ধারাবাহিক উপন্যাস: শেষ পর্ব
স্নানের শব্দ
সকালে প্রতিদিনের মধ্যেই অফিসে এসেছে শবনম, মন ভালো করার জন্য সাদা পাড়ের হাল্কা গোলাপী একটা মণিপুরী শাড়ি পরেছে সে। সেই মতো হাল্কা প্রসাধনও করেছে। তবে বুঝতে পারছে হৃদয়তন্ত্রীতে সুক্ষভাবে সানাইয়ের মতো একটা বিষণ্ন করুণ সুর আপন মনে বেজেই চলেছে। দেহ মন বাইরে থেকে বেশ স্বাভাবিক মনে হলেও অদ্ভুত এক অদৃশ্য অবসাদে ডুবে থাকার অনুভূতি হচ্ছে তার। মাসিক কর্মী মিটিং ছিল আজ। হল ঘরে বসে থাকা তরুণ উন্মুখ উজ্জ্বল চঞ্চল বিমর্ষ মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের চাকরি জীবনের শুরুর দিকের কথা মনে পড়ায় খুব জ্বালাময়ী একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেলল শবনম। কথাগুলো জোরালোভাবে বলতে পেরে খানিকটা ভাল লাগা শুরু হলো তার।
বলল-‘এই যে আমাকে এখানে দেখছেন, তা কিন্তু হঠাৎ করে নয়, অনেক পথ পেরিয়ে, অনেক অভিজ্ঞতার জোরে আমি এ পর্যায়ে এসেছি। আমার ২৩ বছরের কর্মজীবনে আমি একটা জিনিসই বুঝেছি, সেটা হচ্ছে একজন পেশাজীবী বা কর্মী যতটা তার কর্মস্থলে দেয়, সেটা আসলে দান নয় বরং তার নিজেরই প্রাপ্তি। কীভাবে? কর্মী যা করেন তাতে অফিস হয়তো উপকৃত হয়, কিন্তু কাজের সবটুকুই তার নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা হয়। কাজ তার দক্ষতাকে শাণিত করে, যোগ্যতাকে বাড়িয়ে দেয়। ‘জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা’-বলে একটা কথা আছে না! কাজ হলো আপনার জীবনের অর্জিত সেই ধন। যা ভাঙিয়ে আপনি সারাজীবন চলতে পারবেন। আর যারা ফাঁকিবাজি করেন, দলবাজি করেন, ষঢ়যন্ত্র করেন, তারা আসলে নিজেকেই ফাঁকি দেন। দিন শেষে তার ঝোলা শুন্যই থাকে। খালি ঝোলা নিয়ে আপনি কতদূর যাবেন? আমার কাছে তো কাজ না করে বসে থাকাটাই সবচে পরিশ্রমের কাজ বলে মনে হয়। আপনাদের মনে হয় না?’ শবনমের কার্যতালিকায় পরের কর্মসূচি ছিল অফিসের আইন বিভাগের সঙ্গে বৈঠক। একজন অ্যাডভোকেট এসেছিলেন ওসমান গণির কাগজ পত্র নিয়ে। শবনম বলল, ‘আমরা একদম নো কম্প্রোমাইজ নীতিতে এই মামলাটা করব। কোথাও যেন ফাঁক-ফোকড় না থাকে।’
অ্যাডভোকেট সাহেব মাঝবয়সি, ঝানু উকিল। অনেকদিন ধরে কোম্পানিতে আছেন। তিনি কাগজপত্র মেলে ধরে চোখ সরু করে বললেন,‘ আমাদের তো ব্রিটিশ আইন ম্যাডাম। এই আইনে চুরির শাস্তির চাইতে অপরাধীর অর্থাৎ চোরের অপরাধ প্রতিষ্ঠা করার উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।’ ‘সে যাই হোক, আমি চাই আপনারা এমনভাবে মামলা করবেন যাতে অন্যরা এটা দেখে শিক্ষা পায়। এধরনের কাজ করার সাহস না করে। যেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়। ’
