ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব- ৭
যারা যুদ্ধ করেছিল
আশ্রিত গাঁয়ের নাম নিশ্চিন্তপুর। বগুড়া-সিরাজগঞ্জের বর্ডারে। গ্রামের নামের সঙ্গে যথেষ্ট মিল আছে এই গ্রামে। এখানে যারা বাস করছে তারা সত্যি নিশ্চিন্তে আছে। চর এলাকা। এখানে পাকিস্তানি মিলিটারি আসে না। তারা মিলিটারিও দেখেনি মুক্তিযোদ্ধাও দেখেনি। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের দেখার জন্য পুরো গ্রাম ভেঙে পড়ল। তাদের ভয় দেখিয়েও সরানো গেল না।
মজনু বলল, ‘ওস্তাদ, গাঁয়ের নামটি আমার খুব পছন্দ হইছে। নিশ্চিন্তপুর। আমরাও এখন যথেষ্ট নিশ্চিন্ত। মনে হচ্ছে পুরো যুদ্ধের সময়টা এখানেই থাইকা যাই।’
‘মনে হচ্ছে তুমি যুদ্ধ করতে আস নাই। বেড়াইবার আইছ।’
‘রাগ হইয়েন না ওস্তাদ। এমনি এমনি কইছি।’
মমিন রাগ মুখে বলল, ‘বারেক কখনো এমন কথা কইবা না। আজ আমাদের মন ভালো নাই। যুদ্ধে আমরা হাইরা গেছি। আমাদের কয়েকজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। এইসময় তোমার রসিকতা পোড়া শরীরে মরিচ বাঁটা লাগানোর মতো জ্বলছে। দ্বিতীয়বার এই কথা বললে তোমার কপালে খারাপই আছে।’
‘আর বলব না ওস্তাদ। আমার ভুল হয়া গেছে।’
দুপুরে খাওয়ার আয়োজন হলো। মমিনের খেতে হচ্ছে করছে না। সতীর্থদের পীড়াপীড়িতে খেতে বসল। হাত ধুতে দরজার কাছে গেল পানি ভর্তি গ্লাস নিয়ে। হাত ধুতে ধুতে খেয়াল করল একটি কিশোরী মেয়ে খাওয়া এগিয়ে নিয়ে এসে দিচ্ছে। ঘরে থাকা পরিবেশনকারি লোকটি সেই খাওয়া নিয়ে পাতে পাতে পরিবেশন করছে। মেয়েটিকে দেখে চমকে উঠল মমিন। মেয়েটি অবিকল মমিনের ছোট বোন সাথীর মতো দেখতে। তেমনই নাক তেমনই চোখ। মাথায় একরাশ কোকড়া চুল। হাসিতেও অদ্ভুত মিল। মমিনের মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বার বার শুধু সাথীর মুখ মনে পড়তে লাগল। কিছুই খেতে পারল না। এক সময় খাওয়া রেখে সে উঠে পড়ল। সবাই বলাবলি করতে লাগল যুদ্ধে হেরে আজ ওস্তাদের মনে খারাপ। তারা কেউ মমিনের মনের কথা বুঝতে পারল না।
শেষ পর্যন্ত করিম মিয়া সবাইকে নিয়া শশুর বাড়ি যেতে রাজি হয়। কথা হয় সন্ধ্যার পর তারা রওনা হবে। সারাদিন তারা গোজগাছ করে। গোজগাছ করারও তেমন কিছু নেই। পুরোনো কিছু কাপড়চোপড় আর কিছু গহনাপত্র। সাথী তার বইগুলো বাঁধাসাধা করে। রাতের খাওয়ার পরই তারা রওনা হবে। সেই মতো তারা প্রস্তুতি নিতে থাকে।
দিনের বেলায় যাওয়ার সাহস নেই। যদি সাকিবের চোখে ধরা পড়ে। তখন কোনো জবাব দেওয়ার মুখ থাকবে না। গোপনে পালিয়ে গেলে তারপর যা হওয়ার তাই হবে। মাইল পাঁচেক পর তাদের একটি আত্মীয় বাড়ি আছে। সেখানে রাত্রিযাপন করে সকালে নানার বাড়ির উদ্দেশ্যে তারা রওনা হবে। রমিছা বিবি কাজ করছে আর মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ছে। যাতে সহি সালামতে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।
