ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৪৪
নেই দেশের নাগরিক
“কীসের বাড়ি? বাড়ি থাকলেই তো যাবি?” সাদ্দাম চ্যাটাং করে ওঠে।
“বাড়ি থাক না থাক, জন্মেছি যখন তখন জন্মভিটে। সে ঘাটই হোক আর মাঠই হোক। আর জন্মভিটের টান কি কেউ কখনো অস্বীকার করতে পারে?”
“সব টানই একদিন বাসি হয়ে যায়, যদি মাঝে বাধা এসে পড়ে। সে বাধা প্রকৃতিরও হতে পারে। আবার মানুষেরও হতে পারে।“
“কিছু টান কখনই বাসি হয় না, বন্ধু। এই যেমন রক্তের টান, নাড়ির টান ঠিক তেমনই জন্মভিটের টান।“ কথায় আবেগ ঝরে পড়ে আতিফের। চোখমুখ নষ্টালজোয়িক হয়ে ওঠে। বেখেয়াল মনে এসে নাড়া বাঁধে আপনজনের স্মৃতি। জন্মভিটের বাৎসল্য। শিকড়ের বাঁধন।
“বাধা কোথায় নেই? এই যেমন দেখ, স্রোত কীভাবে বাধা সৃষ্টি করছে।“
“এত বাধা বাধা করছিস কেন বলতো? তুই কিন্তু আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছিস।“ সাদ্দামের দিকে চোখ ঘোরায় আতিফ।
“ওই যে বললাম, বাধা।“
“খুব দেখছি হেঁয়ালি শিখেছিস। কথায় কথায় প্যাঁচ। সত্যি করে বল তো, বিজিবির নয়াপাড়া সীমান্ত চৌকির ভেতরে কী ঘটেছে? তোর হাবভাব দেখে তখন থেকেই একটা সন্দেহ হচ্ছে। মেজর মহম্মদ আসলামের সাথে নিশ্চয় কিছু একটা ঘটিয়েছিস। তুই বললি, উনি দুটো জিনিসের একটা ছাড়া এতটুকুও মচকান না। হয় টাকা অথবা মেয়ে। কিন্তু তুই তো ওসব কিছু না নিয়ে গিয়েই, ওরকম দুঁদে সেনাঅফিসারকে পটিয়ে ফেললি! আমার তো অবাক লাগছে। কী করে উনাকে রাজি করলি বল তো? ব্যাপারটা জানার জন্যে আমার মন তখন থেকে উসখুস উসখুস করছে। তোকে এক-আধবার জিজ্ঞেসও করলাম। তুই এড়িয়ে গেলি। কথাটাকে অন্য কথা দিয়ে চেপে দিলি। এবার সত্যি কথাটা খুলে বল তো।“
“সব সমাধানের শেষ সমাধান।“ সাদ্দামের ঠোঁটে রহস্যের হাসি।
“মানে!” গাল টুস্কে চোখ ছোট করে বলল আতিফ।
“মানে, খুন।“ ফট করে বলল সাদ্দাম।
“খুন!” ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশ দেখল আতিফ। পেছনে চৌকির পাঁচিল পর্যন্ত দৃষ্টির জরিপ ফেলল। কেউ পেছনে তাড়া করে আসছে না তো!
“হ্যাঁ, খুন, শেষমেশ ওটাই করতে বাধ্য হলাম।“ জিভ দুমড়ে কথা বের করে দিল সাদ্দাম। তারপর চোখ বড় করে বলল, “উপায় ছিল না। খুনটা না করলে হয়ত বোটটা পেতাম না।“
“কিন্তু, তুই কাকে খুন করলি?” থুতনি উপরে তুলল আতিফ।
“যাকে না খুন করলে, কাজ হাসিল হতো না, তাকে।“
“মানে, মেজর মহম্মদ আসলামকে!”
“হ্যাঁ, মালটাকে একেবারে জানে মেরে দিয়েছি।“
“কিন্তু কেন?”
