বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
Dhaka Prokash
Header Ad

সাদাত হোসাইন

বোধ

ভরা বরষার মৌসুম। বরষা মানে বরষা। কান ঝিম মেরে দেওয়া বরষা। একটানা পনেরো দিন বৃষ্টি। রাত দিন একাকার। এই বৃষ্টি যে অদূর ভবিষ্যতে থামবে তার কোনো লক্ষণ নেই। টিনের চালের বৃষ্টি-ঝিম্ ঝিম্। একটানা শব্দ। তিন দিনের মাথায় সবার কান তব্দা । সেই তব্দা দেওয়া কানে একটা মাত্র শব্দ, ঝিমম্, ঝিম্ । আমি তখন হাফপ্যান্ট পরা টিনটিনে বালক। লম্বা সরু সরু পা। সেই পা দেখে আমার নানি প্রায়ই শ্লোক বলেন—

‘বাঁশের কঞ্চি, কইঞ্চা
হইয়া গেল ধইঞ্চা
ধইঞ্চা দিয়া বরই পাড়ি
পড়ে না বরই, লাড়িচারি...’

এতই শুকনা যে তা দিয়ে গাছের বড়ইও পাড়া যায় না, শুধু নেড়েচেড়ে দেখা যায়। শার্টের কলারের পাশ দিয়ে আমার কণ্ঠার হাড় দেখা যায়। সেই উঁচু কণ্ঠার হাড়ের ফাঁকে নাকি আধসের চাল ধরে । আমার কাজ হলো টেনেটুনে সেই উঁচু কণ্ঠার হাড় শার্টের কলার দিয়ে ঢেকে রাখা। আর সুযোগ পেলেই বড়চাচাদের ঘরে ঢুকে পড়া। ঘরে ঢুকে জানালার ফাঁক দিয়ে আমি আমার টিনটিনে লম্বা পা জোড়া বের করে দিই। ছটাৎ ছটাৎ ইয়া বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে সেই টিনটিনে পায়ে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি । আর অবাক হয়ে শুনি টিনের চালে ঝিমম্ ঝিম্ একটানা শব্দ।
বৃষ্টির শব্দ। আহা!

আমাদের বাড়িতে দুটো ঘর। আমাদের আর বড়চাচাদের। বড়চাচাদের ঘরখানা টিনের। এই ঘর শফিক ভাই করে দিয়েছেন। শফিক ভাই বড় চাচার ছেলে। ঢাকায় চাকরি করেন। বছরে একবার দু'বার আসেন। শেষ ক বছর আর আসেন নি। শফিক ভাইয়ের বউ গ্রামের কাদা-জল সহ্য করতে পারেন না। তাদের একটা ছেলেও আছে। ছেলের নাম বোধন। বছর তিনেক বয়স। এবার নাকি শফিক ভাইয়ের বউ গ্রামের বর্ষা দেখতে চেয়েছেন। খবর শোনার পর থেকে বড় চাচির আর বিরাম নেই । সকাল-সন্ধ্যা তুমুল আয়োজন। নারকেলের চিড়ে করেন, নানা রকম পিঠে। বড় পাতিলভর্তি পানি দেওয়া জিওল মাছ, শৌল, শিং, কৈ। ফুলতোলা প্লেট, গ্লাস, বাটি, বিছানার চাদর।

চাচির সঙ্গে সমান তালে ছোটে রুবি বু-ও। রুবি বু শফিক ভাইয়ের ছোট বোন। আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। তবু তার সঙ্গে আমার রোজ ঝগড়া হয়। রুবি বুর বেণী করা চুলের ভেতর আমি কাকরোলের খোসা খুঁজে দেই। রুবি বু রেগেমেগে আমাকে তাড়া করে। কিন্তু টিনটিনে আমি হাওয়ার আগে ছুটি। রুবি বু’র সাধ্য কি আমায় ছোঁয়?

