ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৪
যারা যুদ্ধ করেছিল
ভাবনাটা এমনভাবে মাথায় জট পাকাচ্ছে যে রাতে তার ঘুম উবে গেল। একটানা একই ভাবনা। হঠাৎ তার মনে হলো মমিন ব্যাপারটা জানলে কী ভাববে? মমিন তার বন্ধু। পরক্ষণে তার মনে হলো, কোথায় মমিন? তার কি আর সশরীরে ফিরে আসার সুযোগ আছে? সাকিব নিজে নিজেই বলে, অসম্ভব। দেশ কোনো দিন স্বাধীন হবে না। মমিনও কোনো দিন ফিরে আসতে পারবে না। আসলে নির্ঘাত তার মৃত্যু।
সাকিবের এখনকার ভাবনা কীভাবে সাথীকে সে কাছে পাবে। নানাভাবে কাছে পাওয়ার কৌশল নিয়ে সে ভাবতে থাকে।
সকালে ঘুম ভাঙল বেলা করে। রাত কেটেছে নির্ঘুম। উঠে সাকিব হাঁটতে হাঁটতে সাথীদের বাড়ির দিকে যায়। দেখা হয় সাথীর বাবা করিম মিয়ার সঙ্গে। করিম মিয়া চরায় যাচ্ছিল কাস্তে হাতে। হ্যাংলা পাতলা করিম মিয়ার থুতনিতে একগোছা দাড়ি। পাক ধরেছে। মাথায়ও কাঁচা-পাকা চুল। বেশিরভাগ অংশ ফাঁকা। মাথায় গামছা পেঁচিয়ে সে যাচ্ছিল চরার দিকে। সাকিব দেখে সালাম দিলে করিম মিয়া দাঁড়িয়ে তাজিমের সঙ্গে সালামের জবাব দেয়। সাকিব তার ছেলের বন্ধু। সময় এখন তাদেরই। তার বাবা পাকিস্তানি মিলিটারিদের সঙ্গে চলা-ফেরা করে। বিরাট ক্ষমতা। তার ছেলেকে সমীহ না করে উপায় আছে?
‘বাবা কেমন আছ তুমি? করিম মিয়া মিষ্টি করে শুধায়।
‘আছি চাচা মোটামুটি। আপনারা কেমন আছেন?’
‘কেমন আর থাকব বাবা। সারাক্ষণ নানান দুশ্চিন্তায় থাকি। তোমার চাচিতো সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে।’
‘করারই কথা। মমিন এমন একটা কাম করবে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। মমিনের জন্য এখন আপনাদেরও নানান বিপদ। আমার বেশি ভাবনা সাথীকে নিয়ে। যুবতী মেয়ে। কে কখন বলে দেয় মমিন ইন্ডিয়া গেছে, দুস্কৃতিকারির খাতায় নাম লেখাইছে। তাহলে তো মহা বিপদ। কী বলেন চাচা?’ সাকিবের প্রশ্নে করিম মিয়া ঘাড় নেড়ে মাথা নামিয়ে থাকে। আর কী বলবে। বলার মতো কথা খুঁজে পায় না।
সাকিব বলে, ‘চাচা, একটা কথা বলব। কথাটা না বলেও পারছি না। বলতেও খারাপ লাগছে। কীভাবে যে বলব, তাই ভাবছি।’
‘তুমি বাবা সোজা-সুজি বল। তুমি তো আমাদের পর না।’
‘ঠিকই বলেছেন। আমি আপনাদের আপনার মানুষ। আপনার মানুষ হিসেবেই কথাটা বলছি। ব্যাটাদের নজর পড়েছে আপনার মেয়ে সাথীর উপর। ওরা সাথীকে তুলে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চায়। আব্বা তাদের ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে। তাদের কথা, ওর ভাই আমাদের বিপক্ষে, মুসলমানের দেশ পাকিস্তানের বিপক্ষে অস্ত্র ধরেছে। আমরা তার বাড়িঘর লুট করব। সাথীকে তুলে নিয়ে আগে ধর্ষণ করব তারপর ক্যাম্পে জমা দেব। কথাগুলো আমি নিজের কানে শুনেছি চাচা। শুনে স্থির থাকতে পারিনি। আমার মাথা চক্কর দিচ্ছিল। সাথী আমার বন্ধুর ছোট বোন। তার মানে সে আমারও ছোট বোন। তার এই অবস্থা আমি কীভাবে মেনে নেব চাচা, আপনি বলুন?’
করিম মিয়া কান্না গলায় বলে, ‘তুমি আমার মেয়েকে রক্ষা কর বাবা। আমি ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি মমিন যুদ্ধে যাবে। টের পাইলে কি ওরে আমি এই অবস্থায় যুদ্ধে যাইতে দিতাম? ওর মা তো সারাক্ষণ এই ভাইবা কান্দে। তুমি আমার মেয়েটাকে বাঁচাও বাবা।’
‘মা বলতেছিল সাথীকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে। মায়ের শরীরটা খারাপ। মাকে একটু দেখাশোনা করল। সেই সঙ্গে সাথী আমাদের বাড়িতে থাকলে কেউ আর ওকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারবে না। আপনি কী বলেন চাচা?’
