ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১৭
যারা যুদ্ধ করেছিল
রাজাকার আলিমের ভীষণ মন খারাপ। তার বউ খবর পাঠিয়েছে সে আর রাজাকারের সংসার করবে না। আলিম লোক পাঠিয়েছিল বউ আনতে। আলিমের বউ রুবিনা আসেনি। বলে দিয়েছে, ‘রাজাকারের সঙ্গে সে সংসার করবে না। কিছুদিনের মধ্যেই সে তালাকনামা পাঠিয়ে দেবে।’
এই খবরে আলিমের বুক পাথর হয়ে গেছে। তার সঙ্গীদের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য তাদের ডেকে পাঠিয়েছে। জহর এসেছে খবর পেয়েই। দেরি করছে বোকা-সোকা গেদু। জহর বলে, ‘গেদু আসলে আসুক। ডাকছো ক্যা সেই কথা কও। আমার টেনশন চলতাছে। আবার কোনো ঝামেলা হইছে না তো?’
আলিম ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, ‘তোর ভাবি আমারে কলা দেহাইছে। ভাইস্তা সলিমউল্লাহকে পাঠাইছিলাম তাকে আনতে। সে না কইরা দিছে। আসবে না।’
‘ক্যা?’
‘আমি রাজাকার। রাজাকারের সঙ্গে সে থাকবে না। কয়দিন বাদে নাকি তালাকনামা পাঠিয়ে দেবে।’
গেদু রাজাকার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। বলে, ‘এখন তুমি কী করতে চাও?’
‘কী করতে চাই, তার জন্যে পরামর্শ করতে তোদের ডাকছি।’
অনেক পরে গেদু আসে। বোকার মতো হাসছিল। আলিম কষে ধমক দেয়। ‘ব্যাক্কলের মতো হাসতাছস ক্যা? মনে খুব ফূর্তি লাগছে, না?’
গেদু হাসি থামিয়ে বলে, ‘চেইতো না ওস্তাদ। মেলাদিন তোমার বাড়ি খালি। ভাবি আসার আগে আরেকবার মজমা করলে ভালো হতো না? ভাবি আসলে কিন্তু এই সুযোগ আর পাইবা না।’
আলিম দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ‘কালিপদ মাস্টারের মাইয়ারে লাগাইয়া আউস মেটে নাই?’
গেদু বলে, ‘ওই মাখনের মতো শরীর একবার লাগাইয়া কি স্বাদ মেটে? শালার ক্যাপটেন আত্মা ভইরা খাইতাছে।’
‘তোর বোনকে লাগাইলে তোর মনে এমন ফূর্তি লাগত?’ আলিম এই কথার সঙ্গে গালাগাল করে উঠলে গেদু হতভম্ব মুখে তাকিয়ে থাকে। আলিম আবার বলে, ‘একবারও কি ভাইবা দেখছোস হৈমন্তির কেমন লাগতাছে?’
গেদু স্তম্ভিত মুখে আলিমকে বলে, ‘কী অইল ওস্তাদ, তুমি মেয়েটাকে ক্যাপটেনের হাতে দিয়া আইলা। এখন আবার উল্টা সুর গাইতাছ।
এবার মুখ খোলে জহর। বলে, ‘ওস্তাদের মুড অফ। ভাবি আসবে না বইলা দিছে।’
‘ক্যা আসবে না?’
