ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব: ২
অঘ্রানের অন্ধকারে
পর্ব : ২
বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াতেই দুড়দাড় করে বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ঢাকা থেকে যখন বেরিয়েছিলাম তখন চড়চড়ে রোদ্দুর। গাড়ির ফুল এসি অন করেও ভাপসা গরম কাটছিল না।
যমুনা সেতুর কাছে এসে মেঘ করল। আর লালন শাহ সেতুতে পৌঁছে এক পশলা বৃষ্টি। গাংনী থেকে যখন হাটবোয়ালিয়ার পথ ধরেছি, তখন কালো মেঘ জমাট বাঁধতে শুরু করেছে আকাশে। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দিতেই ঠান্ডা বাতাসের লুটোপুটি খেলা শুরু হলো। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। জোর বাতাসে গাছের ডালে ডালে হুড়োহুড়ি দেখতে দেখতে গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে।
টিনের চালে বৃষ্টির শব্দটা হচ্ছে খুব জোরে। মনে হচ্ছে এখুনি বুঝি মড়মড় করে ভেঙে পড়বে সব। বারান্দায় বৃষ্টির ছাঁট আসছে। একটু সরে ঘরের দরজার চৌকাঠের ওপর এসে দাঁড়ালাম।
অঝর ধারায় পানি পড়ছে টিনের চাল বেয়ে। পানির সেই ধারা বাতাসে বেঁকে যাচ্ছে। উঠোন ভাসিয়ে পুব কোণায় বন্ধ কুয়োর মধ্যে বেড়ে ওঠা পেয়ারা গাছের গোড়ার চারপাশে পাক খেয়ে পানির স্রোত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ছে সামনের খালে। আমাদের ছোটোবেলায় ওটা খালই ছিল, এখন হয়েছে ড্রেন। বৃষ্টি থেমে গেলে ছেলেবেলায় আমরা কাগজের নৌকা বানিয়ে ছেড়ে দিতাম ওই স্রোতে।
বছর পাঁচেকের রোগা-পটকা এক মেয়ে উদোম গা, প্রিন্টের কুচি দেওয়া প্যান্ট পরনে, কাঁধভাঙা অ্যালুমিনিয়ামের ছোটো পাতিল আর নারকেলের দুটো মালায় নিয়ে বসিয়ে দিলো টিনের চালের ফুটোর নিচে। চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে মাটির বারান্দার দু-তিন জায়গায় গর্ত হয়ে গেছে। গর্তের ভেতরটা সবুজ।
‘পথের পাঁচালী’র অপু আর দুর্গা এ রকম খুব বৃষ্টির ভেতর আটকা পড়ে চেঁচাচ্ছিল, ‘নেবুর পাতায় করমচা/ হে বৃষ্টি ধরে যা।’
আমাদের বাড়ির উঠোনে দক্ষিণ কোণায় রান্নাঘরের সামনে লেবুর গাছ ছিল, এখন নেই। শূন্য উঠোনের দিকে তাকিয়ে আমার সেই লেবু গাছটার কথা মনে পড়ল।
বাঁশের আড়া থেকে গামছা টান দিয়ে ছোটো চাচি এগিয়ে দিলো আমার দিকে। মাথার পানিটুকু মুছে নিতে বলল। অবচেতন মনে সামনের দিকে চোখ পড়েছে আমার। মাটির পিলারের সাথে আয়নার একটুখানি ভাঙা টুকরো আটকানো ছিল। সেটা নেই।
মনে হলো অনেক কিছুই যেন নেই। সেই আয়নাতে আমরা মুখ দেখতাম। ডানে-বাঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ওটার সামনে দাঁড়িয়েই তেল চুপচুপে মাথার চুল আঁচড়ে পরিপাটি করতাম। কয়লা দিয়ে খুব করে ডলে দাঁত কতটুকু সাদা হয়েছে তা ওই আয়নাতেই দেখে নিতাম।
অনেক বদলে গেছে হাটবোয়ালিয়া। মাথাভাঙ্গা নদীর ওপর লম্বা ব্রিজ হয়েছে। হাটবোয়ালিয়া থেকে সরাসরি ঢাকায় বাস চলাচল করে। এখন আর হাটবোয়ালিয়াকে গ্রাম বলে মনেই হয় না।
