ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১৮
যারা যুদ্ধ করেছিল
রকিব মমিনের রুমে এসে দেখে মজনু মমিনের মাথা টিপে দিচ্ছে। মজনু হঠাৎ বলে, ‘ওস্তাদ, আপনার মন খারাপ ক্যা?’
মমিন বলে, ‘বার বার সাকিবের কথা মনে হচ্ছে। ছোটবেলার বন্ধু। তার জীবনটা এইভাবে চিড়ে চ্যাপ্টা হবে আমি তা চাইনিরে।’
মজনু বলে, ‘শাস্তি বেশি অইছে কইতে চান?’
‘না। তা কইতে চাই না। তবে শাস্তি অন্যদের মতো হলে ভালো হতো। শত্রুকে আধা মৃত্যু দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কথায় বলে, সাপ মেরে লেজ তাজা রাখা ঠিক না।’
মজনু বলে, ‘ওরতো আর কিছু করার ক্ষমতা নাই। ধুকে ধুকে মরতে হবে। ও যেমন বন্ধুর সঙ্গে বেঈমানি করছে এটাই ওর উপযুক্ত শাস্তি। বন্ধুর বোনের সঙ্গে নষ্টামি। জীবনের তরে নষ্টামি করার কম্ম শেষ। বিয়া-শাদীর মুখ জীবনে আর দেখা লাগবো না। সারাজীবন আন্ধা হয়া বাঁচতে হবে। মরলেতো ওস্তাদ শেষ হয়া গেল। শাস্তির কোনো নমুনা থাকলো না। বাঁইচা থাইকা হারে হারে বুঝুক বেঈমানির শাস্তি কি।’
মমিন এবার বিরক্ত মুখে বলে, ‘ওকে বাঁচায়া রাইখা আমার বোনের জীবনটাও অস্বস্তিতে ফেলা হইছে।’
‘কেমনে?’
‘ওই বদমাইশটাকে দেখলে আমার বোনের মনটা অস্থির হয়ে উঠবে। ওর মনেও পুরনো কষ্টের কথা ভেসে উঠবে।’
‘উল্টাটাও হইতে পারে ওস্তাদ। আপনার বোন যখন দেখবে আন্ধা হয়া ব্যাটা অন্যের হাত ধরে চলাফেরা করছে। জনমে আর বিয়া করার সাধ্য নাই তখন আপনার বোনের চরম প্রতিশোধের কথাটা মনে হয়ে শান্তিও লাগতে পারে। পারে না ওস্তাদ?’
মমিন আবার শুয়ে পড়ে। নিস্তেজ কণ্ঠে সায় দেয় মজনুর কথায়। বলে, ‘তাও হতে পারে। কথাটা মিছা কস নাই।’
মজনু ওস্তাদকে খুশি করতে পেরেছে। এই আনন্দে মাথা মালিশ আয়েশ করে করতে থাকে।
ঘরে রকিব আসে মমিনের সঙ্গে দেখা করতে। মজনু তার মাথা মালিশ করছে দেখে ছুটে এসে রকিব বলে, ‘ভাইজান কি শরীর খারাপ লাগছে?’
মমিন বিষন্ন মুখে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘না। রাতে ঘুমোতে পারিনি। মাথাটা টাস টাস করছে। মজনু তাই শুনে মাথা মালিশ করতে শুরু করেছে। পাগল ছেলে।’
মমিন শোয়া থেকে উঠে বসে। মজনুকে বলে, ‘তুই একটু যা তো। রকিবের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’
মজনু বাইরের দিকে যায়। রকিবকে পাশে বসতে বলে মমিন। রকিব বসে। মমিন বলে, ‘মা বাবাকে কোথায় রেখে এলি?’
