ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব -২
যারা যুদ্ধ করেছিল
সাকিব যেদিন শুনল মমিন যুদ্ধে যাবে সেদিনই মমিনের কাছে এসে বলল, ‘এই পাগলামির কোনো মানে হয়? তুই কি করে ভাবলি পাকিস্তানি মিলিটারি পুঁচকে মুক্তিবাহিনীর কাছে হেরে যাবে এবং তারপর দেশ স্বাধীন হবে? তুই কি পাগল হয়েছিস?’
‘দেখ সাকিব, এই যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলবে। আমার ধারণা, পাকিস্তানিরা একসময় মনোবল হারিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়বে।’ ‘তুই উল্টোটা বুঝেছিস। পাকিস্তানিরা মনোবল হারাবে না। মনোবল হারাবে ভাইতা বাঙালি। বাঙালির কাছে কি এমন অস্ত্র আছে যে সেই অস্ত্র দিয়ে তারা শক্তিশালী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? ইন্ডিয়া তোদের নাচাচ্ছে আর তোরা বেকুবের মতো নাচছিস। তুই আর যাই করিস তোর পরিবারকে ধ্বংস করিস না।’ সাকিব জোর দিয়ে বলল।
মমিন বলল, ‘শুধু অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ হয় না। যুদ্ধের প্রধান শক্তি মনোবল। পাকিস্তানিরা আমাদের দেশ ধ্বংস করতে এসেছে আর আমরা আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করব। দুয়ের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। তুই সেই ব্যবধান ধরতে পারছিস না।’
‘তুই যুদ্ধে গেলে ব্যাপারটা কি চাপা থাকবে? সবাই জেনে যাবে তুই যুদ্ধে গেছিস। তখন রাজাকাররা এসে তোর বাবা-মাকে ধরে নিয়ে যাবে। এই ব্যাপারটি তুই একবারের জন্যেও ভাবছিস না।’
‘ভাববো না কেন? অবশ্যই ভাবছি।’
‘তারপরও তুই যুদ্ধে যেতে চাইছিস? তোর কলেজ পড়ুয়া বোন সাথীর কথা একটু হলেও ভাবা দরকার। যদি তোর কারণে রাজাকাররা ওকে তুলে নিয়ে যায়?’
মমিনকে ভাবনা কাতর দেখায়। নিঃশব্দে মাথা নামিয়ে থাকে। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘তুলে নিয়ে গেলে আমি থাকলেই কি ঠেকাতে পারব?’
‘তারমানে তুই যুদ্ধে যাবি?’
‘হ্যা। যুদ্ধে আমাকে যেতেই হবে। দেশটা শত্রুমুক্ত করতে হবে। পাকিস্তানিরা এই দেশটাকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছে। আর বাবা-মায়ের কথা বলছিস? অন্য যারা যুদ্ধে গেছে তাদের বাবা মায়ের যা হবে আমার বাবা-মায়েরও তাই হবে। আমার প্রশ্ন, তুই আমাকে যুদ্ধে যেতে বারণ করছিস, এ দেশটা কি তোর না? তুই যুদ্ধে যাচ্ছিস না কেন?’
‘তোর মতো আমাকে পাগলা কুত্তা কামড়ায়নি। আমি বেকুবের মতো নিজের জানটা নিজে নিজেই খোয়াতে চাই না।’ সাকিব রাগত কণ্ঠে বলে চলে যাচ্ছিল। মমিন তাকে ডেকে থামায়। বলে, ‘একটা অনুরোধ করবো। রাখবি?’
‘বল কি অনুরোধ?’
‘তুই আমার বন্ধু। আমার বোন সাথীকে তোর হাতে রেখে গেলাম। তুই ওকে দেখে রাখবি? কথা দে।’
সাকিব থমকে তাকালো মমিনের দিকে। বললো, ‘আমি বুঝতে পারছি না, যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে তুই এতো এডামেন্ড কেন? তোকেতো আমি কোনোদিন রাজনীতি করতে দেখিনি। হলে যখন ছিলাম, নেতাদের চাপে পড়ে আমি তবু দু’একদিন মিছিলে গেছি, তোকেতো একদিনও মিছিলে যেতে দেখিনি। সেই তুই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছিস। এই ব্যাপারটা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না।’
‘মিছিলে যাওয়া আর যুদ্ধে যাওয়া এক কথা নয়রে সাকিব। যুদ্ধে যাওয়ার নাম দেশপ্রেম। আমি আমার দেশকে ভালবাসি। দেশপ্রেমের টানে আমি যুদ্ধে যেতে চাই।’
‘কোন দেশ?’ সাকিব কঠিন গলায় প্রশ্ন করল।
মমিন বলল, ‘দেশতো একটাই। বাংলাদেশ।’
সাকিব জোর দিয়ে বলল, ‘দিবা স্বপ দেখা বাদ দে। এই দেশ কোনোদিন বাংলাদেশ হবে না। চ্যালেঞ্জ করলাম তোর সঙ্গে। পাকিস্তান ভাঙা অতো সহজ না। ইন্ডিয়া যত ফালাফালি করুক পাকিস্তানের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তুলার মতো উড়ে যাবে।’
‘সে যা ইচ্ছে হোক। তুই আমাকে কথা দে। আমার কথাটা গোপন রাখবি। আর আমার বোন সাথীকে তুই দেখে রাখবি। তোর ভরসায় সাথীকে রেখে গেলাম। রাখবি না আমার কথা?’
‘এতো করে যখন বলছিস। তখন কি আর করা। কথা দিলাম।’ মমিন উঠে সাকিবকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আবেগে দুজনই কেঁদে ফেলে।
মমিন আরও দুই বন্ধুর সঙ্গে একদিন ভোর রাতে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তাদের লক্ষ্য ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্প। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং হচ্ছে। প্রবাসি মুজিবনগর সরকার তরুণ যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ‘স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের’ মাধ্যমে বার বার আহ্বান জানাচ্ছে।
গ্রাম পেরিয়ে যেতে মমিন একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে নিল প্রিয় গ্রামকে। দেশ স্বাধীন না হলে এই গ্রামে তার আর ফেরা হবে না। শেষবারের মতো দেখে নিল গ্রাম। বুকের মথ্যে হু হু করে ওঠে। চোখ ভিজে আসে। পেছনে ফেলে গেল বৃদ্ধ পিতা-মাতা আর কলেজ পড়ুয়া ছোট বোন সাথীকে। সাথীর দায়িত্ব বন্ধু সাকিবকে দিয়ে মমিন অনেকটা নিশ্চিন্ত। সাকিব তার ছোটবেলার বন্ধু। সেই স্কুল জীবন থেকে তারা একসঙ্গে বেড়ে উঠছে।
সাকিব অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। তার বাবা বিডি মেম্বর। মুসলিম লীগের সমর্থক। জেনারেল টিক্কা খান পাকিস্তান রক্ষায় সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে ‘শান্তি কমিটি’ করার নির্দেশ দেওয়ায় সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সাকিবের বাবা ফজলুর রহমান ইউনিয়ন ‘শান্তি কমিটি’র মেম্বর হয়েছে। পাঞ্জাবির বুক পকেটে পাকিস্তানের ছোট পতাকা লাগিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সাকিব যে এই কারণে যুদ্ধে যাচ্ছে না এই ব্যাপারটা মমিন ঠিকই বুঝতে পেরেছে। সেও তার বাবার মতো পাকিস্তান পন্থি।
গ্রামে কয়েকজন রাজাকারও হয়েছে। তারা রাইফেলের ট্রেনিং নিয়ে কাধে রাইফেল নিয়ে বীর দর্পে ঘুরে বেড়ায়। এলাকায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছে ফজলুর রহমানের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে। রাজাকাররা পাকিস্তান বাহিনীকে সাহায্য করবে। তারা মাস গেলে বেতন পাবে। তারা পাকিস্তান রক্ষা করবে। এটা তাদের ঈমানি দায়িত্ব। তারা জানে না পাকিস্তানের রাজনীতির আসল চরিত্র।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে হিন্দুস্তান। বাংলা ভাগ হলো। কত কত মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেল। দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তুর মতো রিফুজি হয়ে গেল। সাধের ভিটে মাটি ছেড়ে পালিয়ে অন্যদেশে গেল। পূর্ব বাংলার নাম হলো পূর্ব পাকিস্তান। এই পূর্বপাকিস্তান নাম নিয়ে প্রতিবাদ করেন তরুণ নেতা শেখ মজিবুর রহমান। ১৯৫৭ সালে করাচিতে গণপরিষদের তরুণ সদস্য শেখ মজিবুর রহমান বক্তৃতা দেওয়ার সময় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটির প্রতিবাদ করে বলেন, ‘পূর্ব বাংলা নামের একটা ইতিহাস ঐতিহ্য আছে। আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয় তাহলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা এই নামের পরিবর্তন মেনে নেবে কিনা সেজন্য গণভোট দিতে হবে।’
তার আগেই পূর্ববাংলার জনগণের আশা ভঙ্গ হয়েছে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নার এক ঘোষণায়। পাকিস্তান জন্মের মাস সাতেক পরে জিন্না ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় আসে। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে সে ঘোষণা দেয়, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।’ এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তার উক্তির চরম প্রতিবাদ জানায়। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। সারা দেশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। জিন্না হয়ত বুঝতে পারেনি তার উচ্চারিত কিছু কথায় তারই প্রতিষ্ঠিত নতুন দেশটির ভাঙন ডেকে আনতে ভূমিকা রাখবে।
চলবে…
আগের পর্বটি পড়ুন>>>
আরএ/