ইউনিয়ন সদর না, উপজেলা না, একেবারে গ্রাম। কত বদলে গেছে। বদলায়নি শুধু আমাদের বাড়ির ভেতরটুকু। মাটির মেঝে, ঘরের চালে টিন, তার নিচে বাঁশের পাটাতন। ভেঙেচুরে ঝুরঝুরে হয়ে আছে।
ছেলেবেলায় আমরা চালের নিচের পাটাতনের ওপর উঠে লুকিয়ে থাকতাম। এ বাড়িতে এখন কেউ থাকে না। কোনো ঈদে কিংবা বিশেষ কোনো আয়োজনে আমাদের আসা হয়।
আমি এসেছি একটা বিশেষ অনুষ্ঠানে। এ বছর হাটবোয়ালিয়া ইশকুল থেকে যারা এসএসসি পরীক্ষায় ‘এ’ পেয়েছে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। অফিসের কাজ ছাড়া ব্যক্তিগত কোনো কাজে ঢাকা থেকে বেরোনো এখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে গেছে।
অফিসের কাজে মাঝেমধ্যে ঢাকার বাইরে যেতে হয়। স্পর্শকাতর কোনো সংবাদ থাকলে নিজে গিয়ে দেখে আসার প্রয়োজন পড়ে। এ গ্রাম, সে গ্রাম, পাহাড়, চর চষে বেড়াই বছর ভর। শুধু আসা হয়ে ওঠে না নিজ গ্রামে। শৈশব, কৈশোর, ঢেলাভাঙা মাঠ, বর্ষা নামা নদী, খাল-সবই আমার এই গ্রামে। কত দিন পর এলাম এখানে!
দাদার মৃত্যুর পর এ গ্রামে আসার তাড়াটা কমে গেলেও আকর্ষণ কমেনি একটুও। দিনে দিনে কাজের ব্যস্ততা যত বেড়েছে, সেই কাজের ভেতর থেকে নিজের গ্রামে আসার সময় বের করার সম্ভাবনাও কমে গেছে ততটাই।
শনিবার আমার অফডে। আজ শনিবার। অনুষ্ঠান শেষে আজ সন্ধ্যাতেই ঢাকায় ফিরতে হবে। আগামীকাল বেলা তিনটায় জরুরি স্টাফ মিটিং আছে।
বৃষ্টি ছেড়ে আসছে। এখনো পুরোপুরি ছাড়েনি। বাতাস বইছে। ছোটো চাচি এক গ্লাস লেবুর শরবত এনে দিলো। মনে হলো বাড়ির গাছের সেই লেবুর গন্ধ।
বৃষ্টি মাথায় করেই দু-তিনজন দৌড়ে বাড়ির ভেতর এসে ঢুকল। চোখ মুখের উজ্জ্বলতা ওদের ভেতরের তৃপ্তি প্রকাশ করছে।
হাটবোয়ালিয়ার ইজ্জতউল্লাহ্ উদ্যানে জয়তুন নেছা মঞ্চকে ঘিরে প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। বেশ বড়ো আয়োজন। আয়োজক রিয়াজ ডাক্তার ফাউন্ডেশন।
এ ধরনের আয়োজন এখানে খুব একটা হয় না। ডাক্তার রিয়াজউদ্দিন আহমদ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের এমএলএ ছিলেন। পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। নেশা জনসেবা। প্রচণ্ড জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব তিনি। আজকের অনুষ্ঠানে এ গ্রামের স্বনামধন্য সন্তানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অনেকে এসেছেন।
ছোটোবেলার যাত্রাগানের কথা মনে পড়ছে। এরকম প্যান্ডেল তৈরি করে চারপাশ ঘিরে ইশকুল মাঠে তখন ‘যাত্রা’ হতো।
ছোটোবেলায় ওরকম এক যাত্রাপালায় অভিনয় করেছিলাম। যাত্রার নাম ছিল ‘ভুল কার?’ প্রথম মঞ্চায়নে আমাদের গ্রামের ছেলেরা মেয়ে সেজেছিল। দ্বিতীয় মঞ্চায়নের সময় মেয়েদের অভিনয় করার জন্য যাত্রাদলের প্রফেশনাল অভিনেত্রীদের আনা হয়েছিল। তখন সে কী উত্তেজনা! রীতিমত টিকিট কেটে যাত্রা দেখা।
বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘগুলো দ্রুত উড়ে যাচ্ছে। টেবিলে হরেক রকমের খাবার। মনে হচ্ছে এক বেলাতে সবরকমের খাবারের স্বাদ নিতে হবে। খাবারের ব্যাপারে আমাকে বাছবিচার করতে হয়। বয়স বাড়ছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু খাবার নিষিদ্ধ হয়ে যায়। মিষ্টি, রেডমিট তারভেতর অন্যতম।
ছোটো ফুপু টেবিল সাজাচ্ছে। দাদা-দাদির কবর জিয়ারতের জন্য গোরস্থানের দিকে রওনা হলাম। এখন আর বৃষ্টির পরে প্যান্ট গুটিয়ে খালি পায়ে বেরোতে হয় না। পাকা রাস্তা। গোরস্থানে পৌঁছুতে সূর্য উঁকি দিলো। দুপুর রোদে ভরে গেল চারপাশ।
অনুষ্ঠান শুরু হলো দুপুরের পরপর। একেবারেই আশা করিনি এত লোকসমাগম হবে। অশীতিপর বৃদ্ধ নিমাই মণ্ডল খালি গায়ে লাঠিতে ভর দিয়ে এসেছেন। তেজ আছে এখনো সেই আগের মতো।
হালিমা দাদি প্রায় আমার দাদির সমসাময়িক। বৃদ্ধা যেন জয় করেছেন বয়সকে। মেয়েদের ভেতর সামনের সারিতে বসে আছেন।
রোদ ঝলমলে দিন। গাছের ভেজা পাতা আর ভেজা চাঁদোয়া ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। ক্লাস সেভেনের এক ছাত্র এত গুছিয়ে বক্তৃতা দিলো, খুব ভালো লাগল।
অভিভূত হয়ে গেলাম যখন সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে যে ছেলেটি তার মাকে ডাকা হলো মঞ্চে। সন্তানের গর্বিত মা এগিয়ে এলেন মঞ্চের দিকে। দর্শকসারির একপাশ থেকে পাঁচ-সাতজন ছেলেমেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতে তালি দিতে শুরু করল। তারপর সবাই দাঁড়িয়ে মাকে অভিবাদন জানাল। মায়ের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হলো।
মুল অনুষ্ঠান শেষ হতে বিকেল পড়ে এলো। আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত। আমাকে রওনা হতে হবে। বিদায়-আদায়ের দরকার আছে।
যতজনের সাথে সম্ভব সকলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। প্রায় সবার এক অভিযোগ, গ্রাম বসবাসের যোগ্য নেই। এখানে সুযোগসুবিধা নেই বললেই চলে।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাস করা সরকারি ডাক্তার নিয়মিত আসেন না। রাস্তা পাকা হওয়ার পর তরিতরকারি সব শহরে চলে যাচ্ছে, এখানে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে হুহু করে। খুনখারাবিও বেড়ে যাচ্ছে দিনদিন।
কেউ কেউ ছেলেমেয়েকে ঢাকায় পড়াতে চান। কেউ ছেলের জন্য ঢাকায় ভালো চাকরি চাইলেন।
ড্রাইভারকে আমার ব্যাগ গাড়িতে তুলতে বলে বাড়ির উঠোনে এসে দেখি ওপাড়ার চাচি। মেয়ে সাথে নিয়ে এসেছেন।
ছোটো চাচি নারকেল, ডাব, বাতাবিলেবু এসব তুলে দিতে শুরু করল ড্রাইভারের হাতে গাড়িতে নেওয়ার জন্য।