রুবি বু অবশ্য আমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেয় না। সেবার বড় চাচাদের ঘরে দুপুরে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম থেকে উঠে ঘরে আসতেই মা রে রে করে তেড়ে এলেন। আমি তো অবাক। হয়েছে কী? মা আমাকে টেনে নিয়ে তার হাতের তালুতে আটকানো ছোট আয়নাখানায় মুখ দেখতে দিলেন। আমি হতভম্ব। ঘুমের মধ্যে রুবি বু আমার অর্ধেক মাথা কামিয়ে ন্যাড়া করে দিয়েছে!

সেই রুবি বু-ও শফিক ভাই আসবে শুনে হরিণীর মতো ছুটছে। দুটো ধবধবে সাদা বালিশের কভারও বানিয়ে ফেলেছে। সেই কভারে লাল-সবুজ সুতোয় লেখা ‘সুইট ড্রিমস’। আর শফিক ভাইয়ের ছোট্ট ছেলেটার জন্য কী সুন্দর টুকটুকে লাল ছোট্ট একটা বালিশের কভার। তার ওপর কাঁচা হাতে লেখা ‘বোধ বাবা'।


রুবি বু বোধনের ‘ন' দিতে ভুলে গেছে। বোধন হয়ে গেছে বোধ! বড় চাচাদের ঘরখানা চৌচালা । সামনে পেছনে খোলা বারান্দা। সেই বারান্দায় এখন বড় চাচার হাঁস, মুরগি, ছাগল আর কালো একটা গাই থাকে। কুচকুচে কালো গাই । গাইয়ের নাম কালু। কালুর পেট ফুলে ঢোল । আজকালের মধ্যেই বিয়োবে। বড় চাচা মানত করেছেন, একটা বকনা বাছুর হলে ময়দানের মসজিদে দু ‘খানা ডাব আর চার সের দুধ দিয়ে আসবেন। চাচি দু'রাকাত নফল নামাজও মানত করেছেন।

এবারের বরষায় মুরগির খোপ আর গোয়ালঘর ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। বড় চাচা তাই সবগুলোকে বারান্দায় তুলে এনেছেন। গাইয়ের চারপাশে যত্ন করে শুকনো খড় বিছিয়ে দিয়েছেন। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে মাটি যাতে গাইটাকে ছুঁতে না পারে।

আমাদের ঘরখানা ছনের। একটানা দুদিন বৃষ্টি হলেই আর রক্ষা নেই। শুকনো ছনের আড় ভেঙে যায়। বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে এখানে সেখানে। প্রথম প্রথম সেই জায়গাগুলোতে থালা-বাটি পাতেন মা। তার দুদিন পরে গামলা। একসময় গামলাতেও আর কাজ হয় না। বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে ছনের চাল। বাঁশের বেড়া। কেবল আমার বাবা ভেঙে পড়েন না। তিনি সেই ভাঙা ছনের চাল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আবার জোড়া লাগান। সঙ্গে জোড়া লাগান প্লাস্টিকের বস্তা। রিলিফের টিন। আমার ঘরে মন বসে না। স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা ঘর। ঘরের মেঝেতে উঁকি দেয় বিশাল কেঁচো। ভাতের প্লেটের ভেতর লাফিয়ে পড়ে ব্যাঙ, আরশোলা । আমি তাই ছটফট করি বড় চাচাদের খটখটে শুকনো ঘরে যেতে। মাথার ওপর চকচকে টিনের চাল। সেই চালে ঝিমমম ঝিমমম বৃষ্টির শব্দ। সেই শব্দে আমার কান তব্দা দেয় না। আমি মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনি। সঙ্গে শুনি বড় চাচার পুঁথি পাঠ আর অদ্ভুত  সব গল্প । সেই গল্প পাতার, পাখির, প্রাণের, জীবনের। বড় চাচা প্রাণের মানুষ। অবলা প্রাণের। গাছ, পাখি, পশু তার প্রাণ । রাস্তায় যে নেড়ি কুত্তাটা সকাল-সন্ধ্যা তার রে ঘেউ ঘেউ করে, বড়চাচার পায়ের শব্দে সেও কুইকুই করে মাথা নিচু করে দৌড়ে আসে। তারপর বাধ্য ছেলের মতো গুটিগুটি পায়ে তার পিছু পিছু হেঁটে যায়। বড় চাচা প্রতি সন্ধ্যায় পুকুরপাড়ের জামতলায় বসে থাকেন। দশাসই শরীরের কালো গাইটা দড়ি ছিড়ে তেড়েফুঁড়ে এসে তার পাশে মাটিতে আধশোয়া হয়ে বসে। তারপর মাথাটা এলিয়ে দেয় কোলে। বড় চাচা আলতো হাতে তার মাথায় হাত বোলান। হাত বোলান কানে, ঘাড়ে, পেটে, গলায়। কালু চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে শুয়ে থাকে। বড় চাচার শক্ত হাত বিলি কেটে দেয় তার শরীরের কালো চকচকে রেশম লোমে। হাতখানা খানিক থামতেই কালুর মাথা নড়ে ওঠে। আলতো ঢুস মারে সে বড় চাচার কোলে। কালো গাইয়ের শরীরজুড়ে বড় চাচার হাত আবার নড়ে ওঠে। সেই হাতভর্তি মমতা, সেই হাতভর্তি ভালোবাসা।

 

দু্ই

বৃষ্টিটা কমে এসেছে। কিন্তু দখিনা বাতাসে হু হু করে বাড়ছে নদীর পানি। সেই পানি নদী উপচে ভাসিয়ে দিয়েছে খাল, বিল, মাঠ, ফসলের জমি । পানির ওপর ভেসে আছে সবুজ ধানের কচি ডগা। উঁচু রাস্তাও ডুবি ডুবি । ডুবে গেছে উঠোনের অর্ধেক। সেই পানিতে টুপটাপ লাফিয়ে ওঠে খলসে পুঁটির দল। আমাদের ছনের ঘরখানার করুণ দশা। কিন্তু বাবা-মা ঘর ছেড়ে কোথাও যাবেন না। সমস্যা যত আমাকে নিয়ে। এই স্যাঁতসেঁতে ভেজা ঘরে আমার মন বসে না। আমি চুপি চুপি বড় চাচাদের ঘরে চলে যাই। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে যেতে না পারলেও বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকি আর গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদি। সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ বড় চাচা তাঁর লম্বা লম্বা পা ফেলে এসে দাঁড়ালেন আমাদের ঘরের সামনে। তারপর বাবাকে ডাকলেন, ‘মকবুল, মকবুল।’


বাবা তখন চৌকির ওপর বসে বিড়ি ফুঁকছিলেন। তড়িঘড়ি বিড়িখানায় শেষ টান দিয়ে বেড়ার ফাঁকে ফেলে দিলেন বাইরে। তারপর এসে দাঁড়ালেন বড় চাচার সামনে। বাবার পাশ দিয়ে উঁকি দেওয়া ভাঙা বেড়ার দিকে আঙুল তুলে বড় চাচা বললেন, ‘তোর গোয়ার্তুমি কি এই জনমে কমবো না? এই ঘরে তুই ওই রোগা বউ আর এটুক পোলাডারে লইয়া থাকস কোন সাহসে? অগো কি মাইরা ফেলতে চাস?'

বাবা কাঁধের গামছা দিয়ে মুখ মোছেন। তারপর ভাঙা বেড়ার দিকে মাথা ঘুড়িয়ে তাকান। আবার মুখ ফেরান। কিন্তু কিছু বলেন না। চুপ করে থাকেন।
‘কী? কথা কস না কেন? কিছু একটা ক। এমনে মুখে কুলুপ আইটা কয়দিন থাকবি?'

বাবা এবারো চুপ করে থাকেন। কথা বলেন না। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে অর্ধবৃত্ত আঁকতে থাকেন। বড় চাচার যেন এবার বাঁধ ভাঙে। তিনি চেঁচান, ‘জীবনে কোনোদিন একটা কথাও হুনছোস? হুনোছ নাই। যেইডা কইছি হেইডার উল্টাটা করছোস। এইজন্যই তো আইজ এই দুর্দশা।'

একটু থামেন বড় চাচা। তারপর বাবার হাত ধরে টেনে নিয়ে যান বড় চাচার কালো গাইটার সামনে। ‘দ্যাখ, গাইডারে দ্যাখ।' বড় চাচা কালুর পেটে হাত বুলান। পেটের আকার বিশাল। ‘আজ-কাইলের মইধ্যেই বিয়াবে কালু। এই একটা গাই, অবলা প্রাণী, এই প্রাণী আমারে কোনোদিন ঠকায় নাই।’ বড় চাচা থামেন। খুক করে একদলা থুথু ফেলেন ভেজা মাটিতে। তারপর ঘুরে দাঁড়ান, ‘অবলা এই প্রাণীগুলা কাউরে ঠকায় না। অরা সব বোঝে, সব।'

একটু থেমে তিনি আমার দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বলেন, ‘বাবা যখন মারা যায়, ওই অর চেয়ে একটু বড় আছিলাম আমি। এক ফোডা জমি-জিরাতও আছিল না। এক বেলা খাওনের আছিল না। তুই তহন মা'র পেডে । বড় মামায় আমারে একটা লাল বাছুর দিয়া কইছিল, এইডা হইলো লক্ষী। এই লক্ষী দেইখা শুইনা রাখিস। আমি আমার সারাজীবন তার কথা আরে আরে পালন করছি। হেই বাছুর থেইকা আমার কতগুলা গাই বাছুর যে হইছে! তোরে এত কইরা কইলাম, আথালের গাইডা বেচিস না। ঘরের লক্ষী। তুই গাভীন গাইডা টেকার লোভে হারু কসাইয়ের কাছে বেচলি। কেমনে বেচলি? হারু কসাই তো মানুষ না। ও আসলেই একটা কসাই। কিন্না নিয়া গাভীন গাইডার ঠিক মতো যত্ন-আত্মী করে নাই, রাখছে ভিজা চুপচুইপা ঘরে। একটার পর একটা রোগ হইছে গাইডার। শেষমেশ গাইডা যদি মইরা যায় হেই ডরে কাউরে কিছু না জানাইয়াই গাইডারে জবাই দিয়া গঞ্জে গোসত বেচছে! গাভীন গাই। গাইডার পেডের মইধ্যে আরেকটা জান আছিল। অবলা গাইডা কোনো কথা কইতে পারে নাই। আল্লাহ! ওহ আল্লাহ!’ বড় চাচার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আসে। হাতের আঙুল মুঠো পাকিয়ে যায়। পাথরের মতো শক্ত চোখেও জল ছলছল করে, ‘আল্লাহ কেমনে সইবো? আল্লাহ তুমি মাফ করো। মাফ করো ইয়া মাবুদ।'


বাবা এখনো চুপ করে আছেন। পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে ভেজা মাটিতে বুড়ো আঙুল দিয়ে অর্ধবৃত্ত আঁকতেই থাকেন। আঁকতেই থাকেন। বড় চাচা এক পা সামনে এগিয়ে বাবার একদম মুখোমুখি দাঁড়ান । তারপর আবার বলেন, ‘তুই এই ঘরে থাকবি থাক। তোর বউডারে এই ক্যাদা-বিষ্টিতে মারবি মার । কিন্তু আনু এই বংশের রক্ত। অরে আমি এই ভেজা ঘরে এই বিষ্টি বাদলায় থাকতে দিমু না।' বড় চাচাকে আমি পছন্দ করি, খুব খুব পছন্দ করি। কিন্তু বাবাকে যখন বড় চাচা বকেন তখন আমার খারাপ লাগে। বড় চাচাকে মনে হচ্ছিল একটা খারাপ মানুষ। আর বাবা কী অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু বড় চাচা যখন বললেন যে তিনি চান না আমি এই ঘরে থাকি তখন মুহূর্তেই আমার মনে হলো, জগতে বড় চাচার মতো ভালো মানুষ আর একটাও নেই। যত ইচ্ছা বকুক বাবাকে। বাবা তো আমাকে ওই ঘরে যেতে দিতেই চায়। মা-ও না। কিন্তু আমাদের দুজনকেই অবাক করে দিয়ে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মিনমিনে স্বরে বললেন, ‘আনু, তোর বালিশ আর জামা-কাপুড় লইয়া ওই ঘরে যা। বাইস্যাকালের কয়ডাদিন ওই ঘরেই থাক।’

আমি আর বড় চাচা দুজনই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি। বড় চাচা বাবাকে আর কিছু বলেন না। তিনি আমার দিকে তাকান। তারপর দরজার সামনে দড়িতে শুকাতে দেওয়া আমার কোঁচকানো হাফপ্যান্ট আর শার্টখানা আমার দিকে ছুড়ে দিতে দিতে বলেন, ‘নে, জামা-কাপুড় লইয়া আয়। কাইল বেয়ান বেয়ান উঠতে হইবো। তোর শফিক ভাই আইবো ঢাকারতন। নাও লইয়া হেরে গঞ্জে আনতে যাওন লাগবো। তুই যাবি আমার লগে।’
বড় চাচা কথাগুলো আমাকে বললেও উদ্দেশ্য ছিল মূলত বাবা। কিন্তু বাবা কোনো উত্তর দেন না। তিনি গভীর মনোযোগে বুড়ো আঙুল দিয়ে ভেজা মাটিতে অর্ধবৃত্ত আঁকতে থাকেন। আঁকতেই থাকেন।

 

তিন

‘আনু, এই আনু। ওঠ ওঠ।’

বড় চাচার ডাকে আমার ঘুম ভাঙে। আমি তড়িঘড়ি বিছানা ছাড়ি। বাইরে জমাট অন্ধকার। বড় চাচা তার বড় গামছাখানা দিয়ে আমার মাথা, পিঠ, বুক ঢেকে দেন। বাইরে বেরিয়েই চমকে ওঠেন তিনি। একরাতেই বন্যার পানি বেড়ে প্রায় ঘরের দাওয়ায় এসে ঠেকেছে। বড় চাচার মুখে চিন্তার ছায়া। তিনি আপনমনে বিড়বিড় করতে থাকেন, ‘আল্লাহ, পানি না জানি এইবার আর কত বাড়ে! মাফ করো আল্লাহ।’
সাবধানে নৌকার গলুইয়ে আমাকে বসিয়ে দেন তিনি। চাচি এবং রুবি বু তখনো ঘুমে। বড় চাচা হাঁক দিয়ে চাচিকে ডাকেন, ‘শফিকের মা, ও শফিকের মা।'
‘হ, কন।’ ভেতর থেকে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে সাড়া দেন চাচি। ‘তুমি খাওন-দাওন রেডি করো, আমি শফিকরে লইয়া আসতেছি।’ বলেই ছোট্ট লাফে নৌকায় চড়ে বসেন তিনি।। অন্ধকারে নৌকার গলুইয়ে বসে আমি বড় চাচার দুলতে থাকা শরীরটা দেখি। চারদিকে থই থই পানি। এবার নিশ্চয়ই বড় বন্যা হবে। বড় চাচা নৌকা ঘুরিয়ে বাড়ির পেছন দিকে নিয়ে আসেন। পানি প্রায় ঘর ছুঁই ছুঁই। তিনি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেন। তারপর অন্ধকারেই আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘যুইত কইরা বয় দেহি আনু। দেখি গঞ্জে যাইতে কতক্ষণ লাগে । ঢাকার লঞ্চ আহনের আগেই পৌঁছাইতে হইবো।’
বড় চাচার হাতের বৈঠাখানা নড়ে ওঠে। ঝুপ শব্দটা কানে আসে ঠিক তখনই। কিছু একটা পানিতে পড়েছে কোথাও। কিন্তু বৈঠার শব্দে খুব একটা আলাদা করা যায় না শব্দটা।
‘বড় চাচা, পানিতে কি কিছু পড়লো? শব্দ হুনছেন?' আমি বড় চাচাকে জিজ্ঞেস করি।
‘হ, হেরামই কিছু একটা হুনলাম মনে হয়।’
‘কী পড়ল?’ আমি আবারও জিজ্ঞেস করি। পুবাকাশ তখন খানিকটা আলোকিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাড়ির পাশেই ঘন বাঁশঝাড়ে অন্ধকার হয়ে আছে জায়গাটা।
বড় চাচা সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই আন্ধারে তো কিছু দেখা যাইবোনারে। আর তোর ভাইয়ের লঞ্চও চইলা আইবো।'
‘মাছ-টাছ কিছু হইবো মনে হয়।’ বড় চাচার তাড়া দেখে আমি তাকে আশ্বস্ত করি ।
‘হ, তাই হইবো। পানি যেমনে বাড়তেছে, গ্রামের সকলের পুকুরই ডুইবা গেছে মনে হয়। পুকুরের মাছ এহন সব বানের পানিতে।’
বড় চাচা দ্রুত বৈঠা মারেন। আমি আধো-অন্ধকারে কালো পানিতে তাকিয়ে থাকি। এলোমেলো ঢেউ। ভোরের নরম হাওয়ায় শরীর কেমন অদ্ভুত শীতলতায় আচ্ছন্ন হয়। আমি গলুই থেকে পা বাড়িয়ে আঙুলের ডগায় পানি ছুঁই।
ইশ কী ঠান্ডা!