রকিব বলে, ‘আমার বোনের বাড়িতে। মাকে বলেছি সাথীকে দেখে রাখতে।’
মমিন দুঃখ ভরা কণ্ঠে বলে, ‘সাথীকে নিয়ে আমার ভীষণ ভয়।’
রকিব বলে, ‘আমার বোনের বাড়িতে ভয়ের কোনো কারণ নেই ভাইজান।
মমিন বলে, ‘আমি মিলিটারির ভয়ের কথা বলছি না। সাথীকে আমি খুব ভাল চিনি। ভীষণ অভিমানি মেয়ে। আত্মহত্যা করে না বসে।’
রকিব আমতা আমতা করে বলে, ‘আমি সাথীকে আশ্বস্ত করেছি। বারে বারে বলেছি ও যেন অতীতকে ভুলে যায়।’
‘চাইলেই কি সব ভোলা যায়রে রকিব।’
‘তা হয়তো যায় না। কিন্তু যুদ্ধে আরও অনেকে ভয়ংকর ত্যাগ স্বীকার করছে। তারা যদি ভুলে যেতে পারে ও কেন পারবে না?’
‘কথা অন্য জায়গায়। দেখা গেল ও ভুলে গেছে। কিন্তু প্রতিবেশীরা ওর কষ্টের জায়গায় লবণ ছিটিয়ে ওকে আরও কষ্ট দিচ্ছে।’
‘সে কথাও আমি সাথীকে বুঝিয়ে বলেছি ভাইজান। আমি আপনাকে সব কথা বলতে পারছি না। শুধু এইটুকু আপনাকে বলি, আপনি হয়তো জানেন না আমি সাথীকে ভালবাসি। সাথীও আমাকে ভালবাসে। আমরা ঠিক করেছি, যুদ্ধ শেষ হলেই আমরা বিয়ে করে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাব। সাথীও একমত পোষণ করেছে আমার সঙ্গে।’
রকিবের এই কথায় মমিন খুব স্বস্তি অনুভব করে। মমিন আনমনে বলে, ‘সাকিবকে জীবন মৃত করে রাখা ঠিক হয়নি। মেরে ফেললেই বরং ওর কষ্ট কম হতো।’
‘সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না ভাইজান। আপনার তেমন মনে হলে আবার গিয়ে ফাইনাল অপারেশেন করে আসবো। আপনি এ সব না ভেবে যুদ্ধের প্লান করেন।’
কথাটা পরদিন সারা গাঁও রটে যায়, রাজাকার আলিম জহর এবং গেদুকে পাওয়া যাচ্ছে না। শান্তি কমিটির মেম্বর ফজলুর রহমান এবং তার ছেলে সাকিবকেও পাওয়া যাচ্ছে না। মুক্তিবাহিনী তাদের ধরে নিয়ে গেছে। এই খবর সদরে মিলিটারি ক্যাম্পে পৌঁছালে কমান্ডার ক্যাপটেন আব্বাস খান শতাধিক মিলিটারি এবং অর্ধশত রাজাকার নিয়ে শাজাহান পুর গ্রাম ঘেরাও করে। প্রথমে পায় একজন অতিশয় বৃদ্ধকে। সে লাঠি ভর দিয়ে হেঁটে আসছিল। তাকে সামনে পেয়ে ক্যাপটেন আব্বাস খান কোমর থেকে পিস্তল বের করে গুলি করে। বৃদ্ধ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাত-পা খিঁচিয়ে তখনই মারা যায়। সামনে পাওয়া বাড়ি-ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় মিলিটারিরা। খুঁজে খুঁজে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু করে। মমিনের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয় সবকিছু। মিলিটারিরা উল্লাস নিয়ে মমিনদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভাবখানা যেন মমিনকেই ওরা হাতে নাতে ধরেছে। মিলিটারি কয়েকজন যুবককে ধরে লাইনে দাঁড় করিয়ে তাদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। অধিকাংশ মানুষ বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে গেছে। মিলিটারি ইচ্ছেমতো তাণ্ডব চালিয়ে পাশের গ্রাম জগতগাঁতির দিকে এগিয়ে যায়। সেই গ্রামটা হিন্দু অধ্যুষিত। মিলিটারির সঙ্গে কয়েকজন রাজাকার এবং শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আফাজ উদ্দিনসহ অন্য সদস্যরাও রয়েছে। তারাই হিন্দুর বাড়িঘর চিনিয়ে দিচ্ছে। আর মিলিটারি মনের আনন্দে গান পাউডার ছিটিয়ে টিনের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