চাচি বিকেল থেকে বসে আছেন আমার সাথে কথা বলবেন বলে। মেয়ে এইচএসসি পাস করেছে গতবার। এখানকার কোনো অফিসে তার চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বড়ো ভাই হিসেবে এ দায়িত্বটুকু নেওয়া যে আমার জন্য অতি আবশ্যক তা চাচি জোরাল যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। চাকরি না হলে ভালো পাত্র। যৌতুক কম নেবে এমন। শহরে ভালো চাকরি করে, কিংবা চাকরি দিয়ে দিতে হবে পাত্রকে।
সন্ধ্যা মিলিয়েছে কিছুক্ষণ হলো। পল্লী বিদ্যুতের খুঁটিতে ইলেক্ট্রিকের তার টানা থাকলেও বাতি প্রায় জ্বলে না বললেই চলে। ছোটো একজন মেয়ে হারিকেনের কাচ পরিষ্কার করছে। ঠিক ওরকম করে সন্ধ্যা লাগার আগে আমি বাড়ির সব হারিকেন পরিষ্কার করে তেল ভরতাম।
আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশ ভরতি তারা। ঢাকায় কখনো আকাশ দেখিনি। ঢাকার বাইরে গেলে আকাশ দেখেছি, কিন্তু আকাশে এত তারা কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
মনটা কেমন যেন দুলে উঠল। গরমের সময় এরকম তারা ভরা রাতে দাদা আমাদের নিয়ে বাড়ির সামনে ঘাসের ওপর চট বিছিয়ে বসতেন। বেশিরভাগ দিন গল্প শোনাতেন। হঠাৎ কোনোদিন গুনগুনিয়ে গাইতেন, ‘এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনলে বল কে।’
ছোটো ফুপু এসে বলল, ‘আজ রাতটা থেকে যা।’
ছোটো ফুপু বয়সে আমার চেয়ে খুব বেশি বড়ো না। ছোটোবেলায় নদীতে গোসল করতে যেতাম ফুপুর সাথে। ফুপু যখন ছোলা শাক তুলে কোঁচড় ভরতি করত তখন মাঠের আইল দাপিয়ে এসে ফুপুর পিঠ ঘেঁষে বসতাম। বাড়িতে অতিথি এলে গ্রামের ভেতর মুরগির ডিম, নাহয় মুরগি খুঁজতে বেরোত ফুপু। আমি যেতাম ফুপুর শাড়ির আঁচল ধরে।
কাঁধের ওপর হাত রেখে ছোটো ফুপু বলল, ‘খুব ভোরে রওনা দিস। ফজরের আযানের সময়।’
রাতটা বাড়িতে থেকে গেলাম।
রাতের আঁধারে বুঝি আমার ছেলেবেলা খুঁজতে ছোটোফুপুর সাথে গেলাম নদীর পাড়ে। বর্ষার সময় এই মাথাভাঙ্গা নদী দুকূল ছাপিয়ে কত্ত বড়ো হয়ে যেত। স্রোতও হতো তীব্র। সাঁতরে নদী পার হওয়ার প্রতিযোগিতা আর স্রোতে নৌকা ভেসে যাওয়ার উত্তেজনা ছিল প্রতি বর্ষার বিশেষ আকর্ষণ।
বর্ষায় নদী এখন শান্ত। রাত বেশি হয়নি। অথচ মনে হচ্ছে কত রাত। চারদিক সুনসান। অন্ধকার। গতকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই। আজও আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
আকাশ তারায় তারায় ভরা। পিটপিট করে জ্বলে নেভে। ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে আছি ছোটো ফুপুর সাথে। শার্টটা খুলে ঝিরঝিরে বাতাসটুকু গায়ে মাখতে ইচ্ছে করছে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্রিজের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। একেই বুঝি বলে পরান জুড়িয়ে যাওয়া। ছোটোবেলার কথাগুলো যেন নতুন করে মনে পড়ছে। ফুপু বলছে একটা, আমি যোগ করছি আরেকটা।
এই নদীতে ‘হৈলখেলা’, মাছ ধরা, বর্ষার রাতে স্রোতে ভেসে যাওয়া হাঁস খুঁজে বাড়ি ফেরা। মাঠ থেকে পাকা ছোলার গাছ তুলে পুড়িয়ে ‘হুড়া’ বানিয়ে খাওয়া। কতসব স্মৃতি। এত কিছু এখনো মনে আছে! ইটের ভাটার ক্ষার মেখে রাজা সাজা। অবাক লাগছে। ভুলিনি কিছুই।
