ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১২
যারা যুদ্ধ করেছিল
সবাইকে লাইনে দাঁড় করায়। তাদের পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলার নির্দেশ দেওয়া মাত্র সঙ্গে সঙ্গে তাদের বেঁধে ফেলা হয়। তাদের অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করার নির্দেশ দেন তিনি। অনেকগুলো ভারী অস্ত্র পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভীষণ খুশি। যাদের বন্দি করা হলো তাদের তাৎক্ষণিক কী করা হবে তাই নিয়ে গ্রুপ কমান্ডারদের মধ্যে শলাপরামর্শ শুরু হলো। সিদ্ধান্ত হলো তাদের হত্যা করে মাটি চাপা দেবে। তাই করা হলো। ওদের কিছু বুঝতে না দিয়ে সবার পেছনে বেয়োনেট হাতে একজন করে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে তাদের হত্যা করে সঙ্গে সঙ্গে মাটি চাপা দেওয়া হলো।
এ ব্যাপারে পাশের গ্রামের লোকজন এসে সাহায্য করতে লাগল। তারা ভীষণ আনন্দিত। একসঙ্গে এতগুলো পাকিস্তানি মিলিটারি ধরা পড়েছে তাদের কাছে বিরাট গর্বের ব্যাপার। যুদ্ধ শেষ না হতেই কোত্থেকে এই লোকগুলো হুড়মুড় করে ছুটে এসেছে সেটাই ভাবনার ব্যাপার। মুহূর্তে গাঁয়ের লোকজন রাজাকারসহ মিলিটারিদের মাটি চাপা দিয়ে দেয়। কেউ কেউ বলছিল তাদের বন্দি করে নিয়ে যেতে। শুনে ধমকে ওঠেন কমান্ডার মোজাফ্ফর। বলেন, ‘বন্দি করে কোথায় নিয়ে যাবে? আমাদের নিজেদেরই নিরাপত্তা নেই। খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই। তার উপর এই বন্দিদের নিয়ে আমরা কোথায় যাব? আমাদের কি জেলখানা আছে? তাদের খেতে দেবে কে? আমাদের নিজেদেরই খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। অতএব যা বলছি তাই কর।’
ওদের মাটিচাপা দেওয়ার পর-পরই মজনু দৌড়ে এসে মমিনকে বলে, ‘ওস্তাদ সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমিনের হাতে গুলি লেগেছে।’
মমিন ছুটে যায় আমিনের কাছে। আমিন গেরিলা দলে ছিল। দুর্দান্ত সাহসী যুবক। তার হাতে গুলে লেগে গুলি ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে পাশের গ্রামের দিকে ছুটতে থাকে মমিন। সঙ্গে আরও কয়েকজন। শুনেছে ওই গ্রামে একজন ভালো ডাক্তার আছে। সবাই সেইদিকে ছুটতে থাকে।
১০.
সাথী মেয়েটাকে দেখে ফজলুর রহমানের মাথার মধ্যে কুনি পোকা কুর কুর করে কামড়াতে থাকে। কচি শষার মতো লকলকে শরীর। বুকজোড়া বেশ ডাসা। এমন কচি জিনিস বছরে এক দুবার খেলে জীবন ধন্য। আহা! হুরের স্বাদ পাওয়া যাবে। আর না হোক সুযোগ পেলে মেয়েটাকে দিয়ে হাত পা টিপে নিলেও পরানটা ঠান্ডা হবে।
আয়েশা বেগম সারারাত কোমরের ব্যথায় ছটফট করে, গোংড়ায়। একদম ঘুমোতে পারে না। ঘুমটা তার আসে দিনের বেলা। সকালে এক গ্লাস লেবুর শরবত খেয়ে সেই যে কাত হয়ে পড়ে থাকে না জাগালে আর জাগে না। ফজলুর রহমান থানা সদর থেকে বাড়িতে এসে সাথীকে ঘরে দেখে তার ভেতর যৌন অনুভূতি তীব্র হয়ে ওঠে। ইশারায় কাছে ডাকে। খেয়াল করে বউ আয়েশা বেগমের অবস্থা কী। জেগে আছে না ঘুমিয়ে গেছে।
কায়দা করে কথা শুরু করে ফজলুর রহমান। বলে, ‘তোমার চাচির কী অবস্থা? আজ কেমন আছে?’
সাথী মৃদু স্বরে বলে, ‘আজ চাচিআম্মা বেশ ভালো। সকালে ভাত খেয়েছে। এখন ঘুমোচ্ছে।’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ ফজলুর রহমান শব্দ করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। তারপর তার অভিনয় শুরু হয়। বলে, ‘তোমার চাচির খবর তো ভালোই দিলা। কিন্তু আমার খবর তো ভালো না।’
‘কেন, কী হয়েছে আপনার?’
