ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১০
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
সন্ধ্যার আগে সবাইকে ভাত খেতে দেয় মায়ারানী। বলে, এটা রাতের খাবার। রাতে নৌকায় খাওয়ার ব্যবস্থা হবেনা। এখন পেট ভরে খেয়ে নাও সবাই। অজয় তুমিও এই পাশে বসো। তোমাকেতো নৌকা বাইতে হবে। আমি যতক্ষণ পারি তোমার সঙ্গে জেগে থাকব। বাচ্চারা ঘুমাবে। তোমার বেশি কষ্ট হয়ে গেলে বীথিকার বাবাও নৌকা বেয়ে তোমাকে সহযোগিতা করবে।
হরেন্দ্রনাথ মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। বাবারা খেতে বসো।
অমল বলে, আমার যদি রাতে খিদা পায়?
-বিস্কুট খেতে দেব।
-হ্যাঁ, খাব খাব।
তিন ছেলে একসঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলে। বনের পাখিদের কূজন ভেসে আসে। ভাত খেয়ে সূর্য ডোবার আগে নৌকায় ওঠে সবাই। অজয় মাঝি নৌকা বাইতে শুরু করে। এভাবে রাতের অন্ধকারে নদীপথ পার হয় সবাই। আশেপাশে ছোট ছোট অনেক নৌকা আছে। মাঝে মাঝে জয় বাংলা ধ্বনি ভেসে আসে নৌকা থেকে। হরেন্দ্রনাথ নিজেও জয় বাংলা-স্লোগান দেয়। সঙ্গে বীথিকা, মায়রানীও স্লোগান দেয়। রাত বাড়ে। নদীপথে অন্ধকার গাঢ় হয়। তারপর চাঁদের হালকা আলোয় নৌকা চালায় অজয়। মায়ারাণীর মনে হয় দেশ ছেড়ে যেতে হচ্ছে অন্য দেশে বেঁচে থাকার জন্য। দেশের এই নদী, রাতের আকাশ, অজয় মাঝির মতো সাহসী মানুষ রাতের অন্ধকারে নদী পার করে দিচ্ছে! এমন সুন্দর জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ফিরে আসবে স্বাধীন দেশে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ করবে এ দেশের সাহসী মানুষেরা। মায়ারাণী সবার মুখ থেকে শোনা স্লোগানটি উচ্চারণ করে -‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো -বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’
বাতাসে ভেসে যায় তার কন্ঠস্বর -নদীর স্রোতে মিশে যায় কন্ঠস্বর। হরেন্দ্রনাথ শুয়েছিল। স্লোগান শুনে সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে বলে, স্লোগান দিচ্ছ?
- হ্যাঁ গো, স্লোগান দিয়ে ভরিয়ে দেব এই অপরূপ দেশ। মানুষেরা সবাই মিলে যুদ্ধ করবে।
-আমরা কি করব?
-আমরাও দেখব কি সহযোগিতা করা যায়?
-তা ঠিক, শুধুতো অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না, যুদ্ধের নেপথ্যেও অনেক কাজ থাকে।
-যে মুক্তিযোদ্ধারা আহত হবে তাদের সেবা করব আমি।
-মায়ের সঙ্গে আমিও সেবার কাজ করব। আর যদি অস্ত্র চালানো শিখতে পারি তাহলে পাকসেনাদের মারব। ওরা যেভাবে গানবোট নিয়ে যায় তখন গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে ওদেরকে গুলি করব।
- সাবাস, আমার মা। দেখি ভারতের কোথায় ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। তোকে সেখানে নিয়ে যাব।
-বাবা, নদীর স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা লাশ দেখে আমি মর্মাহত। আমার মনে হয় আমার শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে। একসঙ্গে এত মৃত মানুষ দেখতে হচ্ছে।
-এসব নিয়ে এত ভাবিসনা মা। মনে সাহস রাখ। সাহসই এখন খুব দরকার। এখন আমরা মৃত্যু শোক করবনা। এই মৃত্যু গৌরবের। তারা দেশের বীর সন্তান। স্বাধীনতার জন্য জীবন দিচ্ছে।
হরেন্দ্রনাথের কথা শেষ করতেই অজয় বলে, নৌকাটা একটু তীরে ঠেকাই কাকু?
-কেন রে?