“আরে মালটা কোনোমতেই রাজি হচ্ছিলেন না, বার বার বলছিলেন, ওই খাড়া দুধওয়ালী মেয়েটাকে নিয়ে আয়। ওর বুকটায় একবার নাক ডুবিয়ে চাটি। শালার, মেয়ের উপর চরম নেশা। ওর প্রত্যেক রাতে একটা করে নতুন মেয়ে চাই-ই চাই। রোহিঙ্গা মেয়ে হলে, আরও ভালো। রোহিঙ্গা মেয়েদের শরীরে উনি নাকি জান্নাতের সুখ পান। আমি যতই বলছি, ও মেয়েটা পাচার হয়ে গেছে, ও কথা কানই করছিলেন না! একই কথা ঘ্যানর ঘ্যানর করে যাচ্ছিলেন। আসলে মালটা, মদে চুর হয়েছিলেন। বাইরের কোনো কথাই ওর কানে ঢুকছিল না। আমি এত করে বললাম, আপনাকে আগামীকাল অন্য একটা খাসা মেয়ে এনে দেব, ও সেসব গ্রাহ্যই করলেন না। উল্টে আমাকে লকআপে পুরে দেওয়ার ভয় দেখাতে লাগলেন। শেষে আমার মাথাটা আর থির থাকল না। মাথায় বিগেড় উঠে গেল। রাগে ঝিনঝিন করতে লাগল। ধীরে ধীরে আমার দাঁত নেকড়ের দাঁত হয়ে উঠতে লাগল। আমার নখে এসে জুড়তে লাগল, হায়েনার নখ। আমার চোখ হয়ে উঠতে লাগল জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মুখ। বেরিয়ে আসতে লাগল গনগনে লাভা। আমার মাথা তখন শূন্যে ভাসছে। মাথার ঘেলু বলছে, মার, মার, মার শালাকে। ভেতর থেকে কে যেন বলছে, যে রোহিঙ্গা মা-মেয়েদের শিয়াল কুত্তার মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়, তাকে এখনো জানে বাঁচিয়ে রেখেছিস? কলিজা চিপে জানটা বের করে নে। জিভটা ছিড়ে কুকুরকে খাইয়ে দে। আমি তখন ক্ষোভে পড়পড় করে পুড়ছি। খবিস অফিসারটাকে তখন চোখের সম্মুখে কোনো মানুষ মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, একজন ইবলিশ। উর্দির ভেকধারী একটা রাক্ষস। এক্ষনি চিবিয়ে খাই। পেটের মধ্যে ভুজালিটা চালিয়ে দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিই। বন্দুকের নলটা নলীতে ঠেকিয়ে, ‘ভড়াম’ করে ট্রিগারটা টিপে দিই। তারপর পরনের কাপড়টা খুলে ফেলে দিয়ে, যৌনাঙ্গটাতে ভ্যাকাম করে লাথি মারি। কলসা টিপে মুখ ফাঁক করে ছ্যাচ্ছ্যাড় করে মুতে দিয়ে বলি, খা, এবার খা, রোহিঙ্গার মুত খা, এতদিন শরীর খেয়েছিস, এবার মুত খা। তারপর ঘ্যাঁচ করে ভুজালি দিয়ে গলাটা জবাই করে মুণ্ডুটা আলাদা করে দিই।“
“তুই বলছিস কী!” চোখ কপালে আতিফের।
“হ্যাঁ, দিলামও তাই। পাশের টেবিলে রাখা তার ভুজালি দিয়েই তার গলাটা কেটে দুই ভাগ করে দিলাম। অবশ্য তার আগে নিজের কাজটা হাসিল করে নিলাম। গলায় ভুজালি ধরে, বোট ম্যানেজারকে একটা ফোন করিয়ে নিলাম। ওর মুখ দিয়ে আমার মুখের কথা বলিয়ে নিলাম। মালটা কুঁত পেরে পেরে বোট ম্যানেজারকে আমার নাম করে বললেন, একটা স্পিডবোট দিয়ে দিতে। বোট ম্যানেজার আমার আগে থেকেই চেনা। এর আগে অনেকবার ওর কাছে এসেছি। সেসবই অবশ্য মেজর আসলামের দৌলতে। ফোনে কথা বলে শেষ হলেই, মালটাকে পরলোকে পাঠিয়ে দিলাম। গালি দিয়ে বললাম, যা এবার জাহান্নামের আগুনে পুড় গা।“
