পুলিশ ভেরিফিকেশনে অর্থ দাবি করলে ব্যবস্থা
বিদেশে যাওয়াসহ বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজনে পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়। দেশের বাইরে যে কারো পরিচয়ের দলিল হিসেবেও ব্যবহৃত হয় তার পাসপোর্ট। এই পাসপোর্ট হাতে পেতে বেশ কয়েকটি ধাপ পার হতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে পুলিশ ভেরিফিকেশন। তবে অনিয়ম-দুর্নীতি, ঘুষ-বাণিজ্য এসবের কারণে পুলিশ ভেরিফিকেশনের এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভেরিফিকেশনের প্রক্রিয়ায় পাসপোর্টের সেবা গ্রহীতারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে।
পাসপোর্টের আবেদনের পর পাসপোর্ট অফিসের প্রাথমিক কাজ শেষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির তথ্য যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হয় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) কিংবা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট শাখার কিংবা থানার একজন উপসহকারী পরিদর্শক (এএসআই), সহকারী পরিদর্শক (সাব ইন্সপেক্টর) কিংবা পরিদর্শককে (ইন্সপেক্টর) তথ্য যাচাইয়ের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্ত কর্মকর্তা তথ্য যাচাই-বাছাই করে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে পাসপোর্ট অফিসে যে প্রতিবেদন পাঠান সেটাই ‘পুলিশ ভেরিফিকেশ’ হিসেবে পরিচিত।
এদিকে, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স প্রদানে ভেরিফিকেশন তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আবেদনকারীর বাসায় না যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।
আবেদনকারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা আছে কিনা তা পুলিশের ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএমএস) থেকে পরখ করে দ্রুততম সময়ে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দিতে বলেছেন তিনি।
সোমবার (১৮ এপ্রিল) ডিএমপি সদর দফতরে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় এ সব নির্দেশনা দেন ডিএমপি কমিশনার। ওই আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকা এক উপ-পুলিশ (ডিসি) কমিশনার এ সব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আলোচনা সভায় ডিএমপি কশিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, ডিএমপির অর্ধশত থানার মধ্যে কোনো কোনো ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দিতে কতদিন সময় নিচ্ছেন সদর দফতর থেকে সেই বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার বিনিময়ে কোনো পুলিশ সদস্য অর্থ দাবি করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন পুলিশ কমিশনার।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেতে আবেদন জানানোর পর তার নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাই করেন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবেদনকারীর কাছ থেকে উৎকোচ দাবি করেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কমকর্তা। বিদেশ গমন এবং সরকারি-বেসরকারি চাকরির জন্য কিংবা অন্যান্য কাজে অনেক সময় পুলিশ ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হয় বলে আবেদনকারীরা অনেকটা বাধ্য হয়ে উৎকোচ দেন।
ডিএমপির একজন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। যদিও পাসপোর্ট ইস্যুর সময় নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাই করে থাকে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)। পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পুলিশের অর্থ বা উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো পাসপোর্ট তৈরিতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ তোলেন। এ সব কারণে এই ভেরিফিকেশন বন্ধ করা যায় কিনা সেই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি আলোচনা সভায় বাংলাদেশ জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর মহাপরিচালক শহীদুল ইসলাম বলেছেন, পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা নেই। কেন এই হয়রানির শিকার হতে হবে।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, পুলিশের বিশেষ শাখায় ইমিগ্রেশনের পর ভেরিফিকেশন শাখাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়। কারণ এই শাখার কর্মকর্তারা ভেরিফিকেশনের বিনিময়ে উৎকোচ গ্রহণের সুযোগ পান। ভুক্তভোগীরা জানান, উৎকোচ ছাড়া পাসপোর্টের ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়েছে এমন ব্যক্তি পাওয়া দুষ্কর।
জানা যায়, পুলিশের বিশেষ শাখায় পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনের দায়িত্ব নিতে রীতিমতো তদবির করেন উপ-পরিদর্শন পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। দিনে একাধিক পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন করতে পারলে কয়েক হাজার টাকা আয় হয় বলে এসআই পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই শাখাকে একটু বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবির) একজন কর্মকর্তা জানান, পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনসহ যেকোনো আইনি সহায়তার বিনিময়ে অর্থ দাবির বিষয়ে কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। তার দাবি, আগের চেয়ে বর্তমান অবস্থার অনেকটা উন্নতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আগে ভেরিফিকেশনের সময় অর্থ নেওয়ার যে কালিমা পুলিশের উপর ছিল, সেটা এখনও বহন করতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, পাসপোর্টসহ অন্যান্য প্রয়োজনে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য আবেদনকারীরা তদন্ত কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোনে সব জানতে পারবেন। একই সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তাও (যিনি তথ্য যাচাই করবেন) জেনে যাবেন তার কাছে আসা আবেদনকারীর মোবাইল নম্বরসহ অন্যান্য তথ্য। কাজেই হয়রানির কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, যদি ঢাকা জেলার কোনো পুলিশের সদস্য পাসপোর্ট বা অন্যান্য পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ক্ষেত্রে ঝামেলা করে তথ্য প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেএম/আরএ/