এলাকা জুড়ে থমথমে পরিবেশ। যুবকরা কেউ ভয়ে বাড়ি থাকে না। অনেকে এই অবস্থায় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে ভারতের দিকে রওনা হয়। ‘তাদের যুক্তি এমনেও মরণ ওমনেও মরণ। তাইলে মাইরাই মরি।’
মাসখানেক পর হাসপাতাল থেকে ফিরলো সাকিব। তার অসুস্থ মা বিছানা থেকে যে উঠতে পারে না সেও ছেলের এই অবস্থা দেখে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। সাকিবের চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ভাল করে হাঁটতেও পারে না। লিঙ্গের গোড়া কেটে দিয়েছে মুক্তিরা। এ জীবনে তার আর নারী সঙ্গ করা হবে না। বন্ধুর বোনকে কৌশলে ভোগ করার খেসারত হিসেবে তাকে চরম মূল্য দিতে হলো।
সাকিবের মা আয়েশা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘খোড়াইয়া হাটোস ক্যা বাজান? কুচকিতে কি অইছে?’
সাকিব সে কথা মাকে বলতে পারে না। মুক্তিবাহিনী তাকে হত্যা না করে তাকে জ্যান্ত-মৃত করে রেখেছে। তার যৌবন ধ্বংস করেছে। এখন সে খোজা। সম্রাটদের হেরেমের পুরুষদের মতো তাকেও খোজা করে দিয়েছে। এই কষ্ট সে কীভাবে সইবে? কীভাবে মাকে এই কথা সে জানাবে?
সাকিব মাথা নামিয়ে থাকে। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়াচ্ছে। মায়ের হাতে জলের ফোটা এসে পড়লে আয়েশা বেগম ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। বলে, ‘তখনই না করছিলাম। এটা পাপ। তোরা বাপবেটা কেউ আমার কথায় কান দিলি না। এখন স্বামীকে হারালাম। তুইও না থাকার মতো। বংশ রক্ষা হলো না আমাদের।’
মায়ের কান্নার সঙ্গে সাকিবও কান্নায় ভেঙে পড়ে। আয়েশা বেগম বলে, ‘তোর বাপকে মাইরা কোথায় ফালায়া দিছে?’
সাকিব বলে, ‘আমি জানি না মা। ওরা সারাক্ষণ আমার চোখ বাইন্ধা রাখছে।’
‘তাকে কি গুলি কইরা মারছে?’
‘না। ওরা কাউকে গুলি করে না। ওরা বলাবলি করতে ছিল গুলি ওদের খুব মূল্যবান সম্পদ। সম্ভব নদীর পাড়ে নিয়া সবাইকে জবাই করছে।’
‘তোর আব্বাকে কি ওরা খুব মারধর করছে?’
‘সাকিব দম নিয়ে বলে, ‘না। মারধর করে নাই। তবে মুখে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছে। আব্বা একবার শুধু বলেছে, আমি কারো ক্ষতি করি নাই। তখনই ফটাস করে চড়ের শব্দ হলো। একজন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো, ‘তাহলে তোর বাড়িতে মমিনের বোনকে জোর কইরা ধইরা রাখছোস ক্যা?’ তারপরই আব্বাকে নিয়ে যায় নদীর দিকে। বাকিদেরও একইভাবে নিয়ে যায়। শুধু আমাকে আলাদাভাবে বেঁধে রাখে। তারপর মুখে কাপড় গুজে দেয় যাতে আমি চিৎকার করতে না পারি।’ বলতে বলতে সাকিব কান্নায় ভেঙে পড়ে।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/