“জানে না মারলেও তো পারতিস?” একবার ঘুঘুপাখির মতো পেছনে তাকিয়ে বলল আতিফ।
“তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এত কিছুর পর ওঁকে বাঁচিয়ে রাখা মানে, সাক্ষাত আজরাইলকে কাঁধে চাপিয়ে নেওয়া। মনে রাখিস, আহত বাঘ সব থেকে ভয়ংকর! একটু সুযোগ পেলেই ‘হালুম’ করে উঠবেই।“
“কিন্তু, এতে তো তোর আগামী দিনে এখানে টিকে থাকা মুশকিল হবে। বিজিবি তো সব জেনে যাবে। তুই যেহেতু ওদের চেনা লোক, ফলে তোর এখানে গোপন করে থাকাও মুশকিল হবে।“
“সে, দেখা যাবে, আগে চাচাদের তো উদ্ধার করি।“ বোটের স্পিড আরও বাড়িয়ে দেয় সাদ্দাম।
হাঙর মাছের মতো সাঁ সাঁ করে ছুটে চলে বঙ্গোপসাগরের দিকে। রাত পাড় থেকে উধাও হলেও নদীতে সাদা কুয়াশার জাল বিছিয়ে শেষ তল্পিতল্পা গুটোচ্ছে। শেষ ভোরের হলুদ আলো দিগন্ত থেকে ঠিকরে পড়ছে নদীর থলথলে বুকে। দূরের হলুদাভ দিগন্ত যেন নদী থেকে ঝুপ মেরে স্নান সেরে উঠছে। রঙিন দিগন্ত মাথা ঝুকে নদীর সাথে যেন ফিসফিস করে কী সব কথা বলছে। একটা দুটো পাখি ডানা মেলে আকাশ ফুঁড়ে মিশে যাচ্ছে আকাশের নীলে। নদীর পুবপারে টহল দিচ্ছে মায়ানমার সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর ট্রলার। সেনাবোট। সেসবের মাথায় পতপত করে উড়ছে মায়ানমারের জাতীয় পতাকা। আতিফ একবার পূর্বপারে চোখ ফেলছে আবার একবার সুচের মতো কুয়াশা ভেদ করে দৃষ্টি হাংছে দূরের নৌকোসারির দিকে। দুদিকই তাকে হুহু করে টানছে। একদিকে জন্মভূমি আর একদিকে আপনজন। শূন্য নদীর ওপরে এক সব হারানো সন্তান, জীবন থেকে ছেড়ে যাওয়া জীবনকে পাওয়ার তাড়নায় হন্যে হয়ে ছুটছে। চোখে দেখে মনে হচ্ছে, সবই হাতের নাগালের মধ্যে, হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। কিন্তু, সেসব অনেক দূর। মন থেকে এতটুকু দূর না হলেও, হাতের স্পর্শ থেকে কয়েক চীন দূরে। ওই যে সারি সারি রোহিঙ্গা নৌকো কলোনি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে নদীর উপর, তার মধ্যে আদৌ কি তাদের বাড়ির নৌকোটা আছে? ওই যেমন দূরের জন্মভূমি থেকেও নেই, ঠিক তেমনই ‘ঘাট বাড়ি কৌশা’ নৌকোটা না থাকতেও তো পারে। অথবা নৌকোটা হয়ত আছে, কিন্তু নৌকোর সওয়ারিগুলো হয়ত আর কেউ বেঁচে নেই! আশ্বিনের ঝড়ে জলের রাক্ষুসে স্রোতে ভেসে অচীনদেশে চলে গেছে!