কাব্যময়তা পেয়ে বসেছে আমাকে। অন্ধকারকে বলতে ইচ্ছে করছে তমসা। সেই তমসাচ্ছন্ন রাত্রীতে নদীর উদাসী হাওয়া গায়ে মেখে বাড়ি ফিরলাম।
ঘরের বারান্দায় হারিকেন জ্বলছে। দপদপ করছে শিখা, মনে হচ্ছে এখনই নিভে যাবে।
ছোটো চাচি রান্নাঘরে চুলার পাড়ে। দেশি মুরগির ঝোল তরকারি রান্না হচ্ছে খড়ির আঁচে। লাল চালের ভাত। গরম ভাতের সাথে বেগুন ভর্তা। সন্ধ্যাবেলায় চাচি জেনে নিয়েছে রাতে আমি কী খেতে চাই।
ফুপু কলপাড়ে গেল হাত-পা ধুতে। আমি ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। ঘরের বারান্দায় বালতিতে পানি, মগ, পাশে সাবান।
অন্ধকারের ভেতর থেকে কে যেন আস্তে করে ডেকে ওঠল, ‘মেজো ভাই!’
ঘুরে তাকালাম। উঠোনের একপাশে বাতাবিলেবুগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে মধ্য বয়সী এক নারী। সাথে কিশোরী বউ কি কন্যা ঠিক অনুমান করা যাচ্ছে না। তার পরনেও শাড়ি।
কিশোরী মেয়েটি যে যথেষ্ট লাবণ্যময়ী তা এই আলো-আধারীতেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। গায়ের রং ফরসা এবং দেখতে সুন্দর।
ততক্ষণে দুপা এগিয়ে এসেছি। মহিলাও এগিয়েছে খানিকটা। সাথে কিশোরীও। কিশোরীর মুখটা খুব চেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু মনে করতে পারি না।
মহিলার দিকে তাকালাম। হারিকেনের শিখা স্থির হয়ে পাশটুকু আলোকিত করে রেখেছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মহিলা জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে চিনতে পারছেন?’
তাকে চিনতে পারলাম না। সাদামাটা গ্রামের বউ। তবে দ্যুতি আছে। প্রিন্টের উজ্জ্বল শাড়ি পরনে। শরীরের বাড়তি মেদ তাকে খানিকটা স্থূল বানিয়ে ফেলেছে। বলল, ‘আমি রুশিয়া।’
আমার চারপাশ কেঁপে উঠল আচমকা। ততক্ষণে কলপাড় থেকে ফুপু ফিরেছে। তাকে দেখে ফুপু বলল, ‘রুশিয়া! কখন এলি? ঘরে আয়।’
ঘরের বারান্দায় উঠে এসে আস্তে করে চৌকির ওপর বসে পড়লাম। ফুপু আমাকে বলল, ‘রুশিয়ার কথা মনে আছে তোর? এ হচ্ছে রুশিয়ার ছোটো মেয়ে...।’
ফুপুর কথাগুলো মিলিয়ে গেল। আমার মাথার ভেতর ভোঁ ভোঁ করছে। কোনো শব্দ শুনতে পারছি না।
চোখ মেলে খুব ভালোভাবে রুশিয়ার পানে তাকালাম। সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অন্ধকারে তার মায়াময় চোখদুটো ভাসছে। আলো করে রেখেছে চারপাশ। রুশিয়ার অতল স্নিগ্ধ চোখের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারলাম না।
আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকের পাড়ায় ছিল ওদের বাড়ি। খুব দূরে নয়। আমার সমান কি আমার চেয়ে বছর খানেকের ছোটো ছিল ও।
