শ্রেষ্ঠ সমাবেশ
গতকাল বিরোধীদলীয় একটি জনসভা হয়ে গেছে। অনেক মানুষ হয়েছিল জনসভায়। এই দেখে বড় ভয় পেয়ে গেছেন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য শুফম হালদার। টিভি চ্যানেল, ইউ টিউব, ফেসবুকের উপর মনে মনে তার অনেক রাগ হচ্ছে। কেন যে এরা সারাদিন এই জনসভা প্রচার করতে গেল। এগুলো না থাকলে হয়তো চাল চুরি, গম চুরি, টেন্ডারবাজি, বালু তোলা, জমি দখল ইত্যাদি কাজের মতো করে বলে দিতাম; এটা গুজব। বিরোধীদলীয় নেতাদের অপপ্রচার। তাদের জনসভায় কোনো লোক হয়নি।
আজ সকালে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাহেব ফোন দিছিল। অনেক রাগ করেছেন। দল ক্ষমতায় থাকতে বিরোধীদলীয় নেতারা এত বড় জনসভা কেমনে করে? আগামী নির্বাচনে দলের পরিস্থিতি একবার বিবেচনায় আনেন। তাদের জনসভায় যত লোক এসেছে তাতে আমাদের অবস্থা কী একবার ভেবে দেখেছেন? তাদের জনসভায় যত লোক এসেছে তার পাঁচ গুণ লোক দেখতে চাই আমাদের জনসভায়।
- স্যার কী যে বলেন, ওদের জন্য সভায় মাত্র কিছু লোক এসেছে। বিরোধী দলে কোনো লোক নেই আমার সংসদীয় আসনে। সব আমাদের দলের। ওদের ওখানে কোনো লোক যায় নাই। ওটা অপপ্রচার।
- আমি তো দেখলাম টেলিভিশনে। ওদের জনসভায় অনেক লোকের জনসমাগম হয়েছে।
- স্যার, ওরা টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকদের টাকা দিয়ে এডিটিং করে সংবাদ প্রচার করেছে। এ নিয়ে ভাববেন না। আমি আছি তো।
- আপনি চুপ থাকেন। মিথ্যা বলতে বলতে আসলে আপনাদের স্বভাব এমন হয়ে গেছে যে, সত্য বলতে ভুলেই গেছেন। ইউটিউব, ফেসবুকে ওগুলোও কি ভুয়া? আমি এত কিছুই বুঝি না। আগামী দলীয় জনসভায় বিরোধীদলীয় জনসভার চেয়ে পাঁচ গুণ জনগণ আমাদের জনসভা দেখতে চাই। এটাই আমার শেষ কথা। মনে রাখবেন প্রচারেই প্রসার। সভায় লোক না হলে; বহির্বিশ্বে কেমনে প্রচার করব, জনগণ আমাদের পাশে আছে।
মনে বড় যন্ত্রণা। টাকা দিয়ে নমিনেশন কিনে এমপি হয়েছিল শুফম হালদার। রাজনীতির অ খ এত কিছু বোঝে না। ভাগ্যক্রমে টাকার বিনিময়ে দলের জেলা সভাপতি হয়ে পড়েছে আরেক বিপদে। শুধু চুরিচামারিটাই ভালো বোঝে। কীভাবে যে জনসমর্থন পেতে হয় সেটা তার মাথায় আসে না। কুয়ার ব্যাঙ সাগরে পড়লে যা হয় আর কী! সকাল থেকে টেনশন। এত কষ্ট করে চুরি ছ্যাঁচড়ামি করে কিছু টাকা অর্জন করেছিল শুফম হালদার। এই বার বুঝি এই জনসভায় সব যায়।
- বিরোধীদলীয় জনসভায় কত লোক হয়েছিল? তার একান্ত সচিব মাসুদ রানাকে জিজ্ঞাসা করে শুফম হালদার।
- কত আর হবে। মনে হয় হাজার পঞ্চাশেক লোক হয়েছিল।
- আমাদের জনসভা করলে কত হবে?
- হাজার বিশেক তো হবেই স্যার!