 

চার

শফিক ভাই টুপ করে নৌকায় উঠে পড়েন। তার কোলে বোধন। বড় চাচা কয়েকবার চেষ্টা করলেন নাতিকে কোলে নিতে। কিন্তু বোধন কোনোভাবেই গেল না। সম্ভবত বড় চাচার লম্বা এলোমেলো দাড়ি তার পছন্দ হয় নি। বিপত্তি বাধে ভাবিকে নিয়ে। তিনি শহুরে মেয়ে, কোনোমতেই নৌকায় উঠতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত বোধনকে আমার কাছে দিয়ে শফিক ভাই ভাবিকে প্রায় কোলে করে নৌকায় তোলেন। নৌকার পাটাতনে পাতা পাটিতে জড়সড় হয়ে বসেন ভাবি। আতংকিত চোখ জোড়া পানিতে। ঢেউ তেমন নেই বললেই চলে। কিন্তু নৌকা খানিক দুলে উঠতেই ভাবির চোখ মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। শফিক ভাই এবং বড় চাচা, দুজনই ভাবিকে অভয় দেন। কিন্তু ভাবির ভয় তাতে কিছু কাটে বলে মনে হয় না। তিনি এক হাতে শক্ত করে নৌকার পাটাতন খামচে ধরে আছেন, আরেক হাতে শফিক ভাইকে। আমি বোধনকে শফিক ভাইয়ের কাছে দিয়ে আবার নৌকার গলুইয়ে গিয়ে বসি। শফিক ভাই কেমন গম্ভীর হয়ে আছেন। আগের সেই হাসিখুশি ভাবটা আর নেই। আমাকে দেখে কেমন নিরস গলায় বললেন, ‘কীরে আনু, কিছু খাস না নাকি? এমন পাটখড়ি হয়ে গেছিস কেন?’ অন্যসময় হলে হয়তো শফিক ভাইয়ের এমন কথায় আমি হেসে গডাগড়ি খেতাম। কিন্তু শফিক ভাইয়ের এবারের কথা বলার ধরনে কিছু একটা ছিল । আমি কেমন জড়সড় হয়ে গেলাম। কোনো উত্তর দিলাম ন।
শফিক ভাই অবশ্য উত্তর আশা করেছে বলে মনেও হলো না। তিনি বড় চাচার দিকে ফিরে জানতে চাইলেন, ‘বাবা, তোমার শরীরটা ভালো?’
‘হ, ভালোই। খালি ঠান্ডাডা একটু ঝামেলা করে।'
‘বাবা, বাড়িতে আসতে অনেক ঝামেলা। এই এত কাদা পানি ডিঙাইয়া বাড়ি আসন যায় কও?’ শফিক ভাই বড় চাচার শরীর নিয়ে আর কিছু বললেন না। বছর বছর বাড়ি আসা তার জন্য কত ঝামেলার তা বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। বললেন, ‘তার ওপর দেখছ তো বাবা, তোমাগো বউয়ের অবস্থা? নৌকায় চড়তে পারে না, এই পানি খাইতে পারে না। বোধনেরও এই পানি সহ্য হয় না। গোসলও করতে পারে না। গা চুলকায়। কী যে করব আমি!'