“ডানদিক স্লো করে চল।“ ডানদিকের পাড়ে থোক থোক কিছু নৌকো দাঁড় করানো দেখে আতিফ সাদ্দামকে সেদিকে স্পিড বোটটা নিয়ে যেতে বলল। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে, নবীকে একটা ফোন লাগাল।
এ ফাঁড়া স্বয়ং আল্লাহ নিজে হাতে বাঁচিয়ে দিলেন। তা না হলে যেভাবে হুমড়ি খেয়ে জলে পড়েছিল নুহু তাতে জানে বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনায় ছিল না তার। আসলে, রাখে খোদা মারে কে। তবে মতির কাছে আচ্ছা ঝাড় খেল নুহু।
নুহু কাকভেজা গায়ে হলহল করে হালতে হালতে তিড়বিড় করে না উঠলেও, বিড়বিড় করে বলেছিল, ঝড়টা কি আমি ফুঁ দিয়ে বানালাম? না আমি মেঘ কেটে বৃষ্টি আনলাম? হাওয়াটা কোথা থেকে জট পাকিয়ে বাউন্ডুলে হয়ে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো ধেয়ে এল তো আমি কী ল্যাওড়া করব? আমি কি আল্লাহর ফেরেশতা যে হাত দিয়ে আটকে দেব? না, আল্লাহর নবী মুসা, যে লাঠি উঁচিয়ে পাগলা ঝড়কে বলব, এই থাম, আর অমনি ঝড়টা থেমে যাবে? নুহুর একটা পা কোনোমতে নৌকোর তলার খাঁচে ভাগ্যিস আটকে গেছিল, না হলে ব্যাচারি জলের তোড়ে ভেসে যেত। জড়িবুটির মতো তার ডানপাটা আটকে না গেলে, সে এতক্ষণে মাছের খাবার হয়ে যেত।
“কোথায় এসেছি রে, কিছুই তো বুঝতে পারছি ন্যা! আশপাশে একটাও নৌকো চোখে পড়ছে না!” ঝড়ে মোচড়ানো নৌকোর চুপসানো দুমড়ানো ছইটাকে বুক দিয়ে ঠেলে খাড়া করতে করতে কুঁত পেরে বলল মতি। নুহু দূরের ঝাপসা একটা জাহাজ দেখিয়ে বলল, “ওই দ্যাখো কত বড় জাহাজ! কালাপানিতে ভাসছে। জাহাজ দেখে মনে হচ্ছে, সাগরের মুখে চলে এসেছি!”
“তাইই হবে, তা না হলে আশেপাশেও কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, আবার এপারও দেখা যাচ্ছে না ওপারও দেখা যাচ্ছে না! শুধু ধুধু পানি আর পানি!“ একটা বাতাকে দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে টাইট দিল মতি। ‘কট’ করে বাঁধনের শব্দ হলো। নুহু দাঁত চিপে একটা বাঁশের চাঁছিকে বেঁকিয়ে ছইয়ের খাঁজে পুরে দিল। চাঁছিটা বাঁধন ছিঁড়ে খাড়া হয়ে বেরিয়ে গেছিল। চাঁছিটাকে ঠেসে পুরতে পুরতে বলল, “তাড়াতাড়ি নয়াপাড়ার দিকে চল, অন্যসব নৌকোর কলোনিতে ভিড়তে হবে। ঠোঙার মতো টিমটিম করে একা পড়ে থাকলে, ত্রাণের কানাকড়িও কপালে জুটবে না! কোনো হেলিকপ্টারের চোখেও সুজবে না। খাবারপানি না পেলে কী করে বেঁচে থাকব? নৌকোয় যা ছিল, তা সবই তো প্রায় ফুরোনোর দিকে।“
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
এসএন