ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১১
যারা যুদ্ধ করেছিল
সন্ধ্যা থেকে সবাই প্রস্তুত। আজ বড় অপারেশন করতে যাচ্ছে তারা। একটি হাইস্কুলে তারা আক্রমণ করবে। সেখানে শ’খানেক মিলিটারি, জনা পঞ্চাশেক রাজাকার আর পাঞ্জাবি পুলিশ আছে বিশ-পঁচিশ জন। তারা সুযোগ পেলেই গ্রামে এসে গরু-ছাগল এবং যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়।
মোজাফফরের দল আর মমিনের দল আবার একসঙ্গে অপারেশন করতে একত্রিত হয়েছে। আজ তারা বজ্রকঠিন শপথ নিয়েছে। পরিকল্পনা করেছে পুঙ্খানুপুঙ্খ। স্কুলের পাশ দিয়ে উঁচু রাস্তা চলে গেছে। লোকজন বলে ওয়াপদার বাঁধ। ওই বাঁধের আড়ালে পজিশন নেবে মূল দল। দক্ষিণ পাশে থাকবে আরেকটি দল। স্কুলের উত্তরে আখের ক্ষেত। ওখানে কয়েকজন দুর্ধর্ষ গেরিলা থাকবে। তাদের হাতে থাকবে গ্রেনেড। তারা নির্দেশ পাওয়া মাত্র ক্রোলিং করে গিয়ে পাকিস্তানিদের বাংকারে গ্রেনেড ছুড়বে।
রাত তিনটে। চারদিকে নিঝুম নিস্তব্ধতা। দূরে একটি রাতজাগা পাখি ডেকে উঠলে সে আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যায়। নির্দেশ মতো সবাই নিঃশব্দে যার যার মতো পজিশন নেয়। তারপর বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ফায়ার। আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী হকচকিয়ে গেলেও একটু পর তারা বাংকার থেকে ফায়ার শুরু করে। রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে মেশিনগানের বিকট শব্দে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর চেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি ছুড়ছে বৃষ্টির মতো। টানা ফায়ার চলে আধা ঘণ্টা। তারপর দু’পক্ষই চুপ। এটাও যুদ্ধের কৌশল। শত্রুপক্ষের অবস্থান বোঝার জন্য ফায়ার বন্ধ করে অবস্থা বুঝতে হয়। টানা গোলাগুলির পর এতটাই নীরবতা নেমে আসল যে দূরের ফিসফাস কথাও স্পষ্ট শোনা যায়। এই সময় পাকিস্তানি মিলিটারিরা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে ধ্বনি দিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি।
জয়বাংলা ধ্বনির পর পরই পাকিস্তানি মিলিটারি গালাগালি করতে থাকে। পাল্টা মুক্তিবাহিনীও গালাগাল করতে থাকে। যুদ্ধের এই ব্যাপারটা মজনুর ভীষণ মজা লাগে। সে সিনেমায় দেখেছে তলোয়ার দিয়ে যখন যুদ্ধ হতো তখন দুজন সৈন্য থাকত কাছাকাছি। তারা নানা রকম গরম গরম কথা বলে একে অন্যকে আক্রমণ করত। আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে যুদ্ধেও পরস্পরের কথা বিনিময় হয়- এটাই মজনুর বিস্ময়ের কারণ।
পাকিস্তানিরা মা-বাপ তুলে বেশি গালাগাল দেয়। ‘মাদারচোদ’, ‘বার্স্টাড’, ‘মালাউন কা বাচ্চা’। এই শব্দগুলোর মানে আগে জানত না মজনু। মমিনের কাছ থেকে জেনেছে এসব খুব খারাপ-খারাপ গাল। মুক্তিবাহিনী গাল দেয় বাংলায়। সেটাও খুব খারাপ। ‘কুত্তার বাচ্চা’, ‘তোর মারেরে......’ যুদ্ধে যে কত কী হয় যুদ্ধ যারা করেনি তারা বুঝবে না।
মজনু ফিস ফিস করে বলে, ‘মালাউন কা বাচ্চার’ জবাবে কী কমু ওস্তাদ?’ মমিন খানিক ভাবে। তারপর বলে, ‘বলো, জাহেল কা বাচ্চা’। ‘মানে কী?’ মজনু জিজ্ঞেস করে। মমিন বলে, ‘জাহেল একজন খারাপ মানুষের নাম।’ নবীজী তার নাম দিয়েছিল ‘আবু জেহেল’।
পাকিস্তানি মিলিটারি যখন ‘মালাউন কা বাচ্চা’ বলছিল মজনু তখন গলা ফাটিয়ে ‘জাহেল কা বাচ্চা’ বলতে থাকে। এরই মধ্যে কমান্ডারের নির্দেষ এলো মমিনের কাছে। কমান্ডার মোজাফফর খবর পাঠিয়েছেন, আর কালবিলম্ব না করে গেরিলা বাহিনী পাঠাতে বলেছেন।
কিছুক্ষণ দুই পক্ষের মধ্যে গালাগাল বিনিময় হয়। তারপর আবার শুরু হয় গোলাগুলি। এইবার গোলাগুলির মধ্যে মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা ক্রোলিং করে পাকিস্তানি সেনাদের বাংকারের কাছে গিয়ে গ্রেনেড ছুড়বে। ভয়ংকর বিপজ্জনক কাজ। প্রাণ হাতে নিয়ে যেতে হবে। যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বিশেষ করে ক্রোলিং করার সময় পাকিস্তারিা যদি টের পায় তাহলে হাতে নাতে ধরা পড়ার ভয় আছে। এবার আর গুলি থামানো যাবে না। গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে গেরিলারা ক্রোলিং করে যাবে। তাতে বাইরে থেকে শব্দ বুঝতে পারবে না পাকিস্তানি মিলিটারিরা।
স্কুলের পেছনে আখক্ষেত। সেই আখক্ষেতের ভেতর দিয়ে সাপের মতো এঁকে-বেঁকে গেরিলারা এগিয়ে যাচ্ছে। বাঁধের আড়ালে যারা পজিশন নিয়েছে তারা ক্রমাগত ফায়ার করে যাবে। তবে এলোমেলোভাবে গুলি ছোড়া যাবে না। মুক্তিবাহিনীর হিসেব করা গুলি। তারা পাকিস্তানি মিলিটারির ন্যায় বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে পারে না। এতো গুলি তাদের নেই।
অনেকক্ষণ হয়ে গেল। গ্রেনেড ফাটার আওয়াজ আসছে না। মমিন চিন্তিত হয়ে পড়ে। এতক্ষণ তো লাগার কথা না। তাহলে কি কোনো বিপদ হলো? মমিন ফায়ার না দিয়ে ভাবতে থাকে। গোলাগুলি বেড়ে চলেছে। মমিন খেয়াল করে মজনু কাত হয়ে পড়ে আছে। মমিনের আত্মা ধক করে ওঠে। তবে কি গুলি খেয়ে মজনু শহীদ হয়ে গেল? মমিন
ক্রোলিং করে মজনুর কাছে যায়। গায়ে হাত দিয়ে মৃদু স্বরে ডাকে, মজনু। মজনু ধুচমুচ করে পাশ ফিরে তাকায়। বলে, ‘কী অইছে ওস্তাদ?’
