ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২১
স্নানের শব্দ
ঋতু বদলের মতোই মানুষ বদলায়, সময় বিশেষে পরিবর্তিত হয়, এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু মনিরুজ্জামানের এই হঠাৎ বদলে যাওয়া আচরণ, কেনো যেন শবনম মন থেকে মানতেই পারছে না। সেই ভীরু লাজুক বিনয়ী ছেলেটার জায়গায় এই রাগী হিংস্র উদ্ধত যুবককে সে যেন ঠিক চিনতে পারছে না। মানুষকে হয়তো কখনোই পুরোপুরি চেনা যায় না। শুধুমাত্র চাকরি হারানোর ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে মনিরুজ্জামান এই রূপ ধারণ করেছে কি না বুঝতে পারছে না শবনম। হতে পারে শবনমের চোখে এটা মাত্র চল্লিশ হাজার টাকা বেতনের একটা চাকরি কিন্তু মনিরুজ্জামানের কাছে তো এটাই সব। তারপরও এমন একটা ব্ল্যাকমেইলিং পর্যায়ে বিষয়টা নিয়ে গেছে সে, শবনম যার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিল না। আবার অবস্থাটা এমন যে তার বিরুদ্ধে অফিশিয়াল একশনও সে নিতে পারছে না। এ যেন বাধ্য হয়ে নিজের আর্তনাদ নিজের গিলে ফেলার মত অবস্থা। কাউকে নালিশও করা যায় না আবার সহ্য করাও সম্ভব হচ্ছে না।
মন বিক্ষিপ্ত থাকলেও পরের দিনের বোর্ড মিটিং-এ আটঘাট বেঁধেই যোগ দিল শবনম। মিটিংএর শুরুতেই ফাইজুল চৌধুরী তার ভারী গম্ভীর গলায় শবনমের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুরে বলল, ‘কালই বিদায় করে দেন এই চার জনকে। দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ভালো।’ ‘কিন্তু সরাসরি বিদায়, একটাতো কারণ দর্শানো নোটিস বা ওয়ার্ণিং দেয়া লাগে ..’
শবনম অফিশিয়াল সিস্টেমের মধ্যে ফেলে ব্যাপারটা একটু ধীর করতে চায়।
‘না, না, ওসব শুধু সময় নষ্ট, যা করার তাড়াতাড়ি করেন। টেক একশন প্লিজ ..’ ফাইজুল চৌধুরী বলে।
শবনম এবার অন্য পথ ধরে।’
‘সে তো অবশ্যই, একশন তো নেওয়াই যায়। কিন্তু যে তথ্যটা ওরা ফাঁস করেছে, মানে, যদি করেই থাকে, তবে সেটাতো মিথ্যা নয়। ওসমান গণির দোষ প্রমাণিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে এই ছেলেগুলো তো হুইসেল ব্লোয়ারের কাজ করেছে। প্রতিষ্ঠানের ভেতরের দুর্নীতির খবর আগে ভাগে জানিয়েছে। এখন হুট করে চাকরি খেয়ে দেওয়া অনেকটা লঘু পাপে গুরুদন্ড হয়ে যাচ্ছে না !’
‘না, না, দেখেন এসব অফিস শৃঙ্খলার পরিপন্থী কাজ, আপনিতো সব বোঝেনই, এসব কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। পরে দেখবেন, আপনার পেছনে লোক লেগে গেছে। অথবা আপনার প্রতিপক্ষ কাউকে টাকা পয়সা দিয়ে আপনার পেছনে গোয়েন্দা হিসেবে লাগিয়ে দিয়েছে। ভারি একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হবে।’ ফাইজুল চৌধুরীর গলায় বিরক্তি।
শবনম তবু প্রায় মরিয়া হয়ে ওদের চাকরি যাওয়া ঠেকানোর চেষ্টা করে। বলে, ‘স্যার, বিষয়টা আরেকটু বিবেচনা করার সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয়। ওদের মেমো দিয়ে সতর্ক করা যেতে পারে। তা ছাড়া, অফিশিযাল প্রসেস না মেনে ওদের সাসপেন্ড করলে আবার বাইরে কথা উঠবে। স্যার ওরা কিন্তু আদালতেও যেতে পারে, তখন প্রতিষ্ঠানের ইমেজ সংকট হতে পারে। সব দিকগুলোই আমাদের ভেবে দেখা দরকার।’ এবার কনফারেন্স টেবিলের কোণার দিক থেকে সাত্তার জাহেদি সাহেবের চিকণ গলা শোনা যায়।
‘শোনেন ম্যাডাম, ওদের বাঁচাতে আপনার এই তৎপরতা কিন্তু অন্য মেসেজ দিচ্ছে !’