সন্ধ্যায় চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ, তার অফিসে। চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে কী কী বলবে তা মনে মনে গুছিয়ে রেখেছিল শবনম। তবে রাশভারী বয়স্ক ভদ্রলোকের সামনে বসে হঠাৎ কথাগুলো এলামেলো হয়ে গেল তার। চেয়ারম্যান সাহেবের মাথায় খুলি কামড়ে ধরা পাটের আঁশের মতো সাদা চুল, চওড়া কপালের নিচে তার তীক্ষ্ণ চোখ ধারালো নাক যেন গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছিল শবনমকে। ডান হাত দিয়ে মুখের পাইপটা সরিয়ে তিনি বললেন, ‘নারী সিইওর ব্যাপারে আমার প্রথমে একটু আপত্তি ছিল, কারণ কি জানেন?’শবনম হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়ল।
‘প্রথম কারণ বেটা মানুষরা সহজে মেয়ে লোকের কর্তৃত্ব মানতে পারে না। অনেক দিনের অভ্যাস তো, হা হা হা, তাদের পৌরুষে লাগে। দ্বিতীয় কারণ, এই যে আপনে আসছেন পুরুষ লোক হইলে আমি দরজা বন্ধ কইরা দিতে পারতাম, কেউ কিছু মনে করত না। কিন্তু আপনেকে নিয়া যত কনফিডেনশিয়াল বিষয় হোক একা ঘরে দরজা বন্ধ কইরা আলাপ করা হা হা হা, কিছু না হইলেও লোকে কথা বলবে, আপনেও স্বস্তি পাবেন না, ঠিক কি না? ’শবনম কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল, কিন্তু তার আগেই চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, ‘আবার ধরেন লেট নাইট পার্টি অ্যাটেন্ড করা, প্রয়োজনে মদের পার্টি দেওয়া, মদ খাওয়া এসবেও অনেকের অবজেকশন থাকে।’ ‘স্যার! আমি মনে করি, এগুলো খুব বড় সমস্যা না, আমাদের ওয়ার্কিং কালচার আর মাইন্ড সেট সামান্য পরিবর্তন করলেই এসব সমাধান করে ফেলা সম্ভব।’
চেয়ারম্যান সাহেব মাথা দোলান। ভদ্রলোক খুব ছোট্ট অবস্থা থেকে বুদ্ধি, পরিশ্রম আর নেতৃত্বের গুণে এই কোম্পানিকে মহিরুহে পরিণত করেছেন। তার বিপুল অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞাকে সম্মান করে শবনম। ‘সেটা হয়তো ঠিকই বলছেন। পরিবর্তন দরকার। আপনে পরিবর্তন আনেন। আমি দেখতে চাই।’ চেয়ারম্যান সাহেব আবার তার পাইপে টান দেন। শবনম বিনীত ভঙ্গিতে বলে, ‘আজকে আমি একটা আর্জি নিয়া আসছি। যদি অনুমতি দেন তো বলি...’চেয়ারম্যান সাহেব হাত তুলে থামিয়ে দেন তাকে, ‘বোর্ড অব ডিরেক্টরসদের সিদ্ধান্তের বাইরে আমি সাধারণত যাই না মিসেস শবনম। আমি জানি আপনি চারজনের চাকরি বহাল করার সুপারিশ করতে এসেছেন, তাই না? ’শবনম এবার একটু থতমত খেয়ে যায়। আসলে চার জন নয়, মনিরুজ্জামান বাদে বাকি তিন জনের চাকরি বহাল রাখার সুপারিশ করতে এসেছিল সে। বদমাশ মনিরুজ্জামান ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়, তার জন্য কোনো সুপারিশও করবে না সে। কিন্তু বাকি তিনজনকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি হিসেবে ইনক্রিমেন্ট বন্ধ রেখে, পদোন্নতি স্থগিত করে চাকরিতে বহাল রাখা সম্ভব। চেয়ারম্যান সাহেব ডানে বামে মাথা নাড়লেন। ‘এটা কইরেন না মিসেস শবনম, ওদের চাকরি রাখলে আপনাকে সবাই দুর্বল এবং ভঙ্গুর ভাববে। সেটা আপনার অবস্থানকে নড়বড়ে করে দেবে। টাফ যান। কঠোর হন। চোখ বন্ধ করে চাকরি খেয়ে দেন। তাহলে আপনাকে ভয় পাবে সবাই। উল্টাপাল্টা করার সাহস পাবে না। পাওয়ার পাইছেন যখন, পাওয়ার দেখান। পাওয়ার শোকেসে সাজিয়ে রাখার দরকার নাই।’
