কমছে সচেতনতা, বাড়ছে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা
গরমের সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। বিশেষ করে রাজধানীতে প্রতি মুহূর্তেই বাড়ছে ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা। দু-সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) মহাখালীর হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর সংখ্যা।
এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রোজা ও গরমে বাড়তে পারে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা। এজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। মানুষ যদি সচেতন থাকে তাহলে ডায়রিয়া রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
মাত্র ১৩ দিনে হাসপাতালটিতে ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের ভর্তির সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ররিবার (৩ এপ্রিল) আইসিডিডিআরবি হাসপাটালের একটি সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা জানান, গত মাসের ২১ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এ ১০ দিনে এ হাসপাতালে ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেয়। ১ এপ্রিল থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত এর সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৫ হাজরে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, রাজধানীর মহাখালী বস্তি, ভাষানটেক বস্তি, তেজগাঁও, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, শনির আখড়া, মানিকনগর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, কড়াইল, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও ঢাকা বিভাগের মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর থেকেও প্রতিদিন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী আসছে।
হাসপাতাল কতৃপক্ষ জানিয়েছেন, বেশিরভাগ রোগী আসছে নারায়ণগঞ্জ সদরের পাইকপাড়া, জলারপাড়, বাবুরাইল, নিতাইগঞ্জ, নয়াবাজারসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকা থেকে।
গতকাল ২ এপ্রিল, আইসিডিডিআরবিতে ২৪ ঘণ্টায় ১২৭৪ জন ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।
আইসিডিডিআরবি সূত্রে জানা যায়, গত মাসের ১৬ মার্চ ১ হাজার ৫৭ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৭ মার্চ ভর্তি হন ১ হাজার ১৪১ জন, ১৮ মার্চ ১ হাজার ১৭৪, ১৯ মার্চ ১ হাজার ১৩৫, ২০ মার্চ ১ হাজার ১৫৭, ২১ মার্চ ১ হাজার ২১৬, ২২ মার্চ ১ হাজার ২৭২, ২৩ মার্চ ১ হাজার ২৩৩, ২৪ মার্চ ১ হাজার ১৭৬, ২৫ মার্চ ১ হাজার ১৩৮, ২৬ মার্চ ১ হাজার ২৪৫, ২৭ মার্চ ১ হাজার ২৩০, ২৮ মার্চ ১ হাজার ৩৩৪, ২৯ মার্চ ১ হাজার ৩১৭, ৩০ মার্চ ১ হাজার ৩৩১ এবং ৩১ মার্চ ১ হাজার ২৮৫ জন। পরে এর সংখ্যা অনেক বেড়েছে বলে মনে করছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা।
চিকিৎসকরা বলছেন, গ্রীষ্মকালের গরমের শুরুতে বরাবরের মতোই ডায়রিয়া এবং কলেরার রোগী বেশি ভর্তি হয় হাসপাতালে। তবে অন্যান্যবারের তুলনায় এবার রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি।
এ বিষয়ে আইসিডিডিআরবি হাসপাতাল ঢাকার সহকারী বিজ্ঞানী শহিদুল ইসলাম বলেন, এবারের রোগীর সংখ্যা অন্য বছরগুলোর তুলনায় স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি। তবে এটা খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। প্রতি বছর মার্চ, এপ্রিল, মে এবং আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে রোগীর চাপ বাড়ে। অন্যান্য বছর দৈনিক গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ রোগী ভর্তি হতো, এবার সংখ্যাটা একটু বেশি হচ্ছে।
তিনি বলেন, করোনায় অনেকেই ঘরে ছিলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেন এবং নিয়মিত হাত ধুতেন। এখন যেহেতু করোনা কমে গেছে, মানুষ বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন, বাইরের খাবার খাচ্ছেন। আমাদের মনে হচ্ছে, মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা কমে গেছে, তাই ডাইরিয়া আক্রান্ত বেশি হচ্ছেন।
সবাইকে খাবার আগে ও পরে হাত ধোয়া, নিরাপদ ফোটানো পানি পান করা এবং বাইরের খোলা খাবার না খাওয়ার পরামর্শও দেন বিজ্ঞানী শহিদুল ইসলাম।
এদিকে মহাখালীর আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে গিয়ে রোগীর ভিড় লক্ষ করা গেছে। রোগীর চাপ সামলাতে অস্থায়ী তাঁবুর ব্যবস্থা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
অনিরাপদ পানি পানের ফলে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, রাজধানীতে বেশিরভাগ এলাকার পানিই ফুটিয়ে পান করতে হয়। ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করে তা শতভাগ নিরাপদ নয়। ফলে এ পানি ফিল্টার করে অথবা ফুটিয়ে পান করার বিকল্প নেই। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সিলিন্ডার গ্যাসে পানি ফুটিয়ে খাওয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা দেখা গেছে।
আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম জানান, বর্তমানে যেসব রোগী আসছেন তারা চরম মাত্রার পানিশূন্যতায় ভুগছে। আমরা রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পানিশূন্যতা পূরণ করার ব্যবস্থা নেই। কিছু সময় দেরি হলেই দেখা যায়, রোগীর জীবন বাঁচানো কষ্টের হয়ে যায়। যারাই আসছে তাদের পানীয়জল বিশুদ্ধ ছিল না বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে ৬০-৭০ শতাংশ রোগীই প্রাপ্তবয়স্ক। মধ্যবয়স্ক, যুবক ও বৃদ্ধদের পাওয়া যাচ্ছে বেশি।
এ চিকিৎসক জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সংজ্ঞা অনুযায়ী ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে তীব্র পানিশূন্যতা, মধ্যম বা পার্সিয়াল পানিশূন্যতা ও পানিশূন্যতা নেই এমন হতে পারে। তবে আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে যারা আসছে, সবাই তীব্র পানিশূন্যতায় ভুগছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছিল ২০১৮ সালে। সে সময় দৈনিক এক হাজারের কিছু বেশি রোগী ভর্তি হলেও এখন তা ১ হাজার ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। এরই সঙ্গে বর্তমানে ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই বয়স্ক মানুষ। এবার ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী তীব্র ডায়রিয়া বা কলেরায় আক্রান্ত।
কেএম/টিটি