জহর দম নিয়ে বলে, ‘রাজাকারের সঙ্গে ভাবি ঘর করবে না। এই ব্যাপার নিয়ে পরামর্শের জন্য ওস্তাদ আমাগো ডাকছে। আর তুই কি না আসলি গা ভাসাইয়া। আইসাই ঢংয়ের কথা শুরু করলি। ওস্তাদের কথা কী কমু। আমারইতো মেজাজ খারাপ অইছে। শোন, আর কথা না বাড়াইয়া এবার কামের কথা ক। কী করা যায় এখন। তাড়াতাড়ি বুদ্ধি বাইর কর।’
গেদু কেলাসের মতো হাসতে হাসতে বলে, ‘আমি কী বুদ্ধি বাইর করমু? আমার তো বুদ্ধি কম। সবাই আমারে কয় বেকুব। গাধা।’
আলিম ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, ‘দাঁত ক্যালায়া হাসিস না। মেজাজ বেশি খারাপ অইলে পাছার মধ্যে নল ঢুকায়া গুলি কইরা দিমু কইলাম।’
জহর বলে, ‘ওস্তাদ মাথা ঠান্ডা কর। ভাবির ব্যাপারে তুমি কী ভাবতাছো সেইটা আগে কও।’
আলিম বলে, ‘আমার মাথায় কিছু আসতাছে নারে। এই জন্যে তো তোদের খবর দিছি।’
গেদু বলে, ‘চল। কাইল গিয়া জোর কইরা তুইলা নিয়া আসি।’
আলিম মাথা নামিয়ে ছিল। মাথা তুলে বলল, ‘কথাটা মন্দ কস নাই। আমিও তাই ভাবছিলাম। কিন্তু ওদের বাড়ি আরেক জেলায়। এত দূরের পথ অস্ত্র নিয়া কীভাবে যাবি? পথে যদি মুক্তিবাহিনীর সাথে দেখা হয়ে যায়, তখন? বাপের দেওয়া জানটাতো খোয়াবি।’
‘খাঁটি কথা কইছ ওস্তাদ।’ গেদু বলে।
জহর বলে, ‘আমাকে একটু ভাবতে দেও। তোমরাও ভাব। একটা পথতো বাইর করতে অইব।’
সবাই বিছানায় গা এলিয়ে ভাবতে থাকে।
আলিম বলে, ‘ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমাইয়া যাইস না। মনে রাখিস, গুলি কিন্তু শেষ। আগামীকাল থানা সদরে যাইতে হবে গুলি আনতে।’
ভাবতে ভাবতে নাক ডাকার শব্দ শুরু হয়। প্রথমে গেদু রাজাকার। তারপর জহর, শেষে
আলিম। আলিম ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখতে পাচ্ছে তার স্ত্রী রুবিনা ফিরে এসে মিহি সুরে আলিম আলিম বলে ডাকছে। আলিম লাফিয়ে উঠে অন্ধকারে দরজা খুঁজতে থাকে। হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুঁজে পায়। দরজা খুলে ভূত দেখার মতো আলিম চমকে ওঠে। দরজার মুখে অনেকগুলো মানুষ। সবার মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা। আলিম কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার মুখ চেপে ধরে। তারপর বাকি দুজনকে ঘুমের মধ্যে হাত ও মুখ বেঁধে ফেলে। তারপর তিনজনকে দূরে ফাঁকা মাঠে নিয়ে যায়।
মমিন নিজের মুখের কাপড় সরিয়ে বলে, ‘চিনছোস আমাকে?’
‘মমিনভাই।’ বলেই আলিম রাজাকার মমিনের পা জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘মমিনভাই জান ভিক্ষা চাই।’
মমিন বলে, ‘পাবি। জান ভিক্ষা দিমু। আমরা যা বলি তুই যদি তাই করিস।’
আলিম সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘আপনারা যা বলবেন আমরা তাই করমু। তাও জানে মাইরেন না।’
মমিন বলে, ‘তাহলে চল। যেতে যেতে করণীয় বলছি তোকে।’
জহর ও গেদু রাজাকারকে কয়েকজনের পাহারায় রেখে আলিমকে নিয়ে মমিন ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
জহর ও গেদু ভাবে আগে ওরা আলিমকে মেরে তারপর ওদের মারবে। আজ কারও রক্ষা নাই। রাজাকার হওয়ার সাধ আজ জন্মের মতো মিটিয়ে দেবে।
আলিমকে যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছে সেইভাবে আলিম গিয়ে সাকিবকে মৃদু স্বরে ডাকে। সাকিব জেগে আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কে?’