‘কিন্তু স্যার, আমার হাত দিয়ে কারও চাকরি যাক সেটা আমি চাচ্ছিলাম না। হাজার হোক রিজিকের ব্যাপার...’‘উহু মিসেস শবনম, এইভাবে একদম ভাববেন না। রিজিকের মালিক আল্লাহ! আমরা উছিলা মাত্র!’ ‘কিন্তু তবু স্যার...মানে খারাপ লাগছে..! সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে থাকে... এই বাজারে চাকরি গেলে...’ ‘হা হা হা, আপনের জায়গায় একজন পুরুষ হলে কিন্তু এত ভাবত না, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য ঘ্যাশ ঘ্যাশ করে চাকরি খেয়ে দিত। শুরুতে বলছিলাম না, নারী সিইওর ব্যাপারে আপত্তি করছিলাম...শোনেন মিসেস শবনম অফিসে দয়া মায়া মমতা কোমলতা এসব দেখাবেন তো আপনি ধরা খাবেন। মনে রাখবেন অফিসের প্রয়োজনে অনেক অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে। নিষ্ঠুর হলেও সেসব সিদ্ধান্ত নিবেন এবং ইমপ্লিমেন্ট করবেন। উইশ ইউ অল দ্যা বেস্ট!’
চেয়ারম্যান সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য শবনমের দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিলেন। তার শক্ত কঠোর ঈষদুষ্ণ হাতের সঙ্গে হাত মেলাল শবনম। ‘আমি একজন যোগ্য সিইওকে নিয়োগ দিয়েছি, কোনো নারীকে নয়। আপনার সাফল্য কামনা করি, মিসেস শবনম।’
খুবই ফর্মাল ভঙ্গিতে কিন্তু আস্থার সঙ্গে নরম গলায় বললেন চেয়ারম্যান সাহেব। শবনমের দুই চোখ কেন যেন হঠৎ পানিতে ভরে উঠল। সে কোনোরকমে চেয়ারম্যানের রুম থেকে বেরিয়ে এসে ডান হাত দিয়ে দুই চোখের কোণা মুছে নিল। চোখে এমন পানি আসা কি দুর্বলতার লক্ষণ, নাকি বয়স বাড়ার? ছেলেগুলোর চাকরি রক্ষা করবে বলে নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারায় কি দুঃখ হচ্ছে তার? নাকি চেয়ারম্যান সাহেব ভরসা রেখেছেন বলে আনন্দ হচ্ছে? চোখের এই অশ্রু কি যুগপৎ বেদনা এবং আনন্দের? সে যাই হোক, চেয়ারম্যান সাহেবের বক্তব্য তো পরিষ্কার। ওই চারজন আর থাকছে না কোম্পািনতে। আগে মনিরুজ্জামান একা গালাগালি করত এখন চারজনের সম্মিলিত গালি শোনার মানসিক প্রস্তুতি নেয় শবনম। সকালের বিষাদ বাতাস আবার যেন ফিরে আসে।
এইচ আরে ফোন করে ওই চারজনের সাসপেন্ড লেটার রেডি করতে বলে সে। রাত হয়ে গিয়েছিল বলে অফিসে না যেয়ে ড্রাইভারকে বাড়ির দিকে গাড়ি ঘোরাতে বলল শবনম। আজ বাসা সম্পূর্ণ খালি। শ্রাবণ তার বন্ধুর বাড়িতে রাতে থাকবে। তারেক গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরেনি। গৃহকর্ম সহকারী রাহেলার মাও ছুটি নিয়ে তার মেয়ের বাড়ি গেছে।
