ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১০
যারা যুদ্ধ করেছিল
‘নবীজীতো কাফের নারীদের দাসী বানাতেন। ওরা কি কাফের? করিম মিয়া আপনার দুসম্পর্কের আত্মীয়। তারা শত্রু হয় কীভাবে? লোকে শুনলে কী বলবে?’
‘লোকের কথা বাদ দেও। রাজাকাররা সাথীকে মিলিটারির হাতে তুইলা দিলে তখন কি হইতো একবার ভাইবা দেখছো? মেয়েটার জীবন ছেড়াব্যাড়া হয়া যাইতো। শোন, ধর্মের কাছে আত্মীয়তা বলে কিছু নাই। অবশ্যই তারা কাফের, মুশরিক। আওয়ামী লীগের লোকজন, মুক্তিবাহিনী এবং হিন্দুরা সব পাকিস্তানের শত্রু। তাদের বাড়িঘর লুট করা মুসলমানদের দায়িত্ব। তাদের সব নারীরা যুদ্ধ বন্দিনী এবং দাসী। তা না হলে ইন্ডিয়ার হিন্দুদের সাথে হাত মিলায়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে?’
আয়েশা বেগম খানিক দম নিয়ে তারপর বললেন, ‘মমিন যদি যুদ্ধ থাইকা ফিরা আইসা আপনার ছেলেকে মাইরা ফেলে? এই ব্যাপারটা কি আপনি ভাবছেন কখনো?’
ফজলুর রহমান উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। ‘তুমি কি পাগল হইছো? মমিন কেমনে ফিরা আসবো? সে সুযোগ কি তার আছে? যারা যারা দেশ থাইকা ভাইগা ইন্ডিয়া গেছে তাদের জন্মের মতো দেশে আসার কপালে ঝাটার বাড়ি। তারা পাকিস্তানি মিলিটারিদের চোখে গাদ্দার। বেঈমান। তারা আর কোনোদিন পাকিস্তানে ফিরা আসতে পারবে না। আসলেই গুলি।’
‘আপনি নবী যুগের কথা বাদ দেন। মানুষ শুনলে কি বলবে। আপনি হয় মেয়েটারে ওর বাড়িতে পাঠায়া দেন। না হলে সাকিবের সাথে কবুল পড়ায়া দেন। না হলে ওর হাতের কিছু আমি ছুঁইয়া দেখবো না। ওর হাতের পানিও আমি খামু না।’
ফজলুর রহমান রাগ মুখে উঠে পড়লেন। তারও মন মেজাজ ভালো নেই। আজ মেজর সাহেব সবাইকে খুব উল্টাপাল্টা গালাগাল করেছে। মুক্তিবাহিনী ঘুপছি গাপছিতে প্রায়ই আক্রমণ করছে। শান্তিবাহিনী তাদের কোনো খবর দিতে পারছে না। রাজাকাররাও তাদের ধরতে পারছে না। এই নিয়ে মেজর সাহেব খিস্তি খেউড় করেছে। শালার মাওড়ারা কিছু হলেই বলে, মাদারচোদ। এই গালটা ফজলুর রহমানের সহ্য হয় না।
সেখান থেকে ফিরে বউয়ের এমন ফালতু নসিহত কাহাতক সহ্য হয়? ফজলুর রহমান মাথায় তেল ঘষে পুকুরঘাটে গিয়ে অনেকক্ষণ গোসল করে মাথা ঠাণ্ডা করলেন। তারপর খেতে বসে কাজের মেয়েকে বললেন, ‘রান্নাবান্না কে করেরে?’
কাজের মেয়ে রহিমা বললো, ‘আমি করি খালুজান। সাথীর হাতের রান্না খালাম্মা খাইতে চায় না।’
রাত সন্ধ্যার পরপরই সাকিব সাথীকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। এই দৃশ্য ফজলুর রহমানের ভালো লাগে না। তারও সাথীর সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা হয়। মেয়েটির হাসি বড় সুন্দর। চোখ দু’টো টানা টানা। এমন চোখে মেয়েটি হাসলে বুকের মধ্যে কেমন উথাল পাথাল করে। এই গণিমতের মাল তারও ভোগ করার অধিকার আছে। সেও ভোগ করতে চায়। কিন্তু সে কথা ছেলেকে কীভাবে বলবে?
আয়েশা বেগম অসুস্থ হওয়ার পর থেকে শরীরটায় আগুনের মতো সবসময় উঞ্চ থাকে। সাথী মেয়েটিকে দেখলে সেই আগুন আরও উথলে ওঠে।
সাকিব ইদানীং সাথীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। সারাক্ষণ সাথী মন মরা হয়ে থাকে। হাসে না। ঠিকমতো কথার জবাব দেয় না। এমন জড় পদার্থের সঙ্গে রোমাঞ্চ কি ভালো লাগে?
‘তুমি সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে রাখো কেন?’ বিরক্ত মুখে সাকিব জিজ্ঞেস করে। সাথী কোনো জবাব দেয় না। সাকিব আরও বলে, ‘তোমাকে মিলিটারির হাতে তুলে দিলেই ভালো হতো। সেখানে ওরা তোমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেত সেটাই হতো তোমার জন্য মঙ্গল।’
সাথী বলে, ‘আপনি আমার ভাইয়ের বন্ধু। মমিনভাই ফিরে এলে কী জবাব দেবেন আপনি?’
‘ও সব ভুলে যাও। এ জীবনে আর ভাইয়ের মুখ দেখতে হবে না। তুমি কী ভেবেছ মিলিটারিরা হেরে যাবে আর তোমার ভাইয়েরা লাফাতে লাফাতে জয়বাংলা বলে পতাকা নিয়ে ছুটে আসবে? এ সব আজগুবি খোয়াব দেখে লাভ নাই। বাংলাদেশ কোনোদিন স্বাধীন হবে না। যারা যুদ্ধে গেছে, জীবনে তারা আর দেশে আসতে পারবে না। তুমিও তোমার ভাইয়ের আশা ছাইড়া দেও। বাঁচতে চাইলে তুমি তোমার মতো হাসো, আনন্দ করো। না হলে তোমাকে আমি মিলিটারির হাতে তুলে দেব।’
তবু সাথী স্বাভাবিক ভাবে হাসিখুশি থাকতে পারে না। সুযোগ পেলে সাথী বাড়ি আসে। রমিছা বিবি মেয়েকে দেখে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘মা-রে মেয়ে হয়ে জন্মেছিস। মস্ত বড় পাপ করেছিস। আমরা তোকে ধরে রাখতে পারলাম না। সাথী বাড়ি এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে খাতা কলম নিয়ে কি যেন লেখে। রমিছা বিবি জিজ্ঞেস করে, ‘কি লিখিস ছাইপাস? ওসব লিখে কি হবে?’
‘কিছু হবে না মা। ডায়েরি লিখে রাখছি।
‘কি লিখছিস?’
‘ডায়েরি লিখছি। প্রতিদিন কি কি ঘটছে তাই টুকে রাখছি। আমার লেখা পড়ে মানুষ একদিন মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে পারবে।’
রমিছা বিবি নিজের হাতে সাথীকে খাইয়ে দেয়। কিছু বলতে পারে না। শুধু কাঁদে। মা হয়ে মেয়ের এই নোংরা জীবন কীভাবে মেনে নেবে। শুধু আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে বিচার চায়।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/