‘কিছু হয় নাই। তুমি ঠিক আছো তো?’
‘জ্বি ঠিক আছি।’
‘তুমি কাত হয়ে পড়ে আছো তাই ভাবলাম গুলি টুলি লাগল কি না?’
মজনু বলে, ‘হয়রান হয়ে গেছি ওস্তাদ। রাইফেল কোনো ভালো অস্ত্র না। এটা দিয়ে দুই মিনিট যুদ্ধ করলে শরীলে আর বল পাওয়া যায় না। শরীল আইপসা আসে।’
‘ঠিকই বলেছ। রাইফেল কোনো আধুনিক অস্ত্র না। কী আর করা। আমাদের তো এর চেয়ে ভালো অস্ত্র নাই।’
মমিন কথা বলতে বলতে এসএলআর এ আরও একটি ম্যাগাজিন লোড করে। তারপর খেয়াল করে টার্গেট করে। খুব বেশি দূরে নেই পাকিস্তানি মিলিটারিরা। তাদের অস্ত্রের নল থেকে যে আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে তাতে বোঝা যায় শত্রুপক্ষ নিকটেই আছে। মমিন টার্গেট ঠিক করছে। এই সময় পরপর কয়েকটি গ্রেনেড ব্রাস্ট হওয়ার শব্দ চারপাশ কাঁপিয়ে তুলল। সঙ্গে সঙ্গে মমিনরা জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে গেরিলাদের স্বাগত জানাল।
পরেরবার গ্রেনেড ব্রাস্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি মিলিটারিদের আর্তনাদ ভেসে আসতে লাগল। তারা ভীষণ শব্দ করে ‘হে আল্লাহ রহম করেগা’, ‘হে আল্লাহ রহম করেগা’ বলে চিৎকার করছে। আর জোরে জোরে দোয়া দরুদ পড়ছে। একজনের কণ্ঠে কোরআনের আয়াত শোনা গেল। সে শব্দ করে সুরা ইয়াসিন পাঠ করছে। আবার গ্রেনেড ফাটার শব্দ। পাকিস্তানি মিলিটারিদের আর্তনাদের পাল্লা আরও ভারী হয়ে ওঠে। আর মমিনদের আনন্দ উল্লাস এবং জয়বাংলা ধ্বনি আকাশ বাতাস কাঁপাতে থাকে।
পাকিস্তানিদের গোলাগুলি থেমে গেছে। তারা আত্মরক্ষার জন্য পালাবার পথ খুঁজছে। কিন্তু সে পথ আপাতত বন্ধ। চারদিক থেকে ছুটছে গুলি। আর বাংকারে পড়ছে গ্রেনেড। উপায় নেই। আজ তাদের খতম তারাবি পড়ানো হবে। এটা তারা বুঝে গেছে। আকাশ ক্রমশ ফর্সা হচ্ছে। দূরের গ্রামের মসজিদে হয়তো আজান হয়েছে। গোলাগুলির শব্দে আজানের ধ্বনি শোনা যায়নি। ভয়ে মোয়াজ্জিন সাহেব পালিয়ে গেছে কি না তাই বা কে জানে। ভোরের সূর্য উঠছে ডগমগ হয়ে। মমিন দেখতে পেল কমান্ডার মোজাফফর তার দলবল নিয়ে ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প এবং সে চিৎকার করে বলছে ‘সারেন্ডার কর। নইলে সবাইকে খতম করা হবে।’
এই দৃশ্য দেখে মমিন তার বাহিনী নিয়ে ক্যাম্পের দিকে এগুতে থাকে। পাকিস্তানি মিলিটারি অস্ত্র ফেলে হাত উপরে তুলে সামনে এসে দাঁড়াতে থাকে। অধিকাংশ পাকসেনা আহত এবং রক্তাক্ত। একই লাইনে এসে রাজাকাররা এসে দাঁড়ালে তাদের আলাদাভাবে দাঁড় করায় কমান্ডার মোজাফফর। রাজাকারদের কাঁপাকাঁপি দেখে মুক্তিযোদ্ধারা হাসতে থাকে। ভয়ে দু’একজন কাপড় নষ্ট করে ফেলে।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন-