ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব- ৬
যারা যুদ্ধ করেছিল
প্রায় চার মাইল রাস্তা হেঁটে নদীর পাড়ে এসে বসে পড়ে সবাই। ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাস্তা বলতে চরার আইল পথ। সেই পথে অন্ধকারে হাঁটা খুবই ঝক্কি। হোঁচট খেয়ে পথ চলতে হয়। মমিন বার দুই হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে কোনোমতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পাশ থেকে ঝপাত করে ধরে ফেলে মজনু। মজনু নিজেই দুবার পড়ে গেছে। তাকে ধরার সুযোগ কেউ পায়নি। হোঁচট খেয়ে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। ব্যথা পেয়েছিল বেশ। মমিনের প্রশ্নে ঝাড়া অস্বীকার করে মজনু। বলে, ‘না ওস্তাদ, ব্যথা পাই নাই। এর চেয়ে কত শক্ত আঘাত পাইলাম তাতেই ব্যথা পাইলাম না। আর এতো সামান্য মাটির ইটা।’
‘এই নদীর নাম কী ওস্তাদ?’ মজনু জিজ্ঞেস করে।
মমিন বলে, ‘করতোয়া।’
‘এ কেমন কথা। যেখানে যাই সেখানেই করতোয়া নদী। আমগো অংপুরেও করতোয়া নদী আছে।’ মজনুর কথায় বুক ফেটে হাসি চাগিয়ে উঠছিল মমিনের। কিন্তু অপারেশনের যাত্রায় অনেক কিছু চেপে রাখতে হয়। কথা বলা বারণ। হাসাহাসিও নিষেধ। মজনু কথা বলছিল নিচু স্বরে। যুদ্ধ যাত্রায় কত কিছু মেনে চলতে হয়। রাতের অপারেশনে বিড়ি খাওয়া বারণ। বিড়ির আগুন বহুদূর থেকে দেখা যায়। যারা বিড়িখোর, বিড়ি না খেলে যাদের হাঁস-ফাঁস ঠেকে তারা হাতের মুঠোয় আগুন লুকিয়ে চুরি করে চোষা টান মারে। পাড়ে বসেই দেখা যাচ্ছে মাইল তিনেক দূরে উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে একটি উঁচু মিনার। ওটা ছিল একটি বিশাল মন্দির। এখন আর ওটা মন্দির নয়। পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। মন্দির গুঁড়িয়ে দিয়ে ক্যাম্প বানিয়েছে মিলিটারিরা। চারদিকে টেন্স ও বাংকার। ওখানেই আক্রমণ করতে যাচ্ছে মমিনরা। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি বাহিনী। তাদের সদস্য সংখ্যা অনেক। সঙ্গে ভারী অস্ত্রও আছে। সেই সাহসেই তারা যৌথভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে। বগুড়া জেলার শেরপুর থানার পূর্বে ভবানী মাতার মন্দির। প্রাচীন এই মন্দিরে এখন আর পূজা হয় না। মন্দিরের চারপাশ বাংকার খুঁড়ে পাকিস্তানি মিলিটারিরা নিরাপদ বাংকার বানিয়ে নিয়েছে। মন্দির ঘিরে যে সমস্ত বাড়িঘর ছিল সেই বাড়িঘরের মানুষকে হত্যা করে সব দখলে নিয়েছে মিলিটারিরা। আজই সেই ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দেবে।
নদীতে এখন ভরা বর্ষা। জোৎস্নার মৃদু আলোতে ঝকমক করছে ঢেউ ভাঙা পানি। বড় বড় দুটি নৌকায় করে সবাই নদী পার হয়ে লাইন ধরে এগোতে থাকে। মোজাফ্ফরের বাহিনী মন্দিরের উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ করবে। মমিন আক্রমণ করবে পশ্চিম দিক থেকে। তিন দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণে পাকিস্তানি মিলিটারিদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে।
ওদের একটি গ্রুপ বিদ্যুতের তার কেটে দেবে। অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার শুরু হবে। হলো তাই। মজনু লাইন পজিশন নিয়ে ফায়ার করছে। তখন পর্যন্ত পাকিস্তানি মিলিটারি ফায়ার শুরু করেনি। আকস্মিক বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় পাকিস্তানি মিলিটারিরা হতচকিত হয়ে পড়ে। আর এই ফাঁকে মুক্তিযোদ্ধারা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ফায়ার করে যাচ্ছে। মমিন মৃদু ধমকিয়ে মজনুকে বলে, ‘তুমি আন্দা-কুন্দা ফায়ার করছ কেন? টার্গেট করে ফায়ার কর।’
‘অন্ধকারে কীভাবে টার্গেট করব? মজনু প্রশ্ন করে।
‘ওরা যখন ফায়ার করে তখন দেখবে আগুন উসকে উঠছে। সেই আগুন লক্ষ্য করে ফায়ার করবে।’
অনেক পরে পাকিস্তানি আর্মি ফায়ার শুরু করে। এলএমজির গুলি বৃষ্টির মতো ঝরছে যেন। মাঝে-মধ্যে সেলিং করছে। সেটা কোনো লক্ষ্য স্থির না করেই সেলিং করে যাচ্ছে। ওরা ভয় দেখাতে চাইছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা জানে ওই সেলিং তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু নিরীহ মানুষজনের ঘরবাড়ি ধ্বংস হবে।
যুদ্ধের পরিকল্পনার সময় ঠিক করা হয়েছিল ওদের বাংকারে দুর্ধর্ষ কয়েকজন গেরিলা যোদ্ধা ক্রোলিং করে গিয়ে গ্রেনেড চার্জ করবে। সেটা করবে যখন কমান্ডার মোজাফ্ফর বাহিনী ‘জয়বাংলা’ বলে ধ্বনি দিয়ে উঠবে। তাই করা হলো। মোজাফ্ফর বাহিনী জয়বাংলা বলে ধ্বনির দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মমিনের বাহিনী আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে জয়বাংলা বলে চেঁচিয়ে ওঠে। তার কিছুক্ষণ পরই দ্রাম দ্রাম শব্দে পর পর কয়েকটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়।
যুদ্ধের পরিকল্পনার সময় মজনু চুপি চুপি বলেছিল, ‘ওস্তাদ, জয়বাংলা স্লোগানের সময় গ্রেনেড ছুড়বে কেন?’
মমিন উত্তরে বলেছিল, ‘আমরা যখন জয়বাংলা ধ্বনি দেব তখন ওরা বিভ্রান্ত হয়ে তারাও ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে থাকবে। আর এই ফাঁকে ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগে আমাদের গেরিলা যোদ্ধারা গ্রনেড ছুঁড়বে বাংকারে।’
যুদ্ধের কত রকমের কৌশল। মজনু অবাক হয়ে শুধু ভাবে। যুদ্ধের কাজটা কত কঠিন। আগের দিনের মতো তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধের মতো সহজ না। সেইসময় যার শরীরে শক্তি বেশি সে তত বড় যোদ্ধা। এখন তার এক আনাও মূল্য নেই। এখন যুদ্ধ হয় আধুনিক অস্ত্রের এবং কৌশলের।
একটু পর যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল। পাকিস্তানি আর্মির সাহায্যের জন্য বগুড়া শহর থেকে ট্রাকে করে শত শত পাকআর্মি করতোয়া নদীর ওপার থেকে মেশিনগানের বৃষ্টি ঝরাতে থাকে। সামনে পেছনে অস্ত্রের তুমুল আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা বেকায়দায় পড়ে যায়। যেটা তাদের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না। মমিন তার বাহিনী নিয়ে উত্তরপাশে সরে গিয়ে বাঁধের আড়ালে পজিশন নেয়। মোজাফ্ফরের বাহিনী এসে মমিনের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে করতোয়ার দিকে আক্রমণ ঘুরিয়ে দেয়। কোনো যুদ্ধই পরিকল্পনা মাফিক হয় না। এখন দুদিক থেকে