আলিম বলে, ‘আমি আলিম। আলিম রাজাকার।’
‘এত রাতে কী চাস?’ সাকিব ধমকে ওঠে।
‘ভাই আস্তে কথা কন। জরুরি খবর আছে। ওঠেন।’
সাকিব দরজা খুলে বাইরে আসা মাত্র আড়াল থেকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বেরিয়ে এসে সাকিবের মুখ চেপে ধরে। তারপর গামছা মুখ বাঁধে। দড়ি দিয়ে দুই হাত পিঠমোড়া করে বাঁধে।
আলিম রাজাকার একই কায়দায় ফজলুর রহমানের ঘরের কাছে গিয়ে মোলায়েম স্বরে ডাকে। ‘চাচা, চাচা, চাচা কি জাইগা আছেন?’
বার কয়েক ডাকার পর ফজলুর রহমান গলা খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে। বলে, ‘কে ডাকে?’
‘আমি আলিম। আলিম রাজাকার।’
‘কী চাস?’
‘জরুরি খবর আছে চাচা। ওঠেন। বাইরে আসেন।’
‘এখন যা। সকালে আসিস।’
‘সকালে আসলে হবে না চাচা। তাইলে চিড়িয়া উইড়া যাবে। মমিন বাড়ি আইছে চাচা। এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।’
সবই আলিমকে শিখিয়ে দেওয়া। আলিম শুধু তোতা পাখির মতো শেখানো বুলি আওড়িয়ে যাচ্ছে। ফজলুর রহমান টর্চলাইট জ্বালিয়ে চোখ রগড়ে বাইরে আসে। বাইরে আসামাত্র কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আচমকা ফজলুর রহমানের মুখ চেপে ধরে। তারপর হাত ও চোখ বেঁধে নিয়ে আসে বাইরে। এইসময় মমিন রকিবকে ঈশারায় ডেকে পূর্বে শিখানো কথামতো কাজ করতে বলে। তারপর ফজলুর রহমান, সাকিব ও আলিমের মুখ ও চোখ বেঁধে বাইরে নিয়ে যায়। যেখানে জহর ও গেদু রাজাকারকে বেঁধে রাখা ছিল।
রকিব সাকিবের ঘরে ঢুকে সাথীকে মৃদু স্বরে ডাকতে থাকে। কোনো সাড়া না পেয়ে টর্চলাইট জ্বালিয়ে চারদিক খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে রকিব বলে, ‘সাথী আমি রকিব। মমিন ভাই এসেছে তোমাকে উদ্ধার করতে। তুমি ভয় পেও না। বেরিয়ে এস।’
সাথী এবার খাটের নিচে থেকে বেরিয়ে এসে রকিবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। রকিব বলে, কেঁদ না সাথী। এখন কাঁদার সময় না। চল, এখনই আমাদের এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।’
রকিবের সঙ্গে সাথী যেতে যেতে বলে, ‘ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হবে না? কতদিন ভাইয়াকে দেখি না। কেমন আছে আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়া?’