কথাটা ঝড়ের গতিতে সাকিব বলে, করিম মিয়ার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে।
করিম মিয়া বলে, ‘এটাতো খুবই ভালো কথা। সাথীকে নিয়াইতো আমাদের বেশি চিন্তা। তোমাদের বাড়ি থাকলে আমাদের আর ভাবনার কিছু থাকবে না। সাথী তোমাদের বাড়ি থাকা আর আমাদের বাড়ি থাকা একই কথা।’
সাকিব কায়দা করে বলে, ‘চাচা এক কাম করেন। আপনি বাড়ি গিয়া চাচির সাথে পরামর্শ করে যেটা ভালো হয় সেইটা করেন।’
‘ঠিকই বলেছ বাবা। আমি অহনই যাইতাছি সাথীর মায়ের সাথে পরামর্শ করতে।’
করিম মিয়া দ্রুত বাড়ির পথ ধরে। সাকিব মুচকি হেসে সকালের মেঘমুক্ত আকাশ দেখে। আষাঢ় মাস শুরু হয়েছে। প্রতিদিন বৃষ্টি ঝরছে। আজ আকাশ নির্মল। এমন নির্মল আকাশ সচরাচর দেখা যায় না। সাকিব মনে মনে সাথীকে নিয়ে ভেবে নিজে নিজে ব্যাকুল হচ্ছে।
করিম মিয়াকে ফিরে আসতে দেখে সাথীর মা রমিছা বিবি অবাক বিস্ময়ে তাকায়। ‘কী অইলো ফিরা আইলেন ক্যা?’
‘তোমার সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে আইলাম।’ করিম মিয়া কাঁচি বেড়ার বাতায় গুঁজে রেখে বারান্দায় এসে মাটিতে ঠেস দিয়ে বসে।
‘কী পরামর্শ?’ ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে রমিছা বিবি।
করিম মিয়া সব ঘটনা খুলে বলে। সাকিবের সঙ্গে কী কী কথা হয়েছে, সাকিব কী পরামর্শ দিয়েছে একে একে সব বিস্তারিত বলে করিম মিয়া। রমিছা বিবি সব শুনে লম্বা করে শ্বাস ফেলে। কান্না গলায় বলে, ‘শেষ পর্যন্ত মেয়েটার কপালে এই আছিল।’ বলতে বলতে শব্দ করে শ্বাস ফেলে। কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। করিম মিয়া ধমকে বলে, ‘কান্নাকাটির কী অইলো, আমিতো কিছুই বুঝতাছি না।’
‘আপনি বুঝবেন কী? আপনি কী মাইয়া মাইনষের সব কিছু বোঝেন?’
‘মাইয়া মাইনষের সব কিছু আবার কী?’ করিম মিয়া বোকার মতো প্রশ্ন করে উদাসভাবে তাকিয়ে থাকে। রমিছা বিবি বলে, ‘আপনি আপনার কামে যান। আপনার এত কিছু বোঝা লাগবে না।’
‘বোঝা লাগবে। আমাকে একটুপর সাকিবকে রেজাল্ট জানাতে হবে। মাথার খাড়া বিপদ নিয়ে কামে যাই কেমনে?’
এই সময় সেখানে আসে সাথী। সে পাশের বাড়িতে গিয়েছিল ধান শুকাতে। সামান্য আউস ধান পেয়েছে করিম মিয়া। নিজেদের উঠোন না থাকায় পাশের বাড়ির উঠোনে সেদ্ধ ধান শুকাতে নিয়ে গেছে সাথী। তাকে সাকিবের বলা কথা সব খুলে বলে করিম মিয়া। সব শুনে সাথী বলে, ‘বাজান চলো আজই আমরা নানার বাড়ি গিয়া আশ্রয় নেই।’
‘সেখানে রাজাকার নেই?’ কঠিন গলায় প্রশ্ন করে করিম মিয়া।
‘শুনছি ওখানে নিরাপদ। ভাইয়াও তাই বলে গেছে।’
মমিনের কথা শুনে করিম মিয়া তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। ‘ওই হারামখোরের কথা আর কইস না। তার জন্যে আজ আমাদের এই দুর্দশা।’
‘দুর্দশা বলছো কেন বাজান, আমার তো গর্ব হচ্ছে।’
‘গর্ব না ছাই। ওর নামই নিস না।’
‘ঠিক আছে নিমু না। নানার বাড়ি যাইতে তো অসুবিধা নাই।’
‘আছে। পরিষ্কার করে কইতাছি, আমাকে অন্য কোথাও যাইতে কইস না।’
‘গেলে অসুবিধা কী?’
‘সেখানে গিয়া খাবি কী? তোর নানারা নিজেরাই ভাত পায় না। একবেলা খায় তো দুই বেলা উপাস থাকে। আমরা গিয়া তাদের বিপদ আরও বাড়াইতে চাস?’
‘তাইলে সাকিবের কথা মতো ওগো বাড়ি সাথীরে পাঠাইতে চান?’ রমিছা বিবি জিজ্ঞেস করে।
করিম মিয়া আমতা আমতা করে বলে, ‘গিয়া থাক না কয়দিন। পরে অবস্থা বুইঝা ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
চলবে...
আগের পর্বটি পড়ুন>>>