মধ্যনগরের নাও
মধ্যনগরের নাও
নুরুন্নাহার আপার বাড়ি যেতে হবে
নুরুন্নাহার আপার বাড়ির পাশে অনেক অনেক জলাশয়
অনেক হাওর- সেই সব হাওরের জলে জ্বিন-লাগা মাছ আর
পরি-লাগা পাখিদের বাস, সেখানে সুপারি গাছের গায়ে পানপাতা
সেখানে পাহাড়ে বনে বনে বনৌষধি
সঞ্জীবনী গাছের শিকড়, যা শুধু গফর গাঁওয়ের ডাকাতেরা চেনে
সাভারের সাপুড়েরা জানে বিষহরি বৃক্ষের শিকড় কোথায় আছে
স্ফটিক জলের নিচে মাছেরা ঘুমায়
শিকড়, বাকড়, ঘাস রঙিন মাছ আর তৃণের শরীর
হিজল করচ থাকে গলাজলে
সারাটা সময় শুধু স্বপ্নের সাঁতার
সে এক রহস্যময় দেশে
নুরুন্নাহার আপার বাড়িতে টিনের চালের পর বৃষ্টির ক্রন্দন
সারারাত মরমি সুরের মাঝে তার ছেলেরা হারায়
আর কাক জোছনায় নুরুন্নাহার আপার মেয়েরা
ঘরেই থাকে না, লাকিমনি জোনাকিরা সুর তোলে বাতাসে বাতাসে
রাতের আকাশে
‘মধ্যনগর! মধ্যনগর!’ ডাক তোলে সুনামগঞ্জের ঘাটে এসে গয়নার নাও
মন বলে ভেসে যাই
রাতে জেগে ভোরে উঠি হাওরের মাঝখানে
নুরুন্নাহার আপার জলে ভাসমান ঘরে
তখন অনেক কাজ, পৃথিবী বদলে দিতে
তখন ‘জয় বাংলা বাংলার জয়,’ তখন এ
পৃথিবীতে আর কোনো দুঃখ থাকবে না
পৃথিবীতে আর কোনো শোকতাপ থাকবে না
তখন পৃথিবী বদলানোর জন্য আমার ঘুম আসে না
ঘাটে এসে নৌকা ডাকে :‘মধ্যনগর! মধ্যনগর!’
আমার কখনো আর যাওয়া হয় না
তারপর একদিন পৃথিবীর সব কাজ শেষে
দীর্ঘশ্বাসে পুনরায় ঘাটে আসি একাকী মানুষ
গয়নার নাও খুঁজি, ঘাটে ঘাটে মাঝি খুঁজি
সারাদিন অপেক্ষায় থাকি, সারারাত-
গয়নার নাও নেই, বজরার ছই নেই
বিরান ঘাটের কাছে ভাঙা এক নৌকা নিয়ে বসেছেন সে এক প্রবীণ মাঝি
দু’হাটুর মাঝখানে মাথা রেখে ত্রিকালদর্শীর মতো এক ঋষি বসেছেন
তার কাছে কাকুতি মিনতি করি ‘মধ্যনগর যাবেন আপনি?’
তিনি যাত্রীদের আহ্বান জানাতে বলেন
‘ন্যূনতম কুড়িজন
নাহলে এ নৌকা ঘাট ছেড়ে কখনো যাবে না’
আমি চিৎকার করি : ‘মধ্যনগর! মধ্যনগর!’
কোথাও কোনো মানুষের ছায়া নেই
আমি আর্তনাদ করি মাঝরাতে মরমিয়া ঘাটে :
‘মধ্যনগর! মধ্যনগর ! মধ্যনগর কি কেউ যাবে?’
শব্দহীন, ছায়াহীন, কায়াহীন ঘাটে
ত্রিকালদর্শী মাঝির মুখে মৃদু হাসি, আর
আমার করুণ আর্তনাদ: ‘মধ্যনগর! মধ্যনগর!’
মধ্যনগরে তখন সন্ধ্যা নামে মরমি গানের সুরে
রাত নামে, জোনাকিরা জ্বলতে থাকে বনে বনে
পরিরা আকাশে, জ্বিন ডুবে যায় জলে
প্রদীপ নিভিয়া আসে
ত্রিকালদর্শী মাঝিও নেই, গয়নার নাও নেই
ঘাটে বসে আমি কাঁদি একাকী নিমাই-
‘মধ্যনগর! মধ্যনগর ! মধ্যনগর কি কেউ যাবে?’
শুধু নিরুত্তর পৃথিবীর আঁধার আছড়ে পড়ে ঘাটে!
এসএন