অপূর্ব দেখতে ছিল রুশিয়া। অসম্ভব রূপবতী এক কন্যা। কাজল দেওয়া বড়ো বড়ো ডাগর চোখ। পিঠ ছাপিয়ে কোমর বেয়ে নেমে যাওয়া ঘনকালো চুল। এফোঁড় ওফোঁড় করে আকাশ চিরে ফেলা বিদ্যুৎ চমকের মতো হাসি। অত সুন্দর মানুষ আর দেখিনি। তখনই শাড়ি পরত। পরির মতো দেখাত রুশিয়াকে। তখন হাই ইশকুলে পড়ি। আমার কৈশোর সময় বাঁধা পড়ল রুশিয়ার কাছে।
সব সময় হাসত। ঝকঝকে হাসি। দাদি যখন বলতেন, ‘ও বু ঢেঁকিতে দুটো পাড় দিয়ে দে তো।’ আমি ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। রুশিয়া ঢেকিতে পাড় দিচ্ছে। ঘর্মাক্ত মুখে একটুও ক্লান্তি নেই। কপালে, নাকের ডগায়, চিবুকে, গলায় ফোঁটা ফোঁটা ভোরের শিশির রোদ পেয়ে ঝিকমিক করছে। দু’চোখ তখনো হাসছে।
ওদের বাড়ির সামনে রাস্তার ওপরে ছিল ভেটুলগাছ। সেই ভেটুলগাছের নিচে ছিল সুতার মিস্তিরির চালাঘর। সেখানে গোরুর গাড়ির কাঠের চাকা বানানো হতো। পাশে ছিল কামারশালা। ওখানে গাড়ির চাকায় লাগানোর জন্য লোহার রিং গড়াতো।
গাছ থেকে বাবলার মোটা ডাল কেটে নিয়ে সুতার মিস্তিরির কাছে গিয়ে বসে থাকতাম লাটিম বানিয়ে নেওয়ার জন্যে। কামারশালায় বসে ঘণ্টা পার করতাম হাপর টেনে। লাটিমের আল ওখান থেকেই লাগাতে হতো।
হাপর টানা, লাটিম বানানো সব ছিল ছল। পথের ওপর বসে পাশের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতাম, যদি রুশিয়ার দেখা পাই।
একদিন ছোটো ফুপুকে বললাম, ‘বড়ো হয়ে আমি রুশিয়াকে বিয়ে করব।’
ফুপু হেসে বলল, ‘পাগল!’
‘আপনি কি কাল সকালেই চলে যাবেন?’ রুশিয়া আমাকে ‘আপনি’ করে বলছে। ছোটবেলায় ও আমাকে কী বলে সম্বোধন করত? আমি ওকে কী বলব, তুই না তুমি?
ছোটো করে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ ‘
‘আপনি এসেছেন শুনে এলাম।’ রুশিয়া কথা শুরু করেছে। আমি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছি। রুশিয়ার মেয়ে গিয়ে বসেছে রান্নাঘরে।
ছোটো ফুপু রুশিয়াকে বলল, ‘ঘরে উঠে বস।’
রুশিয়া সামনে এগিয়ে এলো। ছোটো ফুপু উঠোন পেরিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেছে। রুশিয়া ঘরে উঠে বসল না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় থাকো?’
হেসে ফেলল। সেই বাউ কুড়ানি হাসি। বয়স বেড়েছে। হাসি এতটুকু ম্লান হয়নি।
‘শ্বশুরবাড়ি। ভেড়ামারায়। তিন দিন হলো বাড়ি এসেছি। মানে এখানে। বিয়ের পর তো মেয়েদের বাড়ি বলতে বোঝায় শ্বশুরবাড়ি।’
কত কথা বলছে রুশিয়া! ছোটোবেলায় এরকমই বলত।
আবার নীরব হয়ে এলো চারদিক। দুজনই চুপচাপ। কী বলব ওকে? জিজ্ঞেস করব ছেলেমেয়ে কয়জন, স্বামী কী করে, কয়দিন থাকবে ও এখানে!
রুশিয়ার কাছে আমার এসব জানতে চাওয়া অর্থহীন। আমার চিন্তায় কখনো ওর স্বামী, সন্তান, সংসার, বাবা, ভাই- এসব কিছু ছিল না।
নুয়ে পড়া ডালে ঝুলে থাকা বাতাবিলেবুটাকে আলতোভাবে স্পর্শ করল রুশিয়া। হালকা বাতাসে দুলে ওঠার মতো এপাশওপাশ দোল খাচ্ছে বাতাবিলেবু। ওটাকে হাত দিয়ে ধরল। আবার দুলিয়ে দিলো। রুশিয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে উদাসীন দেখাচ্ছে।
‘মেজোভাই!’
রুশিয়ার ডাকে চমকে উঠেছি এবার। ছেলেবেলার সেই রুশিয়া আমার ভেতরে ডেকে উঠেছে।
বললাম, ‘হুঁ!’
‘সেই কথা মনে আছে আপনার?’
‘কোন কথা?’
‘সেই যে, আমি এঁচোড়ের কাঁঠাল নেওয়ার জন্য এলাম।’
দাদি আমাকে বলল, ‘যা তো ভাই ওকে কাঁঠাল পেড়ে দে। মই, দড়ি আর হাসুয়া নিয়ে তোমার সাথে কাঁঠাল বাগানে গেলাম।’
‘আমি গেলাম আপনার সাথে।’
‘একই কথা। লুঙ্গিতে কাছা দিয়ে গাছে উঠলাম।’
আপনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন কাঁঠাল পাড়ব? আমি একটা কাঁঠাল দেখিয়ে বললাম, ওই ওটা।
তারপর তুমি বললে, না না ওটা না। ওই যে ওটা। তারপর আবার বললে, ওটা না ও-ই ওপরের ওটা।
আপনি এক ডাল থেকে আরেক ডালে যেতে থাকলেন।’
‘এক ডাল থেকে আরেক ডালে যেতে আমার যখন খুব কষ্ট হচ্ছিল তখন নিচে দাঁড়িয়ে তুমি খিলখিল করে হাসছিলে।’
‘এক সময় আপনি একেবারে গাছের ওপরের ডালে উঠে গেলেন।’
‘ওখান থেকে বড়ো একটা কাঁঠাল পেড়ে দিলাম তোমাকে। তুমি কাঁঠাল নিয়ে বাড়ি চলে গেলে।’
রুশিয়া হাসছে। ওকে আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কেমন রহস্যময় ঠেকছে এখন ওকে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ কথা তোমার মনে আছে কেন?’
রুশিয়া হাসি থামিয়ে আমার দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকল। স্থির নিষ্পলক সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সহসা কেমন জানি ভয় করে উঠল আমার। অশরীরী ভয়। রুশিয়া থমকে যাওয়া গাঢ়স্বরে বলল, ‘অন্য আর কোনো কথা মনে নেই যে আমার!’
বলে আবার হেসে উঠল। আমার ভয় কেটে গেছে। রুশিয়ার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, সেদিনের সেই কথা তো আমিও ভুলিনি। মনে মনে বললাম, আমার যদি সামর্থ থাকত রুশিয়া, তোমাকে আমি অমর করে রেখে যেতাম। সেই সামর্থ আমার নেই।
রুশিয়ার দিকে তাকালাম। সে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। হাতের করতলে সাদা জোছনা। বললাম, ‘তোমার হাতে কি?’
ও সামনে হাত মেলে ধরল, ‘বাতাবিলেবুর ফুল।’
আমি ওর কাছ থেকে বাতাবিলেবুর সেই ছোটো ছোটো ফুল কয়টা চাইলাম। হাত বাড়িয়ে রুশিয়া আমাকে ফুলগুলো দিলো। তখন কি রুশিয়ার হাতে আমার আঙুল স্পর্শ করেছিল! বোধ হচ্ছে অসাড় হয়ে গিয়েছিল আমার হাত। আবশ আঙুলে আমি রুশিয়ার স্পর্শ অনুভব করতে পারিনি।
রুশিয়ার কিশোরী কন্যা রান্নাঘর থেকে তেল-পেঁয়াজ দিয়ে মাখানো একবাটি মুড়ি এনে সামনে রাখল। তখন ওকে চিনতে পারলাম। আমার ছেলেবেলায় দেখা সেই রুশিয়া। হুবহু সেই মুখ, সেই লাবণ্য, অপূর্ব সেই সৌন্দর্য।
সারারাত্তির ঘুম এলো না। প্রথমে মনে হলো বিছানা বদলিয়েছি তাই। তারপর বিভিন্ন রকমের চিন্তা মাথায় আসতে থাকল। গ্রামে আমাদের যে জমি-জায়গা আছে, সেখানে শিশুদের জন্য কমপ্লেক্স তৈরি করা যায়। ওদিকটায় বৃদ্ধাশ্রম। নানারকম পরিকল্পনা মাথার মধ্যে খেলা করছে। এসব পরিকল্পনার ভেতর বারবার রুশিয়া এসে হাজির হলো।
ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ছোটো চাচার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙলেও বললাম, ‘পরে বের হব।’
ইচ্ছে করেই আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম। সকাল হোক।
সূর্য ওঠার পর রওনা হলাম। ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভারকে পাশে উঠতে বললাম। চুয়াডাঙ্গা হয়ে যাব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে চুয়াডাঙ্গার পথ।
আস্তে আস্তে গাড়ি এনে আমাদের বাড়ির দক্ষিণপাড়ায় পথের ধারে যেখানে ভেটুলগাছটা ছিল, সেখানে দাঁড় করালাম। একটু ওপাশে ছিল সুতার মিস্তিরির চালাঘর। ওখানে কামারশালা।
গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পুবপাশের লম্বা বাগান দেখিয়ে ড্রাইভারকে বললাম, ‘এই যে বাগানটা দেখছ, ওই নদী পর্যন্ত, এটা আমাদের।’
আমার মন এবং দৃষ্টি তখন পশ্চিমে, রুশিয়াদের বাড়ির দিকে। বারবার প্রবল আকাঙ্খায় চাইছি, রুশিয়া অন্তত একবার বাইরে আসুক। শুধু একবার। ওর পানিতে ভাসা নরম পদ্মের মতো অতল গহিন চোখ দুটো দেখার ভীষণ ইচ্ছে হলো।
রুশিয়া এলো না। সময় গড়াতে থাকল। গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে থাকলাম যতক্ষণ দেখা যায় পেছনের পথ। চোখের পলক ফেলিনি। রুশিয়াকে একবার দেখব বলে বেলা করে বের হয়েছি। এই পথে রওনা হলাম।
গাড়ির লুকিং গ্লাসে পেছনের দিকে তাকিয়ে আছি। রাস্তার পাশের গাছগুলো দ্রুত সরে যাচ্ছে। রুশিয়া পথের ধারে এলো না। ওকে আর একটিবার দেখার সমস্ত সম্ভাবনা মিইয়ে এলো। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল আমার গ্রাম, ভেটুল গাছ, সুতার মিস্তিরির চালাঘর, কামারশালা।
ভাঙবাড়িয়া পৌঁছে ড্রাইভারের হাতে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে পেছনের সিটে এসে বসলাম। ড্রাইভারকে বললাম, ‘সোজা এক রাস্তা, আসমানখালী হয়ে চুয়াডাঙ্গা ‘
নির্ঘুম রাতের জের টের পেলাম। চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। আমি ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখলাম, রুশিয়া বাঁধাছাদা করছে। খুব ব্যস্ত সে। বারবার আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে এর ভেতর যবের ছাতু, এর ভেতরে ছোলার। এটা চালের আটা। আবার দেখি এক বান্ডিল আখ বেঁধেছে। শাড়ির কোঁচড় ভরতি ওর। কোঁচড় থেকে বেতের তৈরি পাজিতে মুড়ি তুলে গোলমুখওয়ালা টিনের মধ্যে ভরছে।
সেই টিন আবার একপাশে মরচে পড়া, একপাশে সবুজ রং করা। ওরকম টিন নিয়ে যাব না বলে রাগারাগি করছি।
রুশিয়া তার গভীর বড়ো বড়ো চোখ নিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুম ভেঙে গেল। পেছনে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম গ্রাম থেকে কতদূরে চলে এসেছি। দেখলাম অনেকটা পথ পার হয়ে এসেছি।
আর কোনোদিন দেখা হয়নি রুশিয়ার সঙ্গে আমার। তারপর থেকে কেবল মনে হয়,
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি—কুয়াশার পাখনায়—
জোনাকির দেহ হতে—খুঁজেছি তোমারে সেইখানে
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রানের অন্ধকারে
(চলবে)