ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব -১
যারা যুদ্ধ করেছিল
বড় গামলা ঘিরে গোল হয়ে বসে সবাই সরষের তেল-পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে মাখানো মুড়ি খাচ্ছে। মজনু বার কয়েক সাধাসাধি করেছে। মমিন রাজি হয়নি। মমিনের খাওয়া নিয়ে কোনো বাছাবাছি নেই। প্লেটে যা আসে তাই সে খেয়ে ওঠে। শুধু এই মুড়িটা তার সমস্যা। মুড়ি খেলে পেট ফাপে। আশ্চর্য কথা। অন্যদের মুড়ি খেলে পেটের গ্যাস দূর হয় আর মমিনের হয় উল্টো। মানব শরীর বড় রহস্যময়। একেক জনের শরীর একেক ভাবে গড়া। কারো দুধ খেলে বদহজম হয়। কারো ডাবের পানি খেলে সর্দি লাগে। অথচ দু’টোই মানব দেহের জন্য ভীষণ উপকারি।
মুড়ি খাওয়া নিয়ে হৈ হল্লা করছে সবাই। কয়েকটি হাত একসঙ্গে গামলায় ঢুকছে। তাতে কাড়াকাড়ির লাগার অবস্থা। এটাও মুড়ি খাওয়ার এক ধরনের মজা। মমিনের জন্য এক গ্লাস লেবুর শরবত দিয়ে গেল বাড়ির একজন বয়স্ক লোক। যিনি এই বাড়ির কর্তা। নাম জানা হয়নি। গভীর রাতে এই বাড়িতে ওরা এসে উঠেছে। বাড়ির লোকজনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেছে, ‘আজকের রাতটা আপনারা কষ্ট করে অন্যত্র কাটান। আমরা আজ এইঘরে ঘুমাব।’
সবার কাঁধে অস্ত্র দেখে বাড়ির লোকজন আর কেউ কিছু বলেনি। বলার সাহস পায়নি। কারো কারো কপালের ভাঁজ দেখেছিল ওরা। সেসব ওরা পাত্তা দেয়নি। পাত্তা দেওয়ার সময় কি তখন ওদের আছে? ৫০ জনের দলটি কয়েকটি বাড়িতে ভাগ হয়ে আশ্রয় নিয়েছে। রাতে আর খাওয়া হয়নি। বাড়ির লোকজন সাধাসাধি করছিল। মমিন বারণ করেছে। বলেছে, তারা খেয়ে এসেছে।
সকালে মুড়ি খেতে দিয়ে চুলোয় ভাত চড়িয়েছে। মুরগি ধরার আওয়াজ পাওয়া গেল। এই কথাটা ফিস ফিস করে বলে গেল মজনু। ভোজন রসিক মজনু বেশ গদগদ ভাবে বলল, ’মুরগি ধরতাছে ওস্তাদ। খাওয়া মনে হয় ফাটাফাটি হবে।’
মমিনকে ওস্তাদ ডাকে মজনু। মমিন যেহেতু দলের কমান্ডার। সবাই ডাকে কমান্ডার। মজনু ডাকে ওস্তাদ। ট্রেনিংয়ের সময় প্রশিক্ষককে সবাই ওস্তাদ বলে সম্বোধন করত। সেই অভ্যাস মজনু ছাড়তে পারেনি।
মজনুর বাড়ি রংপুর। থানার নাম বলতে পারে না। শুধু বলে বাড়ি অংপুর। গায়ের নাম সোনামুখি। গায়ের নামটি মমিনের বেশ পছন্দ। ১৭/১৮ বছরের ছেলেটি লেখাপড়া জানে না। রাজনীতির সঙ্গেও তেমন যোগসূত্র নেই। গায়ের কয়েকজনের সঙ্গে পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। ট্রেনিংয়ে যোগ দিতে গ্রামের অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ হয়ে গেছে। মজনুর সঙ্গে মমিনের তুরার পাহাড়ে প্রশিক্ষণের সময় দেখা ও পরিচয়। ওর অন্য সঙ্গীদের মজনু হারিয়ে ফেলেছে। এই জন্যে মাঝেমধ্যে বন্ধুদের জন্য উদাস হয়ে ভাবে। বেটে খাটো ছেলেটি অতিমাত্রায় সরল। ওকে কেউ কেউ ঠাট্টা করে ‘অংপুরের ডাব’ বললেও মজনু মন খারাপ করে না। হে-হে করে হেসে উড়িয়ে দেয়। মমিনের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকা সরল এই যোদ্ধা কখনো মন খারাপ করে না। সবাই বলে মজনু মিয়া কমান্ডারের বডিগার্ড। তাই শুনে মজনু মিয়া ভীষণ খুশি ও গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।
গামলার মুড়ি প্রায় শেষের দিকে। কাড়াকাড়িটা এই জন্যে বেশি বাড়ছে। হঠাৎ তাদের থমকে দিয়ে হৈচৈ চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসছিল। একজন গ্রামের কৃষক দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘মিলিটারি আসতেছে।’
মুহূর্তে পরিবেশ বদলে গেল। কিসের মুড়ি খাওয়া। ছুটে গিয়ে সবাই যার যার অস্ত্র হাতে নিয়ে কোমরে বেঁধে নিল গুলির ঝোলা। মমিন নিজের স্টেনগানটা কাঁধে ঝুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কোম্পানি রেডি? ফলো মি।’
সবার আগে মমিনকে ফলো করল মজনু। বাকি যারা অন্য বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদেরও খবর দেওয়া হলো দ্রুত।
গ্রামের পূর্বপাশ দিয়ে উচুঁ রাস্তা চলে গেছে শহরের দিকে। সেই রাস্তার আড়ালে গিয়ে সবাই পজিশন নিল। পাকআর্মি ওই পথ দিয়ে গ্রামে ঢুকবে। তার আগে তাদের গতিরোধ করতে হবে। খুবই শক্ত অ্যামবুশ করল তারা। সংখ্যায় তারা বেশি না হলেও পজিশনের কারণে তারা সুবিধেজনক অবস্থায় আছে।
চরা জুড়ে মানুষের ঢল। অনেকক্ষণ পজিশন নিয়ে আছে মুক্তিবাহিনীর দল। কয়েকজন ব্যক্তি ছুটতে ছুটতে আসছে। মমিন তাদের ডেকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘শুনলাম মিলিটারি আসছে। কোথায় তারা?’
তারা ছুটতে ছুটতে বলতে লাগল, ’মিলিটারির ট্রাক গেছেগা। কয়েকজন রাজাকার এইদিকে আসতাছে।’ বলতে বলতে লোকগুলো ছুটে চলে গেল। মমিন সবার কাছে খবর পাঠালো কেউ যেন ফায়ার না করে। রাজাকারদের আমরা ঘিরে ফেলব। ওদের আমরা অস্ত্রসহ ধরব।’ সবার কানে কানে খবর দিয়ে এল মজনু। সবাই রেডি হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল কয়েকজন রাজাকার কাঁধে রাইফেল উঁচিয়ে খোশ মেজাজে এইদিকে আসছে। কাছাকাছি আসতে আকস্মিকভাবে অস্ত্র উঁচিয়ে সবাই ছুটে এসে ‘হ্যান্ডসআপ’ বলে রাজাকারদের ঘিরে ফেলে। আকস্মিক মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে রাজাকাররা দিশেহারা হয়ে হাত উঁচিয়ে কাঁপতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে রাজাকারদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলে। সঙ্গে চোখও। তারপর তাদের নিয়ে আসে আগের আস্তানায়।
বন্দি রাজাকারদের দেখতে গ্রামের মানুষ হামলে পড়ে। তারা যেন অদ্ভুত জন্তু দেখছে। কেউ কেউ লাঠি দিয়ে আঘাতও করছে। মমিন আদেশ দিলেন সবাইকে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু লোকজন তাতে সরছে না। অবস্থা বেগতিক দেখে মমিন অস্ত্র উঁচিয়ে গ্রামবাসীকে ভয় দেখায়। তাতেও কাজ হয় না।
একজন দাড়িওলা রাজাকারের উপর সবারই ভীষণ ক্ষোভ। সে নাকি গ্রামের তিনজন হিন্দু মেয়েকে মিলিটারির হাতে তুলে দিয়েছে এবং দলবল নিয়ে সেই বাড়িগুলো লুট করেছে। লোকজন সেই দাড়িওলা রাজাকারকে মারতে মরিয়া।
বাড়ির মালিক মমিনের কাছে এসে বলল, ‘আপনারা রাজাকারদের কী করতে চান?’
মমিন বলল, ‘দলের সবার সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
বাড়ির কর্তা এবার বললেন, ‘ওই দাড়িওলা রাজাকারকে আপনারা কঠিন শাস্তি দিবেন।’
‘কেন?’ মমিন বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে।
‘ওই বেটা অনেক অত্যাচার করছে আমাদের গাঁয়ে। তিনটি হিন্দু পরিবারকে নিঃস্ব করে দিছে। তাদের যুবতী মেয়েদের ধইরা মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়া গেছে।’
এই কথায় মমিনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। অনেকক্ষণ সে কোনো কথা বলতে পারল না। বাড়ির কর্তা আবার জিজ্ঞেস করলে মমিন বলল, ‘আপনি বলুন কী শাস্তি দেওয়া যায়?’
বাড়ির কর্তা বললেন, ‘আমারে যদি কইতে কন তাইলে আমি কমু, ওরে জানে মাইরেন না। ওর চোখ দুইটা তুইলা দেন। সারাজীবন ভুইগা ভুইগা মরুক।’
খাওয়ার আয়োজন হয়ে গেছে। মিলিটারির আগমনের কথা শুনে পালিয়ে যাওয়া লোকজন আবার ফিরে এসেছে। খুব দ্রুততার সঙ্গে খাওয়া শেষ করল তারা। কারণ তাদের এখানে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ না। বন্দি রাজাকারদের দেখতে মানুষের ঢল নামছে। ভয় দেখিয়েও তাদের সরানো যাচ্ছে না।
রাতে এক গ্রামে আশ্রয় নেওয়ার আগে রাজাকারদের ফয়সালা করা দরকার ভেবে সেকশন কমান্ডারদের নিয়ে শলাপরামর্শে বসল মমিন। বাড়ির কর্তার সেই ভয়ংকর কথাটা সে জুনিয়র কমান্ডারদের সামনে তুলে ধরল। সবাই ভয়ংকর উত্তেজিত হয়ে পড়ল দাড়িওলা রাজাকারের কর্মকাণ্ডে। তারা এক বাক্যে বাড়ির কর্তার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার কথা ঘোষণা করল।
একজন বাধা দিয়ে বলল, ‘ও যেহেতু আমাদের মা-বোনদের মিলিটারির হাতে তুলে দিয়েছে তাই শাস্তি আরও কঠিন হওয়া উচিৎ।’
‘কেমন সে শাস্তি? ঝটপট বল।’
‘ওকে খোঁজা করা হোক। সঙ্গে দুহাত কেটে নুলা করা হোক।’
তাই করা হলো। বাকিদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তারা নদীর পানিতে হাতমুখ ধুয়ে সাফসুতের হয়ে বাড়তি অস্ত্রগুলো নিয়ে দূরের এক গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিল।
চলবে...
এসএন