-আমার ঘুম পাচ্ছে। তীরে ঠেকিয়ে আমি ঘন্টাখানেক ঘুমাব। তারপর আপনারা আমাকে জাগিয়ে দেবেন।
-আচ্ছা ঠিক আছে। ঠেকাও।
অজয় নৌকা ঠেকিয়ে শুয়ে পড়ে একদম নৌকার কিনারে। ওর মাথা ঝিমঝিম করছে। কানের কাছে পানির শব্দ। কোনোকিছুতে বাধাগ্রস্থ হয়না। ঘুমিয়ে পড়ে। হরেন্দ্রনাথও শুয়ে পড়লে মায়ারাণী চুপচাপ বসে থাকে। এত রাতে নদীতে গানবোট নাই। দূরে তাকালে দু’একটা নৌকা যেতে দেখা যায়। মানুষজন বসে আছে। সুন্দরবন এখানে নেই, পুরো এলাকা খোলা মাঠ। ধানক্ষেত বিস্তারিত হয়ে আছে। অনেকদূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে যায়। মায়ারাণী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এভাবে নিজের দেশকে দেখা কোনোদিন হয়নি। এই যাত্রায় প্রথমে মন খারাপ ছিল শরণার্থী হওয়ার জন্য। কিন্তু এই যাত্রা বদলে দেয় দেশের ছবি। মায়ারাণী গভীরবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেকে বলে, এই দেশ হবে শুধুই বাঙালির। পাকিস্তানিদের না। বাঙালি নিজের ভাষা রক্ষা করার জন্য প্রাণ দিয়েছে। মায়ারণী নৌকা থেকে লাফ দিয়ে তীরে নামে। খালি পায়ে মাটিতে হেঁটে পা-ভরে মাটি লাগায়। তারপর ফিরে আসে নৌকায়। হরেন্দ্রনাথ এটা বুঝে বলে, ভালো করেছো। দেশের মাটি পায়ে ভরেছো। এখন যেখানেই থাকবে মনে রাখবে দেশ তোমার, শত্রুদের না।
দুজনের কথায় অজয় উঠে বসে। বলে, কাকু নৌকা ছাড়ি?
- হ্যাঁ, ছাড়। আমাদের তিন দিন তিন রাত লাগবে পৌঁছাতে। দেরি করা উচিত না।
অজয় নৌকা ছেড়ে দেয়। মধ্যরাত শেষ হয়ে ভোররাতের আভা শুরু হয়েছে। চারদিকে ফিকে আলোর স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। হরেন্দ্রনাথ চারদিকে তাকিয়ে বলে, একটুপরে সূর্য উঠবে। তখন আমরা পার হয়ে যাব শিবসা নদী। তাইনা অজয়?
-হ্যাঁ কাকু ঠিক বলেছেন। ইছামতি নদী পার হতে সারাদিন সারারাত লাগবে।
-হ্যাঁ, তা আমি জানি।
কেউ আর কথা বলেনা। চারদিকে তাকিয়ে থেকে নিজেদের দৃষ্টিকে স্নিগ্ধ করে। একসময় সূর্য ওঠে। ছেলেমেয়েরা উঠে বসে। চারদিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওদের চেহারা। চারজনই বলে, কি সুন্দর লাগছে চারদিক।
কৃষ্ণপদ হাসতে হাসতে বলে, বড় হয়ে আমি একটি নৌকা কিনব। আর নৌকায় ঘুরে বেড়াব সব নদীতে।
বীথিকা চেঁচিয়ে বলে, আমিও তোর সঙ্গে ঘুরে বেড়াব ছোট্ট দাদা। তুই যখন ঘুরবি তখন আমার মনে হবে, আমি তোর ছোট বোন। তুই আমার বড় ভাই।
- হুররে, হুররে। আমি দিদির বড়ভাই হব।
কৃষ্ণপদ হাততালি দেয়। বীথিকা হাসতে হাসতে বলে, নিরঞ্জন আর অমল আমার ছোট ভাই থাকবে।
- হ্যাঁ, আমরা ছোটভাই থাকব। দিদির আদর কুড়াব।
- ঠিক বলেছিস।
কৃষ্ণপদ সায় দেয়।
- আমি বড় ভাই হয়ে দিদিকে আদর দেব।
মায়ারাণী হাত তুলে ওদেরকে বলে, এবার তোরা থাম। সকালের খাবার খেতে হবে না?
- হবে মা। কখন খাব?
- এখনই দিচ্ছি।
(চলবে)