একা ঘরেই ক্লান্ত পায়ে ঢুকল শবনম। গা জুড়ে অবসাদ নেমে এসেছে। হাতের ভ্যানিটি ব্যাগটা সোফায় ছুড়ে ফেলল সে। চোখ থেকে চশমা, কান থেকে গোলাপি পাথরের কানের দুল, এক হাত থেকে সরু সোনার বালা দুটি, অন্য হাত থেকে সোনালী বেল্টের স্টাইলিশ ঘড়িটি খুলে রাখল সে। রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেধে রাখা কাধ পর্যন্ত চুল ছেড়ে দিল। দুই হাতের আঙুল দিয়ে খুলল শাড়ির আঁচলে আটকানো সেফটিপিন। তারপর একটানে খুলে ফেলল শাড়িটা। পরিশ্রান্ত অবসন্ন শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গে রইল শুধু ব্রা ও ব্লাউজ, নিম্নাঙ্গে পেটিকোট। এই অবস্থাতেই হাত পা ছড়িয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। কোথা থেকে একটা নিঃসঙ্গ শুন্যতার বোধ তাকে নরম হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। আর মনের অতল গহ্বর থেকে কি এক অন্তর্গত বেদনায় নিমেষে উঠে এল হু হু কান্না। ফাঁকা বাড়িতে নিজের বিছানায় শুয়ে কোনো লুকোছাপা না করে শিশুদের মত গলা ছেড়ে কাঁদল শবনম। অনেকক্ষণ ধরে। যেন বুকের ভেতর জমে থাকা পাথর গলল তার। যেন সে এক অকূল নদী হয়ে গেল। কেঁপে কেঁপে ফুলে ফুলে প্রাণ খুলে কাঁদল সে।
একসময় কান্না থেমে গেলে নিজেকে সামলে নিয়ে ব্রা, ব্লাউজ, পেটিকোট সব খুলে নগ্ন হলো শবনম। সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে তার প্রিয় স্নানঘরে ঢুকল। মানুষ সমান আয়নায় যাবতীয় মহিমা নিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল একজন নারীর পূর্ণাঙ্গ শরীর। সেই শরীরে রূপালী আভা ছড়িয়ে ধীর লয়ে যৌবন অস্ত যাচ্ছে, স্তরে স্তরে সেই বিদায়ের বিবর্ণ বেদনার করুণ রেখাচিত্র ফুটে উঠেছে। আয়নার কাছে মুখ নিয়ে নিজের প্রতিবিম্বের চোখে চোখ রাখে শবনম। দেখে একটা মলিন ও শ্রীহীন চেহারা। যার চোখের কোণে ক্লান্তি, নিরাসক্তি ও শীতলতা। গলার কাছে বয়সের ভাঁজ। বুকের ওপর ধবল শঙ্খের মতো উদ্ধত স্তন বিনীত শ্লথ ভঙ্গিতে নুয়ে পড়েছে, পেটে দৃশ্যমান মেদের উপস্থিতি, নাভির নিচে জননেন্দ্রিয় ঘিরে আরও কিছু কেশ শুভ্রতা ছড়াচ্ছে. সুগঠিত পায়ের পেশিরা শিথিল হয়ে ঝুলে পড়েছে। শবনমের বুক চিরে একটা লম্বা প্রাচীন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
এই জীবনে যা আকাঙ্ক্ষা করেছিল তার সবই তো পেয়েছে সে, যতটা শীর্ষে উঠতে চেয়েছিল ততটা শীর্ষেই তো উঠেছে, যতটা ক্ষমতাবান হতে চেয়েছিল ততটা ক্ষমতাই তো পেয়েছে। তবু কোথায় কোনো অতল কুঠুরীতে এই গভীর শূন্যতার জন্ম হলো? শবনম কল ঘুরিয়ে মাথার উপর ঝর্ণা ছেড়ে দেয়। অনন্ত আশীর্বাদের মতো কলকল করে কুসুম গরম আরামের জল মাথা বেয়ে সারা শরীরে নেমে আসে। স্নানের বিচিত্র তরঙ্গময় শব্দ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। শবনমের মনে হয় এই বহুবর্ণের শব্দে মিশে আছে জল পড়ার কোমল আওয়াজ, সাবানের মিষ্টি সুগন্ধ, পরিচ্ছন্নতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আর পবিত্রতার চিরায়ত বাসনা।
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>