আক্রমণ আসবে সেটা কী তারা ভেবেছিল। অথচ এখন দুদিকেই যুদ্ধ চালাতে হচ্ছে। নদীর ওপারে আগত মিলিটারিরা ভারী মেশিন গান এবং হেকলার জি-৩ রাইফেল দিয়ে গ্রেনেড ছুঁড়ছে। সেই গ্রেনেড আমাদের অবস্থানের আশে পাশে দ্রাম দ্রাম শব্দে বিস্ফোরিত হচ্ছে। এইটাই আমাদের ভয়ের বড় কারণ। আমাদের এই ভারী অস্ত্র চেক দেওয়ার মতো কোনো অস্ত্র নেই। ক্রমাগত হেকলার রাইফেলের গ্রেনেড এসে ব্লাস্ট হচ্ছে। আজ আমাদের নির্ঘাত মৃত্যুর মুখে পড়তে হবে। মমিন ভাবতে ভাবতে তার বাহিনীকে আরও উত্তরে নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়ার নির্দেশ দিল।
ততক্ষণে বিশাল আর্তনাদের শব্দ তাদের হতচকিত করে তুলল। খবর নিয়ে জানলো তাদের আরেক বাহিনীর একটি ছোট দলের উপর সেই গ্রেনেড এসে পড়েছে। কয়েকজন ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়েছে। বাকিদল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে। খেলায় যেমন জয়-পরাজয় আছে, যুদ্ধেও তেমন জয়-পরাজয় আছে। আজ কোনোভাবে যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব না। অতএব নিরাপদে এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। মমিন যখন এই সব ভাবছিল তখন যুদ্ধের কমান্ডার মোজাফ্ফরের নির্দেশ এল, বাহিনীকে উত্তরে সরিয়ে নিয়ে ওদের উপর সাঁড়াশি আক্রমণ করতে হবে। আদেশ পাওয়া মাত্র মমিন তার বাহিনী নিয়ে উত্তরে সরে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর পেছন থেকে আক্রমণ শুরু করে। মোজাফ্ফরের বাহিনী মূল ক্যাম্পের দিকে আক্রমণ করে যাচ্ছে। দুদিক থেকে আক্রমণ করেও পাকিস্তানি বাহিনীকে কিছুতেই কাবু করা যাচ্ছে না। ওদের মূল শক্তি ভারী অস্ত্র। ভারী অস্ত্রের সামনে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ছে। তবু সমানে সমান লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা। অনেক পড়ে দুই কামান্ডার বুঝতে পারলেন আজকের যুদ্ধে জয় করা অসম্ভব। বাঁচতে হলে বাহিনী উইথড্র করতে হবে। দুই বাহিনী কৌশলে যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করল। যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করার জন্য কৌশলগত ট্রেনিং নিতে হয়। যুদ্ধ জীবনটা সত্যি অদ্ভূত। ইচ্ছে করলেই যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা যায় না। সেটা করতে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। একদল মিলিটারির দিকে ফায়ার করতে থাকবে। সেইফাঁকে আরেকদল ভাগতে থাকবে। শেষের দলের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। খণ্ড খণ্ড দলে বিভক্ত হয়ে সবাই নিরাপদে পৌঁছে যাবে। আহতদের কাঁধে তুলে নিল। কিন্তু যারা শহীদ হয়েছে তাদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। নিজেদেরই যেখানে বেঁচে থাকার আশা নেই। সেখানে নিহতদের কথা ভাববে কখন? তাদের নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটল। ভোর হওয়ার তখন সামান্য বাকি। টানা দশ/বারো মাইল হেঁটে দুটো বাহিনী নিরাপদ স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিল।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
এসএন