‘মিলিটারিদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করেছি কয়েক ঘণ্টা। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।’ কথাটা বলে ফজলুর রহমান সাথীর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে। সে আশা করছে সাথী এখনই বলুক, ‘আসুন চাচা আমি আপনার মাথা টিপে দেই।’
কিন্তু এমন কোনো কথা সাথী বলে না। সে মাথা নামিয়ে থাকে। ফজলুর রহমানের মেজাজ খারাপ হতে থাকে। ইচ্ছা করছে জাপটে ধরে সাথীকে। ধরে বিছানায় নিয়ে যায়। ফজলুর রহমান অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে। হাসি মুখে বলে, ‘তুমি কি একটু আমার মাথাটা টিপে দিতে পারবে?’ বলেই ফজলুর রহমান পাশের বিছানায় শুয়ে পড়ে। মাথা ধরে গড়াগড়ি দিতে থাকে। সাথী ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। বাড়িতে এইসময় সাকিব থাকে না। ফজলুর রহমান সুযোগটা সেই হিসেবে নিয়েছে। সাথীর গা ঘিন ঘিন করছিল। তবু সে ফজলুর রহমানের মাথা টিপে দিতে থাকে। ভেতরে ভেতরে তার কান্নার ঠমক উথলে উঠছিল। কিন্তু সে নিরূপায়। ফজলুর রহমান চোখ বুজে আবেশে মজা নিচ্ছে। এইসময় আয়েশা বেগমের ঘুম ছুটে যায়। পাশের খাটে ফজলুর রহমান আর সাথীকে দেখে সে ধমকে ওঠে। ‘কী করেন আপনি?’
ফজলুর রহমান থতো-মতো করে বলে, না কিছু না। যন্ত্রণায় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। ওকে দিয়া মাথাটা টিপে নিচ্ছিলাম।’
‘বাপ বেটা ভালো ব্যবসা শুরু করেছেন। মিলিটারির বাহানা দিয়ে যা শুরু করছেন এই পাপ আল্লাহ মাফ করবে না।’
‘কী যা-তা কও। তোমার কী মাথা খারাপ হলো?’ রাগত বলে ফজলুর রহমান।
আয়েশা বেগমও রাগত বলে, ‘আপনাকে আমারে নতুন করে চেনাতে আইছেন? আমি আপনাকে চিনি না?’
‘তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করতাছ। জানো এর পরিণাম?’
‘আমার এক পা কব্বরে। আমারে পরিণামের ভয় দেখাইয়েন না। পরিণামের ভয় আপনি করেন। পাপ কইলাম বাপকেও ক্ষমা করে না।’
ধপাস করে দরোজায় আঘাত করে ফজলুর রহমান বেরিয়ে যায়। তার আগেই বেরিয়ে গেছে সাথী। সে ঠিক করেছে এই বাড়িতে সে আসবে না। কপালে যা থাকে তাই হবে। বাড়িতে এসে ঘরের দরোজা বন্ধ করে কাগজ কলম নিয়ে সে লিখতে বসে। দ্রুত সে লিখতে থাকে। লেখা শেষ করে কাগজটি ভাঁজ করে ঘরের বাতায় লুকিয়ে রাখে। তারপর সে ভেবে চিন্তে ফজলুর রহমানের বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।
করিম মিয়া রাতে খেতে বসে। ভাতের অবস্থা দেখে লম্বা করে শ্বাস ফেলে। ভাবে মেয়েটা ওই বাড়িতে গিয়া ভালোই করেছে। অন্তত ভাতের কষ্ট করতে হচ্ছে না।
করিম মিয়া ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আর কিছু নাই?’
রমিছা বিবি হতাশ কণ্ঠে বলে, ‘আর কী থাকব? আমি কি চুরি কইরা আনমু?’
‘চুরির কথা কইতাছি না সাথীর মা। কাম কাজ নাই। ঘরে খাওয়াও নাই। কী যে গজব শুরু অইছে। আল্লাহ কপালে যে কী লেইখা রাখছে সেই জানে।’
এইসময় উঠোনে মৃদু কণ্ঠে সাথীর নাম ধরে কে যেন ডাকে। করিম মিয়া জিজ্ঞেস করে, ‘কে?’
কণ্ঠস্বরটি বলে, ‘খালুজান আমি রকিব।’
রমিছা বিবি কুপি বাতি হাতে বেরিয়ে আসে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। একজন মাঝারি গোছের যুবক গায়ে কালো চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রমিছা বিবি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কে বাবা তুমি?’
যুবক অবাক কণ্ঠে বলে, ‘খালা আমাকে চিনতে পারতাছেন না? আমি রকিব।’
‘তোমার এ অবস্থা ক্যা? এত গরমের মধ্যে চাদর গায়ে দিয়া আছ ক্যা?’
রকিবের চাদরের আড়ালে স্টেনগান লুকানো। সেটা সে বলতে চাচ্ছিল না।
শুধু বলে, ‘সে কথা পরে হুইনেন। আগে কন আপনারা কেমন আছেন?’
রমিছা বিবি জবাব না দিয়ে কেঁদে ফেলে। কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে রকিবকে ঘরে নিয়ে আসে। রকিব জিজ্ঞেস করে, ‘খালুজান, কেমন আছেন?’
‘ভালো নাই বাবা। কোনোমতে বাঁইচা আছি। আমার মমিনের কোনো খবর জানো তুমি? কোথায় কেমন আছে?’
‘ভালো আছে।’
তুমি কেমনে জানলা?’ করিম মিয়া আশ্চর্য হয়ে তাকায়।
রকিব মাথা নামিয়ে থাকে। নিচু স্বরে বলে। আমি ও মমিনভাই একই দলে আছি। সে আমাদের দলের কমান্ডার। সেই আমাকে আপনাদের খবর নিতে পাঠাইছে।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন-
এসএন