জাহেদি যে ওসমান গণি ব্লকের মানুষ সবাই জানে সেটা। তার বলা প্রতিটি শব্দ যে ওসমান গণির পক্ষেই যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শবনম পিঠ সোজা করে সতর্ক হয়ে বসে। বিশাল বোর্ড রুমে হঠাৎ তার নিজেকে খুব একা আর অসহায় মনে হয়। এতগুলো বয়স্ক কোট টাই পরা, গোঁফ দাড়িঅলা পুরুষের মধ্যে মিটিং-এর টেবিলে সেই একমাত্র নারী। যদিও এই দৃশ্য এবারই প্রথম নয়, তবু চারিদিকে তাকিয়ে আজ তার মনটা হঠাৎ কেমন শুন্য লাগল। মনে হলো, আহা এই অকূল পাথারে কেউ যদি অজান্তে অদৃশ্যভাবে আজ তার হাতটা ধরে রাখতো! যদি তাকে সমর্থন করার মতো কেউ একজন থাকত!
সাত্তার জাহেদি নাঁকি সুরে বলে চলেন, ‘দেখেন, গণি সাহেব দুর্নীতি করেছেন কি করেন নাই, তা নিয়ে আমার কোনো কথা নাই। কিন্তু গণি সাহেবের চলে যাওয়ায় খালি চোখেই বোঝা যায় সবচে বেশি বেনিফিশিয়ারি হয়েছেন আমাদের বর্তমান সিইও ম্যাডাম। সে কারণেই কারা, কী উদ্দেশে, কার ইঙ্গিতে, ঠিক প্রমোশনের আগের মুহূর্ত এইসব তথ্য ফাঁস করল তা খতিয়ে দেখা দরকার। ঠিক কি না? তবে হে হে হে, লোকে কিন্তু আপনার দিকেই আঙুল তুলছে ম্যাডাম। হে হে হে মানে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাচ্ছে আর কি!’
শবনমের দুই কান গরম হয়ে ওঠে, ভেতরে ভেতরে খুবই বিক্ষুব্ধ বোধ করে সে। বুঝতে পারে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এইসব অপমানসূচক কথাবার্তা বলা হচ্ছে তাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এই ফাঁদে পা দিয়ে ওদের জিতিয়ে দিতে রাজি নয় সে। তাই রাগে মুখ চোখ লাল হয়ে উঠলেও জোর করে মুখে একটা হাসি হাসি ভাব ধরে রাখে শবনম। তারপর কাঁধ ঝাকিয়ে বলে, ‘দেখেন, লোকে বললে তো আমার কিছু করার নাই। কান নিয়েছে চিলে, শুনেই তো আমি চিলের পেছনে দৌড়াব না। কিন্তু আপনারা যদি সেরকম করে অঙ্ক মেলাতে চান, তাহলে সেটারও তদন্ত হতে পারে, আমি তো বার বার বলেছি যে সেটা হোক।’
মিটিং তারপর আর বেশিদূর আগায় না। সিদ্ধান্ত হয় প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেই মনিরুজ্জামানসহ চারজনের অব্যাহতির প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিশ, পরে সাসপেন্ড আর সবশেষে বিদায়। এই সিদ্ধান্ত শবনমের কাঙ্ক্ষিত ছিল না। সে মনে প্রাণে চেয়েছিল ওই চারজনের চাকরি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হোক। কিন্তু পরিস্থিতি তার অনুকূলে ছিল না, নিয়ন্ত্রণাধীনও ছিল না। সবাই যখন বিপক্ষে মত দিচ্ছে তখন হাওয়ার বিপরীতে একলা উড়তে গেলে ডানা ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এই পৃথিবীর অনেক কিছুর উপরই আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না সেটা মেনে নিতে হবে। শবনম নিজেকে বোঝায়। যদিও একটা তীব্র ব্যর্থতা বোধ একটা পরাজিত মনোভাব একটা হতাশার চাদর তাকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে। মনের কোণায় কোথায় যেন একটা বিষণ্ন সুর অনবরত বাজতে থাকে।
মনের উপর সিন্দাবাদের বুড়োর মতো চেপে বসা সেই হতাশা অবসাদ আর বিষণ্নতা সঙ্গী করেই অফিস ছেড়ে তার নিজের ফ্ল্যাটের দরজায় পা রাখে শবনম। ঘরে বেশ একটা উৎসবের ভাব। শ্রাবণ দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। আমেরিকার একটা ভাল বিশ্ববিবদ্যালয় থেকে ইমেইল এসেছে। ওরা শ্রাবণকে ওর পছন্দের বিষয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হবার উপযোগী মনে করে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছে। টিউশন ফী একটু বেশি কিন্তু ভাল সাবজেক্ট পাচ্ছে। তা ছাড়া ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়েও বিশ্ববিদ্যালয়টার অবস্থান বেশ উপরের দিকে।
‘তুমি খুশি হয়েছ মা?’ শ্রাবণ আহ্লাদের সুরে জানতে চায়।
লিভিং রুমের নরম সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে শবনম ম্লান হাসে, ‘খুব খুশি হয়েছি। আর আমি তো সবসময় তুই খুশি হলেই খুশি হয়ে যাই।’
শ্রাবণ মায়ের পাশে এসে দুই পা তুলে বসে, ‘ওহ মা, তুমি নিজের খুশি অন্যের খুশির সঙ্গে মিলায়ো না তো। এই যে বলো না, তুই খুশি তো আমি খুশি, সেটা না। তুমি সেলফ খুশি হও। একদম নিজের জন্য নিজে খুশি। অন্যের সঙ্গে মিলানো খুশি না!’
শবনম এবার আরও হাসে, ‘ অন্যের সঙ্গে মিলালাম কই? তোর মতো একটা দারুণ মেয়ের মা আমি, সেটাই তো খুশির কারণ। ভাল জায়গায় চান্স পেলি, খুশি হব না! আর জানিস তো মানুষের প্রায় সব আবেগের সঙ্গেই অন্যের সম্পর্ক থাকে, কেউ দুঃখ দেয়, কেউ ভালবাসা দেয়, কেউ আনন্দ দেয় ..’
শ্রাবণ এবার একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে সেটা, বাট ইউ হ্যাভ মেনি মোর রিজনস টু বি হ্যাপী, মা। প্লিজ, ফাইন্ড দেম! ক্যারিয়ারে তোমার কত সাক্সেস, সেটা একদমই তোমার একার অর্জন! সেটা সেলিব্রেট করো, সেই জন্য আনন্দিত হও। আনন্দের বাকি জায়গাগুলো খুঁজে বের করো! মেইক ইওরসেলফ হ্যাপি! অন্তত নিজের সুখ আর আনন্দের জন্য অন্যের উপর ডিপেন্ড করো না!‘
শবনম মুখে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে মেয়ের সরল নিস্পাপ আনন্দিত মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। সব মায়ের মতোই তার মনে হতে থাকে, এই মেয়ে তার পেটে ছিল, বিশ্বাস হয় না! বাউলরা কি যে গান লিখেছেন, ‘ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম’ ! হয়তো এর অন্য কোনো গুঢ় অর্থ আছে, কিন্তু শবনমের মনে হয় শ্রাবণের মধ্য দিয়ে তার পুনর্জন্ম হচ্ছে। নতুন করে যেন ওর চোখ দিয়ে দুনিয়া দেখছে সে।
চলবে...
আরও পড়ুন>>>