রাতে খেতে বসেছে করিম মিয়া। সাথী খাওয়া এগিয়ে দিচ্ছে। সাথীকেও খেতে বলছিল করিম মিয়া। সাথী বলেছে তার খিদে নেই। খাবে না। সাথী এখান থেকে চলে যেতে পারলে যেন বাঁচে। এখানে থাকলে সাকিব তাকে নিয়ে রঙ্গ তামাশা করবে। খারাপ প্রস্তাব দেবে। এর আগে একবার সে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। সাথী ভয় দেখিয়ে বলেছিল, ভাইয়াকে সে বলে দেবে। সাকিব আর কথা বাড়ায়নি। শুধু বলেছিল, ‘সেটা বল না। আমি আর তোমাকে এমন কথা বলব না।’ সাথী নিশ্চিত তাকে বাড়িতে নিয়ে সে এই ঘটনার প্রতিশোধ নেবে। করিম মিয়ার খাওয়া শেষ। হাত ধুতে গ্লাস হাতে ঘরের বাইরে এসে দেখে টর্চ চালিয়ে বাড়িতে ঢুকছে কে যেন। একজন নয় জনাচারেক। কাঁধে রাইফেল। এসেই করিম মিয়াকে ডাকে। ‘করিম মিয়া বাড়ি আছ?’ সেই ডাক শুনে করিম মিয়ার আত্তা শুকিয়ে যায়। সাথী গিয়ে চৌকির নিচে পালায়। তার বুকের কাঁপুনি ঝড়ের বেগে বাড়তে থাকে।
আলিম রাজাকার গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে, ‘করিম চাচা, তোমার ছেলে মমিন কোথায় গেছে?’
‘কোথায় গেছে আমি জানি না বাবা।’
‘মিছা কথা কওয়ার জায়গা পাও না। মনে করছ আমরা কিছু জানি না। তোমার ছেলে ইন্ডিয়া গেছে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করতে। সে দুস্কৃতির খাতায় নাম লেখাইছে। চলো, তোমাকে আমাদের সঙ্গে যাইতে হবে।’
‘কোথায়?’ ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে করিম মিয়া।
‘ক্যাম্পে।’
ঘর থেকে দৌড়ে বাইরে আসে রমিছা বিবি। এসে আলিমের পা জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘বাবা আলিম, আমরা সত্যি জানি না মমিন কই গেছে। ও কিছুতেই যুদ্ধে যাবে না। ও ভীষণ ভীতু। তোমরা মমিনের বাপকে নিও না। মিলিটারি তারে মাইরা ফেলবে। আমি তার জান ভিক্ষা চাই।’
আলিম গর্জে উঠে অন্য রাজাকারদের বলে, ‘তোদের কী বলতাছি শুনতে পাস নাই? তোরা এই বুইড়া হালারে বান। এই হালার বুদ্ধিতেই ওর পোলা আমাগো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য ইন্ডিয়া গেছে। ব্যাটা আমাগোরে শত্রু পাকিস্তানের শত্রু মালাউনগো দেশে গেছে দুস্কৃতির খাতায় নাম লেখাইতে। সাহস দেইখা বাঁচি না। এহনো খাড়াইয়া আছোস ক্যা? বান হালাকে।’
দুজন রাজাকার ছুটে এসে করিম মিয়াকে পিঠমোড়া করে বাঁধে। রমিছা বেগম আলিমের দুপা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কয়েকজন প্রতিবেশি আড়াল থেকে দেখে তারা আড়ালেই মিলিয়ে যায়। কেউ সামনে আসে না। তখন কারো সামনে আসার মতো অবস্থা ছিল না। সবাই ‘চাচা আপন জান বাঁচা’ অবস্থা। সাথী চৌকির তলা থেকে বের হয়ে কী করবে ভাবতে থাকে। একবার ভাবে বাইরে গিয়ে আলিম ভাইকে অনুরোধ করবে বাবাকে ছেড়ে দিতে। আবার ভাবে, ওরা যদি আমাকে ধরে নিয়ে যায়, তখন?
এইসময় সাকিবের কণ্ঠ শোনা যায়। টর্চ লাইটের আলো ফেলে সাকিব উঠোনে এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘কী হইছে? এত হলাচিল্লা কিসের?’
করিম মিয়া বলে, দেখতো বাবা, ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তুমিতো সবই জান, মমিনের খবর আমরা কীভাবে জানব?’
সাকিব গর্জে ওঠে, ‘আলিম, তোকে না বলেছিলাম করিম চাচার ব্যাপারে তোদের কিছু করতে হবে না। যা করার আব্বার সঙ্গে কথা বলে আমরাই করব। ছেড়ে দে তাকে। রমিছা গিয়ে সাকিবের পা জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘আমগো বিপদের সময় আল্লাহ তোমাকে পাঠাইছে বাবা। তুমি না আইলে আজ কপালে কী যে দুর্ভোগ অইত তা আল্লাই জানে।’
সাকিব বলে, ‘আমি তো আসতাম না। জরুরি কাজে ব্যস্ত ছিলাম। বাড়ির কামলা ইউনুস গিয়ে বলল, করিম চাচাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাই শুনে আর দেরি করতে পারলাম না। হাজার হোক আপনারা আমার আপনজন। বন্ধুর পিতা-মাতা। মমিন আমার জানের জান দোস্ত। আমি থাকতে তার বাবা-মায়ের কিছু হবে সেটা আমি কীভাবে মেনে নেব? তার চেয়ে আমার মরে যাওয়া ভালো।’
ঘর থেকে সাথী লম্বা করে শ্বাস ফেলে। সাকিবের কথাগুলো তার ভালো লাগে। এর মধ্যে অন্য কোনো তত্ত্ব আছে কি না সাথী সেটাও ভাবে।
সাকিব এবার রাজাকারদের ধমকে বলে, ‘তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা বলছি।’ রাজাকাররা তবু দাঁড়িয়ে থাকে। সাকিব নিজে থেকে বলে, বুঝতে পারছি। তোরা কিছু দক্ষিণা চাস। চাচি, ঘরে সোনাদানা কিছু আছে?
‘সোনাদানা কই পামু বাবা। আমার একটা বিয়ার নাকফুল আছে।’
সাকিব বলে, ‘তাই দেন। ওরা এত কষ্ট করে এতদূর এসেছে। ওদের যাতায়াত ভাড়াটাতো দেওয়া দরকার। জানের চেয়ে তো সোনার মূল্য বেশি না।’
রমিছা ঘরে গিয়ে পুটলিতে বাঁধা নাকফুলটা এনে সাকিবের হাতে দেয়। সাকিব লাইট জ্বালিয়ে নাকফুলটা দেখে। হেসে বলে, নে। জিনিসটা খারাপ না। ভালো দাম পাবি। এখন এটা নিয়ে কেটে পড়। আর কোনোদিন এ বাড়িতে আসবি না।’ সাকিব এগিয়ে গিয়ে নিচু গলায় কী যেন বলে। ওরা তারপর নাকফুলটা নিয়ে চলে যায়।
রমিছা বলে, ‘বাবা ঘরে আইসা বস। তোমার জন্য এতবড় বিপদ থাইকা আল্লাহ আমগো রক্ষা করল। একটু বস।’ রমিছা টুল আগাইয়া দেয়।
‘সাথীকে দেখছি না। কোথায় সে?’
রমিছা বলে, ‘ঘরেই আছে। রাজাকার দেইখা ভয় পাইছে।’
‘ভয় পাওয়ারই কথা। ওরাতো মানুষ না। এক একটা জানোয়ার। সুযোগ পাইলে লুটপাট করে। গোয়াল থেকে গরু পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়। কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। ওদের ব্যাপক ক্ষমতা দিছে সরকার।’
রমিছা সাথীকে নিয়ে আসে সাকিবের সামনে। সাকিব একঝলক দেখে হেসে ফেলে। তার হাসির কারণ বুঝতে পারে না সাথী। সাকিব বলে, ‘তুমি মমিনের বোন। মানে আমারও বোন। আমাদের বাড়িতে থাকতে তোমার এত আপত্তি কেন?’
কথাটা এমনভাবে বলে যেন সাকিব নিশ্চিত সাথী ইচ্ছে করে সাকিবদের বাড়িতে যাচ্ছে না। সাথী জবাব খুঁজে পায় না। সে মাথা নামিয়ে থাকে।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
এসএন