‘কী আর করবি? বুড়া বাপ-মা যদ্দিন আছে, একটু কষ্ট তো করতেই হইবো।’ বড় চাচার গলার স্বর নরম। সেই নরম স্বরের কোথায় যেন থইথই কান্না। পাথর জমাট কষ্ট। ‘শোন এইবার তোগো ভাল্লাগবো।' বড় চাচা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন। কালো গাইডা দুয়েকদিনের মধ্যেই বিয়াইবো। খাঁটি দুধ খাইতে পারবি । টাউনে তো খাঁটি দুধ বলতে কিছু নাই। ব পানি দেওয়া। ওইহানে কী না কী খাস কে জানে! তার ওপর নতুন বাছুর দেখলে আমার দাদাভাইয়েরও ভাল্লাগবো।' বলে ফে ফে করে বিগলিত ভঙ্গিতে হাসতে থাকেন বড় চাচা।
কিন্তু শফিক ভাই নিরস গলায় বলেন, ‘এই গরু বাছুর নিয়া তোমাগো এত আদিখ্যেতা আমার ভাল্লাগে না বাবা । পারলে তো দেখি এইগুলারে রাইতেও কোলে নিয়া ঘুমাও। আর এইগুলার মধ্যে ভুলেও বোধনরে নিব না বাবা।'
‘কেন রে শফিক, তোর মনে নাই? ছোডবেলায় তুই সাদা ধবধবা বাছুর দেখলে কী করতি?’
বড় চাচার কথা শেষ হয় না। তার আগেই শফিক ভাই চড়া গলায় কথা বলে ওঠেন, ‘ওইসব পুরান কাসুন্দি বাদ দাও তো বাবা। ছোড বেলায় তো তোমার মতোন নৌকা বাইয়া গরুর লাইগা ঘাস কাটতেও গেছি। এহন কি আর...।' বলে হঠাৎ থেমে যায় শফিক ভাই। কথাটা বলা যে ঠিক হয় নি তা বুঝতে পেরে মাঝপথে চুপ মেরে যান তিনি। বড় চাচা আবারও ফে ফে করে হাসেন। সেই হাসিতে তাকে বড্ড বোকা বোকা লাগে। ভীত, ন্যুব্জ, জরাগ্রস্ত এক মানুষ মনে হয়। বড় চাচার হাসি একসময় থেমে যায়। শফিক ভাই, ভাবি, আমি, আমরা কেউ কোনো কথা বলি না। সবাই যেন বুঝে ফেলি, এখন নৈঃশব্দ্যের সময় । অস্বস্থিকর নীরবতায় বৈঠার একটানা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ খুব কানে বাজতে থাকে।