‘আমরা যেমন আছি। সেও তেমন আছে। দোয়া কর আমরা যেন পাকিস্তানি হায়েনাদের পরাজিত করে বীরের বেশে স্বাধীন দেশে ফিরতে পারি।’
করিম মিয়া ও রমিছা বিবি পোটলা-পুটিলি বেঁধে রেডি হয়ে ছিল। সাথী আসামাত্র তারা দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে।
খোলা মাঠে সবাই জমায়েত হলে দলের সিনিয়র ভাই হায়দার আলীকে মমিন বলে, ‘ভাই, এই লোকের নাম ফজলুর রহমান। শান্তি কমিটির মেম্বার। সে এই রাজাকারদের তৈরি করেছে। সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ করেছে এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কালিপদ রায় ও তার স্ত্রীকে হত্যা করে তার মেধাবী সুন্দরী মেয়েকে মিলিটারি ক্যাম্পে দিয়ে এসেছে। সেই জঘন্য কাজের সাহায্যকারী হলো এই রাজাকাররা। আর এই পিশাচের নাম সাকিব। তার কথাতো আপনাকে আগেই বলেছি। এখন তাদের কী শাস্তি দেওয়া যায় আপনি ভেবে ঠিক করেন। আমি একটু মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে আসি।’
গ্রামের পশ্চিম মাথায় একটি ঝাঁকড়া বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল রকিব, মমিনের মা-বাবা
ও বোন সাথী। মমিনকে দেখে রকিব মৃদু স্বরে আওয়াজ দেয়, ‘এই দিকে।’ মমিন কাছে
আসামাত্র সাথী ভাইকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
মমিন কান্না আটকিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘কাদিস না। কাঁদলে বুকের আগুন পানি হয়ে যায়। আগুন জ্বালিয়ে রাখ। বেঈমান সাকিবকে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছি। চরম প্রতিশোধ নেওয়া হবে। কাঁদিস না। ভাইয়ের জন্য দোয়া করিস। আমরা যেন স্বাধীন দেশে বীরের মতো মাথা উচুঁ করে ফিরতে পারি।’
মমিন বাবা-মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে। করিম মিয়া মমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে। রমিছা বিবি কিছু বলতে পারে না। শুধু কাঁদে।
মমিন বলে, ‘রকিব আর দেরি নয়। মা-বাবা আর সাথীকে তোর বোনের বাড়িতে রেখে কালবিলম্ব না করে সোজা রেলের ব্রিজের কাছে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হবি। যা দেরি করিস না।’
ওরা তবু যাচ্ছিল না। মমিন ধমক দিয়ে বলে, ‘দেরি করছিস কেন? কথা গায়ে লাগছে না?’ বলেই মমিন আবার হাঁটতে শুরু করলে তখন ওরা যেতে থাকে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মমিন কিছুক্ষণ মা-বাবার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, এই হয়তো শেষ দেখা। বাবা-মার সঙ্গে আর দেখা হবে কি না সেটা ভবিতব্য জানে।
মমিন দ্রুত হেঁটে এসে মূল দলের সঙ্গে যুক্ত হয়। দল তখন করতোয়া নদী পেরিয়ে গেছে। মমিন দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মজনুকে খুঁজে বের করে।
তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কার কী শাস্তি দিল হায়দার ভাই?’
মজনু বলে, ‘ফজলুর রহমানকে জবাই করে নদীর জলে ভাসায়ে দিছি। রাজাকারদেরও তাই করছি। সাকিবকে ভিন্নরকম সাজা দেওয়া হয়েছে।’
‘কী রকম?’ মমিন জিজ্ঞেস করে।
মজনু হাসি মুখে বলে, ‘ভীষণ মজার শাস্তি। ওর সোনা কেটে খোজা করা হইছে। আর চোখজোড়া উপড়ে ফেলছে। শালার ব্যাটা জ্যান্ত মরা হয়ে বাঁইচা থাক।’
মমিন গম্ভীর হয়ে থাকে। কোনো প্রতিক্রিয়া জানায় না। মজনু বলে, ‘ওস্তাদ, শাস্তি কি কম হইছে?’
‘না। বেশি হইছে।’
মজনু বলে, ‘সাকিব মহা অন্যায় করছে ওস্তাদ। হায়দার ভাই তার শাস্তির ব্যাপারে সবাইকে জিজ্ঞাসা করলে সবাই এই শাস্তির কথা বলে। এখন আপনি কন, ‘ওই হারামির বাচ্চা মানুষ হইলে বন্ধুর বোনের সাথে এই আকাম করতে পারত?’
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
যারা যুদ্ধ করেছিল: পর্ব- ১৬
এসএন