জাফর ইকবালের প্রতিক্রিয়া
ছেলেটা সারা জীবন জেলখানায় কাটাবে। অথচ...
হামলাকারী ফয়জুল হাসানের প্রতি নয়, বরং যারা তাকে ভুল বুঝিয়ে ভুল পথে ঠেলে দিয়েছে, তাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তাকে হত্যাচেষ্টা মামলার রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে জাফর ইকবাল সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘ওই ছেলেটার (ফয়জুল হাসান) ওপরে আমার কোনো রাগ নেই। কাজেই তার শাস্তি হয়েছে, সে জন্য আমি আনন্দিত, এ ধরনের কোনো ফিলিংস আমার ভেতরে নেই। বরং বলা যেতে পারে, তার প্রতি আমার করুণা আছে, মায়া আছে।’
তিনি বলেন, ‘ওরা এমনই মানুষ, সে জানে যে আমাকে কিংবা আমার মতো একজনকে মার্ডার (খুন) করলে বেহেশতে যাবে। এ ধরনের একটা জীবন থাকার তো কোনো মানে হয় না। এ ধরনের একটা বিশ্বাস নিয়ে থাকার মানে হয় না। যারা এই ছেলেগুলোকে (ফয়জুল) এ ধরনের বিশ্বাসে নিয়ে এসেছে, এ ধরনের একটা অন্যায় করার জন্য, ওদের প্রতি আমার ক্ষোভ আছে। এটা কেমন করে সম্ভব যে মানুষ ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এ ধরনের ছেলেদের ভুল রাস্তায় ঠেলে দিচ্ছে। এখন এই ছেলেটা সারা জীবন জেলখানায় কাটাবে। অথচ যারা তাকে বুঝিয়ে এসব কাজের জন্য নামিয়ে দিয়েছে, তাদের কিছুই হবে না। এ নিয়ে আমার ভেতরে ক্ষোভ আছে।’
জাফর ইকবাল বলেন, ‘ছেলেটাকে (ফয়জুল হাসানকে) যারা ব্রেনওয়াশ করে ভুল পথে নিয়ে এসেছে, তারা আড়ালে থাকছে, তারা চিহ্নিত হচ্ছে না। অথচ মাঝপথে একটা ছেলের সারা জীবন নষ্ট হয়ে গেল।’
মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) দুপুরে সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুহাম্মদ নূরুল আমীন বিপ্লব এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আসামি ফয়জুল হাসানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ফয়জুল হাসানের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের কালিয়ারকাপন গ্রামে। মামলায় ফয়জুলের বন্ধু সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের উমেদনগর গ্রামের মো. সোহাগ মিয়াকে চার বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া বাকি চার আসামি ফয়জুলের বাবা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফয়জুল হক ও ভাই এনামুল হাসানকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালিয়ে যেসব লেখক মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীলতার পক্ষে থাকেন, তাদের ভয় দেখানোই ছিল ফয়জুলের মূল উদ্দেশ্য। হামলার ঘটনাটিকে ‘ধর্মীয় সন্ত্রাস’ উল্লেখ করে আদালত বলেন, ইসলাম ধর্মের প্রকৃত মর্মবাণীকে না বুঝে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করা পুণ্যের কাজ মনে করে আসামি এই বর্বর হামলা চালিয়েছেন।
আসামি সম্পর্কে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ফয়জুল হাসান দেশি বা কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য—এমনটা প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু তিনি বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট থেকে জিহাদি প্রবন্ধ ও বই ডাউনলোড করে পড়ে, উগ্রবাদী বক্তাদের বক্তব্য শুনে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ হন। কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কৌশলে ভার্চ্যুয়াল জগতে উগ্রবাদী মতবাদ ছড়িয়ে সহজে বেহেশতে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ প্রাণে সন্ত্রাসবাদের বীজ বপন করছে। উচ্চশিক্ষিত ও প্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণেরা সহজেই তাদের পাতানো ফাঁদে পা দিচ্ছেন।
২০১৮ সালের ৩ মার্চ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যান্ডবল গ্রাউন্ডসংলগ্ন মুক্তমঞ্চে এক অনুষ্ঠান চলাকালে মঞ্চে বসা অধ্যাপক জাফর ইকবালকে পেছন থেকে মাথায় ছুরিকাঘাত করে মো. ফয়জুল হাসান। হামলার ঘটনায় শিক্ষার্থী ও পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থল থেকে ফয়জুল হাসানকে আটক করেন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর থেকে জাফর ইকবাল ঢাকায় বসবাস করছেন।
এপি/