- শালা শুয়োরের বাচ্চা। বিশ হাজার লোক দিয়ে আমি কী করব। আমার শেষকৃত্য করার জন্য বিশ হাজার লোক জমায়েত করবি? এই বলে সজোরে থাপ্পড় মারে তার একান্ত সচিব মাসুদের গালে।
- স্যার, হুদায় আমাকে মারছেন কেন? জনগণ কম হলে আমি কী করব? আর আপনি তো ভালোই জানেন, এদেশে যারা সরকারে থাকে তাদের পাশে জনগণ থাকে না। কারণ সরকার দলীয় নেতারা সব সময় চুরি করা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জনগণের কথা তাদের মাথায় থাকে না। আর বিরোধী দল এই নিয়ে ভাগ পেতে চায়। না পেলে মায়া কান্না শুরু করে। দেশ প্রেম তাদের উথলায়ে উঠে। জনগণ চলে যায় বিরোধীদলীয় মায়া কান্না করার নেতাদের পাশে। আমার কী করার বলুন? আর কত লোক লাগবে তাই বলুন?
- লাখ তিনেক লোকের ব্যবস্থা কর।
- স্যার, টাকা ছাড়েন সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি?
- কত টাকা?
- জন প্রতি ৫০০ শত টাকা তো দিতেই হবে।
- বলিস কী? জন প্রতি ৫০০?
- স্যার, বাজারে সব জিনিসের দাম বাড়ছে। এর কম দিলে একটা লোকও আসবে না।
- মোট কত টাকা লাগবে?
- স্যার, ৩০০০০০×৫০০= ১৫০০০০০০০+ গাড়ি ভাড়া + অন্যান্য নেতাদের খাওয়ার খরচ। মোট কোটি বিশেক টাকা লাগবে, স্যার।
- এত টাকা? আমার পক্ষে সম্ভব না। কানাডার ভিসার ব্যবস্থা কর। এ দেশ ছেড়ে আমি চলে যাব। রাজনৈতিক ব্যবসায় যা বিনিয়োগ করার করেছি। মুনাফা যা হবার হয়েছে। আর না।
সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা সংসদ সদস্যের চাচাতো ভাই শুভ হালদার দেখা করতে এসেছে সংসদ সদস্য শুফমের সাথে।
- কী, মিয়া ভাই। মন খারাপ কেন? একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে। শুনলাম চিকিত্সার জন্য কানাডা যেতে চাচ্ছেন। কানাডায় যাওয়া আগে আমাকে ছাত্র সংগঠনের সভাপতি বানিয়ে দিয়ে যাইয়েন। আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ চলছে। পারলে আমার একটা ব্যবস্থা কইরেন। একবার যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারি না! আমার সাথে আপনারাও লালে লাল হয়ে যাবেন। একটু তৎবির টৎবির কইরেন। আর বলেন সমস্যা কী আপনার। মন খারাপ কেন?
- সমস্যা তো অনেক রে। কী বলব বল?
- আরে বলেন। আমিও তো রাজনীতি করি। আপনি বড় দলে। আমি ছাত্রদের দলে। একজন আরেক জনের সুখে-দুঃখে পাশে থাকব। এটাই তো বড় কথা, মিয়া ভাই। এটাই তো রাজনীতি।
লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে শুফম হালদার সব খুলে বলল। সব শুনে হাহাহা করে হেসে উঠল শুভ হালদার।
- আরে মিয়া ভাই। এটা একটা বিষয় হলো। লোকের ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি। আপনার জনসভায় তিন লাখ না, ত্রিশ লাখ লোক হবে। - কেমন করে? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে শুফম হালদার।
- শোনেন, দেশের নামকরা (খ্যাতিমান) দুইজন শিল্পী, একজন নায়ক, তিনজন নায়িকাকে নিমন্ত্রণ করেন। আর কী লাগে। জনপ্রতি পাঁচ লাখ। ত্রিশ লাখ টাকায় সব খতম। আজ থেকে মাইকিং (প্রচার) শুরু করে দেন। দলীয় জোটের জনসভায় দেশ বরেণ্য শিল্পী, নায়ক, নায়িকা, গায়ক থাকছে। জনসভায় প্রথমে একটা গান করবে শিল্পী। তারপরে আধা ঘণ্টা রাজনৈতিক বক্তৃতা। আবার একটা গান। আবার বক্তৃতা। আবার নায়ক-নায়িকার নাচ। আবার বক্তৃতা। সকাল থেকে সন্ধ্যা এভাবেই চলবে। মাঠ থেকে জনগণ সরাতে পারবেন না।
- পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ। জনসভা চলছে। লোক আর লোক। দলীয়, বিরোধীদলীয়, না দলীয় সব। সব ধরনের লোকের বিশাল সমাবেশ। শ্রেষ্ঠ সমাবেশ। দলীয় জোট সরকারের মহা সমাবেশ।
লেখক: কবি ও গল্পকার
Sablushahabuddin@gmail.com
এসএন