 

পাঁচ

বাড়ির কাছে আসতে আসতে গনগনে সূর্য তেতে উঠে। টানা বর্ষা শেষে পরিষ্কার আকাশ। শফিক ভাই আর ভাবি নৌকা থেকে কীভাবে নামবে তাই নিয়ে ভাবছিলাম আমি। বড় চাচা দেখি পুকুরপাড়ের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছেন নৌকা। ওদিকটায় দুটো কাটা খেজুর গাছের অস্থায়ী ঘাট আছে। নৌকা থেকে লাফিয়ে সেই ঘাটের ওপর শুকনো জায়গায় নামা যায়। বড় চাচা খুব সাবধানে সেখানে নৌকা ভেড়ালেন। তারপর নিজে হাঁটু পানিতে নেমে নৌকাটাকে শক্ত করে জামগাছটার সঙ্গে বাঁধলেন।

‘মা আর রুবি কই বাবা ? আমি আসবো ওরা জানে না?’ শফিক ভাইয়ের গলায় স্পষ্ট বিরক্তি। আমারও খানিকটা অবাক লাগে। শফিক ভাই বউ নিয়ে ঢাকা থেকে আসবে, সঙ্গে আসবে বোধন। এতদিন ধরে চাচি আর রুবি বু'র এত আয়োজন! অথচ কই ওরা? ওদের তো পুকুরপাড় এসে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। বড় চাচাও খানিকটা অবাক হয়েছেন। তিনি কলাগাছের ঝড়ের ফাঁকে উঁকি দিয়ে বাড়ির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। কেমন থমথমে চারপাশ। আমার বুকের ভেতরটা আচমকা কেমন করে উঠল!
বড় চাচা গলা চড়িয়ে ডাকলেন, “রুবিনা, ও রুবিনা। ও শফিকের মা, কই তোমরা?'
কিন্তু তিনি ডাকলেও কোথাও কোনো সাড়া নেই। বড় চাচা আবারও চেঁচালেন, ‘ও শফিকের মা, ও রুবিনা, কই তোরা? শফিক তো বউ লইয়া আইয়া পড়ছে, আমার দাদাভাইও আসছে।'
এবারও কোনো সাড়া-শব্দ নেই। শফিক ভাই বোধনকে কোলে নিয়ে নৌকা থেকে নেমে দাঁড়ালেন। তার ফর্সা মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। বড় চাচা কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তার কপাল কুঁচকে আছে। তিনি হাঁটু পানি থেকে উঠলেন। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত—কাদায় মাখামাখি। সেই কাদা মাখা পা নিয়েই তিনি বাড়ির দিকে এগুলেন, ‘রুবিনা, কই তোরা? তোর ভাই তো আইয়া পড়ছে।’
আমি টুপ করে নৌকার গলুই থেকে নেমে বড় চাচার পিছু নিলাম। শফিক ভাই ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার কোলে ঘুমাচ্ছে বোধন। নৌকার ওপর শক্ত হয়ে বসে আছেন ভাবি। তার আগুন চোখের সামনে শফিক ভাইকে কেমন দিশেহারা লাগছে। আমি দৌড়ে এসে বড় চাচার পাশে হাঁটতে থাকি। বড় চাচা ফের গলা চড়িয়ে ডাকতে যাবেন ঠিক তখনই কান্নার শব্দটা কানে আসে। বড় চাচির গলা! চাচি চিৎকার করে কাঁদছেন। সঙ্গে আরও কেউ। হ্যাঁ, রুবি বু। এবার স্পষ্ট কান্নার শব্দ। রুবি বু আর বড় চাচি চিৎকার করে কাঁদছে। দৌড়ে সামনের খোলা বারান্দাটা পার হই আমি আর বড় চাচা। পেছনের বারান্দার কাছে এসে থমকে দাঁড়াই আমি। বড় চাচা দৌড়ে যান ছোট্ট জটলাটার কাছে। আমি পায়ে পায়ে এগোই।
পেছনের বারান্দার মেঝেতে রুবি বু দু'পা ছড়িয়ে বসে আছে। তার কোলের ওপর সাদা ধবধবে একটা বাছুর। চোখ দুটো খোলা। নিঃসাড়। বড় চাচি বাছুরের পা দুখানা দুহাতে আগলে ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন। পাশে আঁচলে মুখ চেপে বসে আছেন মা। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন শূন্য চোখে। বাছুরটার পুরো শরীর জল-কাদায় মাখামাখি। মিইয়ে যাওয়া পশমি শরীর থেকে ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা জল। ভিজে যাচ্ছে খড়, বিচালি, মাটির মেঝে। পাশেই সদ্য প্রসূতি কালু রক্তমাখা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার মাটিতে পা ঘষছে সে। অস্থির হয়ে আছে তার পুরো শরীর। ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন বড় চাচা। তারপর ছোঁ মেরে রুবি বু'র কোল থেকে নিয়ে নিলেন বাছুরটা। রুবি বু চিৎকার করে বড় চাচাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। তারপর ভাঙা গলায় কাঁদতে কাঁদতে বলল ‘বাবা, তুমি যহন বাইর হইছো, তহনই কালু বিয়াইছে বাবা। কালুর বাছুরডা পানিতে পইড়া গেছিল। আমরা কেউ দেহি নাই বাবা, কেউ দেহি নাই।’
মৃত বাছুরটার কাদা-জলে মাখামাখি ছোট্ট শরীর তখন শক্ত হয়ে গেছে। সরু সরু চারখানা টিনটিনে পা ক্রমশই ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে আসছে। বড় চাচা পাগলের মতো জান্তব ¯^রে গোঙাতে লাগলেন, ