার উপর ১৪টি ভার্চ্যুয়াল ওরিয়েন্টেশন ও সচেতনতামূলক কর্মশালা আয়োজন করেছে বিল্ড ও আইএফসি।
এসব কর্মশালার মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদেরকে সাধারণ ব্যবসায় প্রক্রিয়া, সরকার প্রদত্ত বাণিজ্য সংক্রান্ত অনলাইন ও ম্যানুয়াল সেবা, বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনার নিয়ম ও বিধিমালা এবং সরকার ঘোষিত বিভিন্ন নীতি সহায়তার উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। কর্মশালাগুলোর মাধ্যমে প্রকল্পটি প্রায় ২৭ হাজার নারী উদ্যোক্তা, সরকারি প্রতিনিধি, স্টার্ট-আপ ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে।
কর্মশালা চলাকালে নারী উদ্যোক্তারা তাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যাগুলোর কথা জানিয়েছেন, যার ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে এবং এসব সমস্যা নিরসণে এতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হাজির করা হয়েছে। আজকের সেমিনারে নারী উদ্যোক্তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ ও এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বেশকিছু সুপারিশ সংশ্লিষ্টদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।
কর্মশালা চলাকালে নারী উদ্যোক্তারা প্রধান যেসব প্রতিবন্ধকতার বিষয় তুলে ধরেছেন তার মধ্যে রয়েছে: ব্যবসায় আনুষ্ঠানিকীকরণ (প্রথাগত ও ই-কমার্স), ট্রেড লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় জটিলতা ও ট্রেড লাইসেন্স নবায়নে উচ্চ ফি, কোলেটারালমুক্ত ঋণ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ প্রাপ্তি, কার্যকর বাজারজাতকরণ ও ব্র্যান্ডিংয়ে যথাযথ জ্ঞানের অভাব এবং কভিড-১৯ এর প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে ঘুরে দাঁড়ানো এবং সরকার ঘোষিত প্রণোদনাসমূহ থেকে সহায়তা প্রাপ্তিতে সমস্যা।
নারী উদ্যোক্তারা আরও যেসব সমস্যার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে, অপর্যাপ্ত সরবরাহ চ্যানেল, বাণিজ্য সহজীকরণে সমন্বিত প্লাটফর্মের অভাব, টিআইএন বা ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন ও রিটার্ন জমা সংক্রান্ত জ্ঞানের স্বল্পতা, চাহিদা-ভিত্তিক প্রশিক্ষণ সুবিধা যেমন মার্কেটিং বা ডিজিটাল প্লাটফর্মের উপর প্রশিক্ষণের অভাব, একটি আঞ্চলিক কার্গো ফ্লাইট সুবিধার অভাব, আইআরসি ও ইআরসি অনলাইন আবেদন সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাব, অনলাইন-ভিত্তিক ব্যবসায়ের জন্য ট্রেড লাইসেন্সের আবেদন প্রক্রিয়ার জটিলতা ও বাৎসরিক বাণিজ্য মেলার তথ্যের ঘাটতি।
এ ছাড়া আরও যেসব সমস্যার কথা উঠে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে: উচ্চ নিবন্ধন ফি, দেশে ও দেশের বাইরে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দুর্বল যোগাযোগ, কাঁচামালের প্রাপ্যতা ও নারী উদ্যোক্তাদের দ্বারা উৎপাদিত অপ্রথাগত পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ে ঘাটতি।
মূল উপস্থাপনায় বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম তিনটি বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরেন। সেগুলো হলো: ট্রেড লাইসেন্স, অর্থায়ন সুবিধা প্রাপ্তি ও তথ্য ঘাটতি। উপস্থাপনায় ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুর প্রক্রিয়া সহজীকরণের সুপারিশ করা হয় এবং কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের অনুকরণে তা সম্পূর্ণ অনলাইনের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব করা হয়।
স্বাগত বক্তব্যে বিল্ডের চেয়ারপারসন নিহাদ কবির বলেন, বিভিন্ন খাতে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু রফতানি, আমদানি, বিভিন্ন নিবন্ধন প্রক্রিয়া ও অনলাইন সেবা সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে রয়েছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্ল্যানিং কমিশনের সম্মানিত সদস্য (সচিব) শরিফা খান বলেন, সংকটই উদ্যোক্তাদের জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ। তিনি জানান, জেলাভিত্তিক পণ্য কখনোই সাসটেইন করবে না। এক জেলা এক পণ্য কখনোই টেকসই হবে না।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে হাফিজুর রহমান, মহাপরিচালক, ডব্লিউটিও সেল এবং সদস্য সচিব, ন্যাশনাল ট্রেড ফ্যাসিলেটেশন কমিটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বলেন, ই-কমার্সে নারীরা এগিয়ে, এটি জেন্ডার-নিউট্রাল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ই-কমার্স প্রশিক্ষণে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ৪০ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা করেছে। বর্তমানে আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচেছ এবং ইতিপূর্বে কৃষির উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তবে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হলো ট্রেড লাইসেন্স ও ব্যাংক ঋণ। ট্রেড লাইসেন্স সহজীকরণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ট্রেড লাইসেন্সের উদ্দেশ্য ছিল রাজসম্ব আহরণ। এটি অনলাইন হয়ে গেলে অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ক্রস বর্ডার ট্রেড করতে হলে ডিএসএল খরচ বা কাস্টমস প্রসিডিউর সংক্রান্ত বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হন। এক্ষেত্রেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ওয়্যারহাউজের সুবিধা চালু করা যেতে পারে। ই-ক্যাব এ নিয়ে বর্তমানে কাজ করছে। তিনি জানান, পুরুষ উদ্যোক্তাদের চেয়ে নারী উদ্যোক্তারা বেশি এগিয়ে আছেন। সমস্যা হলো তথ্য প্রাপ্তিতে সমস্যা। নারী উদ্যোক্তারা তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। এ বিষয়ে কিভাবে তাদের সহায়তা করা যায় সে বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
নাহিদা ফরিদি, এডিসি, কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট (ঢাকা পূর্ব), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বলেন, ভ্যাট রিটার্ন যথা জমা না দেয়া ১০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করার রিটার্ন বেড়েছে। নারীদের বিষয়টি এখানে পুনির্বিবেচনার জন্য বলবো। ট্যাক্স লিটারেসি হার নারীদের মধ্যে অনেক কম। নারী উদ্যোক্তা বলতে কি বোঝায় নারী উদ্যোক্তাদের অনেকে তা জানেন না। তাদেরকে এসব বিষয়ে জানানো আমাদের দায়িত্ব। এজেন্ট মাধ্যমে না গিয়ে ভ্যাট-ট্যাক্স নিজেরা জমা দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে অনেক ঝামেলা কমে আসবে।
আইএফসির ট্রেড কম্পিটিটিভনেস ফর এক্সপোর্ট ডাইভারসিফিকেশন প্রজেক্টের টাস্ক টিম লিডার নুসরাত নাহিদ ববি তার বক্তব্যে প্রকল্পের উদ্দেশ্য সবার কাছে তুলে ধরেন। তিনি জানান, এ প্রকল্পের শুরুতেই একটি বিল্ডের সহায়তায় একটি বেজলাইন স্টাডি পরিচালনা করা হয়। তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রিক কিছু সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তারা সমসস্যার সম্মুখীন না হলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। এ সমস্যাগুলো আপাতদৃষ্টিতে খুবই সাধারণ মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে এগুলো নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। তিনি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিল্ড পরিচালিত কর্মশালাগুলোর প্রশংসা করে জানান, নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে এ ধরনের কর্মশালা চলমান থাকা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক জাকির হোসেন জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত নীতি প্রণয়ণের কাজ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময় নীতি প্রণয়ণের ক্ষেত্রে নারীদের বিবেচনায় নিয়ে থাকে। তিনি বলেন, ব্যাংকারদের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড় গ্রাহকদের বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তিনি জানান, ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজে নারী উদ্যোক্তাদের ৮ শতাংশ সুনির্দিষ্ট করা হয়েছিল। এছাড়া আরো বেশকিছু তহবিলে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রয়েছে। এসএমই ঋণের ১৫ শতাংশ নারী উদ্যেক্তাদের জন্য বরাদ্দ। এছাড়া মার্কেটের ঋণ স্থিতির ২৫ শতাংশ সিএমএসএমইদের জন্য বরাদ্দ এবং এর ১৫ শতাংশ বরাদ্দ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য।
এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক নাদিয়া বিনতে আমিন জানান, ভ্যাট রিটার্ন মান্থলি বেসিসে দিতে হয়। ঠিকমত জমা দিতে না পারলে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ, তাদের মুনাফা সীমিত।
তা ছাড়া এটি বছর ভিত্তিক করা যেতে পারে। তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকে নারীদের জন্য ডেডিকেটেড ডেস্ক নেই। কমার্শিয়াল ব্যাংক ৪৫ লাখ টাকা লোন দিতে কোলেটারাল নিচ্ছে ৩৫ টাকা।
বিজিএমইএর পরিচালক শেহরিন সালাম ঐশী বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ব্যবসায় ক্ষেত্রে নারীদের পৃথকভাবে বিবেচনা করতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংকে ডেডিকেটেড ডেস্ক নেই। বন্ড রিনিউয়ালের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। বিভিন্ন নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ধাপগুলোকে কমিয়ে আনা দরকার।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক কুমকুম সুলতানা বলেন, বাণিজ্য মেলাগুলোতে অংশগ্রহণনের জন্য প্রতি বছর ২৬ টা প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়ে থাকে। এসব মেলায় প্রশিক্ষণে নারীদেরকে আমরা ব্যাপক হাতে দেখতে চাই। ওয়ারেসা খানম প্রীতি, সভাপতি, হার ই ট্রেড, বলেন, ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন। এসব সমস্যা দ্রুত নিরসণ করা প্রয়োজন।
এমএমএ/