ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১৯
স্নানের শব্দ
অফিস আগেরটাই শুধু শবনমের বসার কক্ষটি পাল্টে গেছে। এই কক্ষে আগেও এসেছে সে, অধস্তন কর্মী হিসেবে মিটিং করতে। এখন এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশালায়তনের সুসজ্জিত কক্ষের অধিকর্তা সে-ই। একপাশে একটা স্মার্ট সুন্দর সেক্রেটারিয়েট টেবিল আর বসার জন্য আরামদায়ক রিভলভিং চেয়ার, সামনে দর্শনার্থীদের বসার উপযোগী হাল্কা নীল রঙের নরম সোফা সেট, দেয়াল জোড়া নান্দনিক বুকশেলফ, ফাইল ক্যাবিনেট, কক্ষের শেষ প্রান্তে কনফারেন্স টেবিল চেয়ার।
এখানে সেখানে চোখের শান্তি দিতে লাল রঙের মাটির টবে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ সজীব ইনডোর প্ল্যান্ট।
জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় শবনম, পর্দা সরিয়ে নিচে তাকায়। এই জানালাটি রাস্তার দিকে মুখ করা, পিলপিল করে চলা সারি সারি গাড়ি ছাড়া এখান থেকে আর অন্য কিছু চোখে পড়ে না। সেই যে দুই দালানের মাঝখানে বেড়ে ওঠা কষ্টসহিষ্ণু নিমগাছটি, সে এখন হারিয়ে গেছে দৃশ্যপট থেকে। অবশ্য অভিনন্দন বার্তা আর কাজের চাপে তার প্রিয় রুগ্ন নিমগাছের জন্য শোক করার অবসর পায় না শবনম।
সারাদিন মিটিংয়ে পর মিটিং চলতেই থাকে। এই ইউনিট শেষ হয় তো আরেক ইউনিটের মিটিং শুরু হয়। ঘণ্টাব্যাপী লম্বা লম্বা ক্লান্তিকর মিটিং চলে। শবনমের প্রায়ই মনে হয়, এ সব মিটিং আধাঘণ্টা এমনকি ১৫ মিনিটেও শেষ করে ফেলা সম্ভব যদি কিনা সবাই টু দ্য পয়েন্টে কথা বলে। সংক্ষেপে মতামত দেয়। কিন্তু শবনম দেখেছে, বেশির ভাগ মানুষই অপ্রাসঙ্গিক আর অপ্রয়োজনীয় কথা বলে টেনে টেনে মিটিং লম্বা করে ফেলে। বয়স্করা শুরু করেন নাইনটিন সিক্সটি সেভেন থেকে, বর্তমান কালে আসতে তাদের ঘণ্টা পার হওয়ার উপক্রম হয়। শবনম অবশ্য কঠোরভাবে বলে দিয়েছে, মিটিংয়ের এজেন্ডার বাইরে বাড়তি কথা বলা যাবে না। তবুও মাঝে মাঝে তাদের ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে।
সারাদিনে শবনমের কিছু সময় যায় জনসংযোগ করতে, বড় বড় ক্লায়েন্টদের সঙ্গে সম্পর্ক আপডেট রাখতে হয় সবসময়। অফিসের ভেতরকার সমস্যাগুলোও মিটাতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় বেচাকেনার। চোখে দেখা যায় না কিন্তু তার কাজের চাপ মোটেও কম না। দিনটা যে কীভাবে ফুড়ুৎ করে কেটে যায়, টের পায় না শবনম। অবশ্য ব্যস্ততা তার ভালই লাগে। হয়ত এরই মধ্যে নেতৃত্বের আনন্দ ও আধিপত্য উপভোগ করতে শুরু করেছে সে। তা ছাড়া কাজের মধ্যে ডুবে থেকে নিজেকে চারপাশের ক্ষুদ্রতা, হীনতা, দীনতা থেকে মুক্ত রাখাও একটা অর্জন। তবে একেক সময় এটাও মনে হয় যে, বেশি ব্যস্ত থাকতে গিয়ে নিজেকে আবার একা করে ফেলছে কিনা?
সেই অর্থে শবনম তো আসলে একাই। প্রতিটি মানুষই একা। দাদী বলতো, একা এসেছ ভবে, একা পুনঃ যেতে হবে। তা ছাড়া, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ চূড়ায় শুধু একজনই দাঁড়াতে পারে, দুজন নয়। এই একাকীত্ব সে প্রশান্ত চিত্তে মেনে নিয়েছে। একাকীত্বকে সে বরং উপভোগই করে। একা থাকার মুহূর্তগুলোতে কাজে লাগায় আত্মবিশ্লেষণ করে, নিজের সারাদিনের কাজকর্ম, কাজের ভাল দিক মন্দ দিকগুলিকে উল্টেপাল্টে দেখে। বড় ধরনের সিদ্ধান্তগুলি ভুল না শুদ্ধ হলো সেসব নিয়ে ভাবে।
তারেক আর শ্রাবণও তাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে একাকীত্বকে গ্রহণ করে নিয়েছে। তারেক ধর্ম কর্মে মন দিয়েছে। মসজিদে অনেকটা সময় কাটে তার। পাশাপাশি প্রবল উৎসাহে টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ বা ফুটবল খেলা দেখে সে। খেলা না থাকলে বিদেশি মুভি বিশেষ করে বিচিত্র বিষয়ের উপর নির্মিত ডকুমেন্টারিগুলো দেখে তার সময় কেটে যায়।
শ্রাবণ আছে তার পড়া লেখা আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে। ইদানিং মাথায় ঢুকেছে বিদেশের কোনো ভাল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যেতে হবে। তাই মেতে আছে স্যাট, টোফেল, আইএলটিএস নিয়ে। পরীক্ষা দেয়, কোচিং করে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মারে। সব মিলিয়ে মন্দ কাটে না তার সময়। শবনমের মনে হয়, তারা তিনজন যেন পাশাপাশি তিনটা আলাদা দ্বীপ, যে যার মতো নিজস্ব জগত নির্মাণ করে সেই জগতের ভেতর ডুবে আছে। অবশ্য মাঝে মাঝে তারা একে অন্যের সান্নিধ্য যে কামনা করে না তা নয়, তবে সেটাও খুবই সীমিত পর্যায়ে। তখন হয়ত তিনজন মিলে দামী কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। নয়তো এক দুদিনের জন্য কোনো বিলাসবহুল রিসোর্টে গিয়ে ওঠে। শ্রাবণের সঙ্গে তারেকের হরদম কথা চলতেই থাকে, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাপ বেটি তুমুল তর্ক করে, কোনো বিষয়ের পক্ষে বিপক্ষে জোরালো মতামত দেয়, শবনম দেখে, শোনে, মুদু হাসে, কখনো মাথা নাড়ে কিন্তু ওই আলোচনায় অংশ নেয় না। তার চুপ করে থাকতেই ভাল লাগে। যেন মনের মধ্যে ডুব দিয়ে লুকানো মণি মুক্তা খুঁজতেই তার আনন্দ।
শ্রাবণ কখনো কখনো বলে— ‘মা তুমি যে একজন মহা প্রতাপশালী সিইও, অফিসের বাইরে সেটা একদম বোঝাই যায় না। কেমন সাধারণ হয়ে থাকো।’
‘নিজের লোকের সামনে তো আমি সাধারণই থাকতে চাই। কেনো তোর খারাপ লাগে?’
‘নাহ্, ভালই লাগে তো..’
শ্রাবণ মাকে জড়িয়ে ধরে বলে। তারপর চোখ বড় করে প্রশ্ন করে,
‘আচ্ছা,মা, অফিসে কী তুমি অনেক কড়া বস? তোমার অফিসের লোকেরা তোমাকে ভয় পায়? মানুষজনকে ধমকের উপর রাখো?’
শবনম হাসে, ‘যারা ঠিকঠাকমতো কাজ করে না, তাদের একটু আধটু ধমক তো দিতেই হয়! সবাই যেন ঠিকমত কাজ করে সেটা খেয়াল করাও তো আমার দায়িত্ব।’
‘আমার বন্ধুরা বলে তোর মা তো অনেক জোস, কত বড় পোস্টে চাকরি করে .. শুনে কিন্তু আমার ভালই লাগে।’
শ্রাবণ লাজুক গলায় বলে। ওর চুল এখন দ্রুত লম্বা হচ্ছে, ফলে উপরের দিকে কালো চুল গজিয়েছে আর রঙীন চুলগুলো নেমে এসেছে নিচের দিকে। ঘাড় কাৎ করে শবনমকে সেই চুল দেখায় শ্রাবণ। ‘দেখছো মা, আস্তে আস্তে চুলের কালার আবার আগের মত হয়ে যাচ্ছে। আর রং করব না। তুমি খুশি?’
‘তুই খুশি থাকলেই আমি খুশি।’
মুখ দিয়ে এই বাক্যটা বের হবার পর শবনম ভাবলো, কবে থেকে এমন হলো যে তার খুশি, মেয়ের খুশি আর আনন্দের সঙ্গে জড়িয়ে গেল!
বিড়াল লীলাবতীকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে শবনমের মতো ভঙ্গী করে শ্রাবণ বললো, ‘লীলা খুশি থাকলে আমিও খুশি।’
দুদিন আগে বনানীর একটা দোকানে নিয়ে মেশিন দিয়ে লীলাবতীর লম্বা ঘন লোম কাটিয়ে আনা হয়েছে। লোম হারিয়ে তার ছোট গোল মুখে বিষণ্নতার ছাপ। বিড়ালও যে বিষণ্ন হয়, আগে জানা ছিল না শবনমের। শ্রাবণ অবশ্য তাকে জাপ্টে ধরে আদর করে তার প্রিয় ক্যাট ফুড খাইয়ে চিয়ার আপ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারেক নিয়ে এসেছে বিড়ালের প্রিয় খেলনা, লাল বল। কিন্তু লীলাবতী ওদের খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। সে শ্রাবণের বাহুমুক্ত হয়ে ধীরপায়ে হেঁটে একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে সোফায় উঠে আয়েশ করে রাজকীয় ভঙ্গীতে এক কোণায় গ্যাট হয়ে শুয়ে রইল।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
স্নানের শব্দ: পর্ব-১৮