ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩
যারা যুদ্ধ করেছিল
জিন্না তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি ও মুসলিম লীগেরও সভাপতি। নয় দিনের পূর্ববঙ্গ সফরে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের কয়েকটি শহরে সে ভাষণ দেয়। সবখানেই সে বলে, ’উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।’ কার্জন হলে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা বলার পর কয়েকজন ছাত্র ‘না’ ‘না’ বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে থাকে। যা জিন্নাকে ভীষণ অপ্রস্তুত করেছিল। কিছুক্ষণ সে বক্তৃতা বন্ধ রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল।
জিন্না ঢাকায় এসব কথা বলেছিল এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে। তার ঢাকা সফরের আগেই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেখা যায় নতুন দেশের ডাক টিকিট, মুদ্রা, মানি অর্ডার বা টাকা পাঠানোর ফর্ম, ট্রেনের টিকিট, পোস্টকার্ড সব উর্দু ও ইংরেজিতে লেখা। এর প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা বিক্ষোভ সমাবেশও করে। পূর্বপাকিস্তানে কর্মরত উর্দুভাষী সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বাঙালি কর্মকর্তাদের প্রতি বিরূপ আচরণের অভেযোগ ওঠে। একইরকম মনোভাবের শিকার হন পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তারাও।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও সরকারি চাকরিতেও ছিল অবাঙালিদের প্রাধান্য। পরে দেখা যায় পূর্বপাকিস্তান থেকে নৌবাহিনীতে লোক নিয়োগের ভর্তি পরীক্ষায়ও হচ্ছে উর্দু ও ইংরেজিতে। জিন্না যেদিন কার্জন হলে ভাষণ দেয় সেদিনই বিকেলে তার সঙ্গে দেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি দল। এসময় ভাষা নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক প্রায় ঝগড়াঝাটি পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তারা জিন্নাকে একটি স্মারকলিপিও দেয়। তাতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। কানাডা, বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডের মতো দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে এমন কিছু দেশের উদাহারণ দেওয়া হয়। এই ছাত্রনেতারা অনেকেই ছিল জিন্নার দল মুসলিম লীগের সমর্থক। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশ কেন্দ্রীয় নেতাদের চাইতে ভিন্ন ভূমিকা নিয়েছিল।
সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও অধ্যাপক মিলে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। যারা শুরু থেকেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে নানারকম সভা-সমিতি আলোচনার আয়োজন করে। গঠিত হয়েছিল একটি ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও’।
উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা-বার্তা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই পূর্ববঙ্গের ছাত্র, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ, বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, এটা বাঙালিদের জন্য চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। যার ফলে পাকিস্তানে উর্দু ভাষীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। বাঙালিরা সরকার ও সামরিক বাহিনীতে চাকরি বাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়বে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বাঙালি মুসলমানদের উন্নয়ন ও সামাজিক বিকাশের যে স্বপ্ন তারা দেখেছিল তা চরমভাবে ব্যাহত হবে। অথচ পাকিস্তানের বাস্তবতা ছিল এই যে, সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই ছিল বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানের ৪০ শতাংশ মানুষের ভাষার ছিল পাঞ্জাবি আর ৪ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল উর্দু। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হয়েও বাংলাভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে না। এটা পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। শুরু হয় দেশব্যাপী আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদ ঘেরাওয়ের ডাক দেওয়া হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। অনেক বিতর্কের পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। খণ্ডে খণ্ড দলে বিভক্ত হয়ে মিছিল নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমে আসে। সেই মিছিলে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই কয়েকজন ছাত্র মারা যায়। আহত হয় শত-শত। সেদিন ভাষার জন্য শহীদ হন রফিক-শফিক-বরকত-সালাম-জব্বারসহ আরও অনেকে।
ভাষা আন্দোলন থেকে বৃহত্তর আন্দোলনের দানা বাঁধতে থাকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। আজ যারা রাজাকার হয়েছে তারা এ ইতিহাস জানে না। এমনকি সাকিবও জানে না। মমিন রাজনীতি না করলেও সে এসব জেনেছে ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে ইতিহাস পড়ে।
রাইফেল কাঁধে তিনজন রাজাকার ফজলুর রহমানের বাড়িতে আসে। বাইরে থেকে ডাকতে থাকে। ‘মেম্বর সাহেব বাড়ি আছেন? মেম্বর সাহেব?’
বেরিয়ে আসে সাকিব। সাকিবকে দেখে সালাম দেয় রাজাকার আলিম। আলিম কিছুদিন মাদ্রাসায় পড়েছে। সামান্য কিছু লেখাপড়া করার পর ওই পাঠ চুকিয়ে বাড়ি এসে বাউন্ডেলেপনা করে ঘুরে বেড়ায়। রাজাকার গঠনের কথা শুনে আলিম স্বেচ্ছায় এসে রাজাকারের খাতায় নাম লেখায়। ট্রেনিং নেয় অস্ত্র চালানোর। খুবই গরিব ঘরের সন্তান আলিম। রাজাকারে নাম লেখালে মাস-মাস বেতন পাবে। আর পাবে গনিমতের মাল। আলিমের ঘাড়ে অস্ত্র দেখে সবাই ভয় পায়। সমীহ করে। এই আনন্দে আলিম নিজেকে বিরাট কিছু ভাবে। তার দুজন সাগরেদ আছে। তারাও রাজাকারের ট্রেনিং নিয়েছে। তারাও বুক ফুলিয়ে রাজা বাদশার মতো চলাফেরা করে। তারা শান্তি কমিটির মেম্বর ফজলুর রহমানের কাছে এসেছে একটি অনুমতির জন্য।
‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে?’ সাকিব বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে।
আলিম বলে, ‘মেম্বর সাহেব বাড়ি নাই?’
‘না নেই।’ সাকিব বলে।
আলিম বলে, ‘তাকে ভীষণ দরকার। একটা অপারেশন করতে হবে। তার অনুমতি ছাড়া সেটা করা যাচ্ছে না।’
‘আমাকে বলা যাবে?’ সাকিব জিজ্ঞেস করে।
‘আপনিতো এসবের মধ্যে নাই। আপনাকে কীভাবে বলি।’
‘বলে দেখতে পার। আমি আব্বার সঙ্গে কথা বলে তোমাদের জানাব।’
আলিম সাহস নিয়ে এগিয়ে এসে বলে, ‘আমরা মধ্যপাড়ার মমিন মুক্তি বাহিনীতে গেছে। আমরা পাকিস্তান রক্ষায় জীবন দেওয়ার জন্য আল্লার কসম খাইছি। আর কিনা আমাদের চোখের সামনে সে মুক্তিবাহিনী হয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? ইন্ডিয়ার দালালি করবে। আর আমরা তাই মাইনা নিমু?’
সাকিব সহজভাবে বলল, ‘তাতো মানা যায় না। কিন্তু তোমাদের ইচ্ছা কী? কী করতে চাও তোমরা?’
‘এই জন্যেতো আমরা মেম্বর সাহেবের কাছে পরামর্শ করতে আছি। উনি যা বলবেন আমরা তাই করব।’ বলল আলিম।
বেটে খাটো রাজাকার, নাম জহর, তোতলিয়ে কথা বলে। সে বলল, ‘আমাদের ইচ্ছা মমিনের বাপকে ধাইরা মিলিটারি ক্যাম্পে দিয়া যামু।’ লম্বা ফর্সা বোকা টাইপের গেদু রাজাকার বলল, ‘আমার ইচ্ছা ওর বোনটাকে আমরা বিয়া করমু।’
সাকিব বললো, ‘তিনজন মিলা একজনকে বিয়া করবি? এটা কেমন কথা?’
রাজাকারের কমান্ডার আলিম বাধা দিয়ে বলল, ‘আমরা তো সবাই বিয়াত্ত। আমাদের মধ্যে একজন আছে সে অবিয়াত্ত। চেহারা সুরুত মাশাল্লাহ ভালো।’
‘কে সে?’
আলিম বলে, ‘আপনি চিনবেন না। বাড়ি ভেন্নাগাছি। আমাদের সাথে রাজাকারে ভর্তি হইছে। দুর্দান্ত সাহস। মুক্তিফৌজ পাইলে বেয়োনেট দিয়া খোঁচাইয়া শেষ কইরা ফেলে। একটু ভয় ডর নাই।’
সাকিব তাচ্ছিল্য ভঙ্গিতে বলে, ‘রাজাকারদের সাহস আমার চেনা আছে। মুক্তিবাহিনীর নাম শুনলে তোরা কাপড় নষ্ট কইরা ফেলিস। আবার মুখে বড় বড় কথা। শোন, আব্বার সাথে আমার কথা হইছে। মমিনের বাবা-মা ও সাথীর ব্যাপারে তোদের কিছু করতে হবে না। যা করার আব্বা করবে।’
‘কী করবে মেম্বর সাহেব?’
সাকিব গম্ভীর ভাবে বলে, ‘কী করবে তা কি তোদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে?’
আলিম আমতা আমতা করে বলে, ‘না ভাইজান। আমরা একটা প্লান করছিলামতো, তাই জিগাইতেছিলাম।’
‘কী প্লান?’
‘না। থাক ভাইজান। আমগো প্লান হুইনা কাম নাই। মেম্বর সাহেবের প্লান মতোই কাম হবে। আমরা যাইগা। চল তোরা।’
ফর্সা লম্বু গেদু রাজাকার তবু বলে, ‘ব্যাপারটা ভাইবা দেখেনে ভাইজান, আমগো চোখের সামনে মুক্তিফৌজে গেছে মিলিটারি জিগাইলে কী জবাব দিমু আমরা?’
‘আবার জিগায়। কইলাম না এইটা নিয়া তোদের ভাবতে হবে না।’
আলিম আবার তাগাদা দেয়, ‘চল চল।’
রাজাকাররা চলে যায়। সাকিবের মাথায় ভিন্ন চিন্তা এসে ভর করে। সাথীকে নিয়ে নতুন করে ভাবনা তৈরি হয় মনে। সাথীকে সে একান্তে পেতে চায়। এই ভাবনাটা হঠাৎই মাথায় ঝাঁকিয়ে শক্ত করে চেপে বসে। রাজাকাররা তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার করেছে। কথাটা শুনে নিজের মধ্যে সেই ভাবনাটা আবার মাথা চারা দেয়। ব্যাপারটা নিয়ে জটিল ভাবনা শুরু হয় সাকিবের মনে।
চলবে...
আগের পর্বটি পড়ুন>>>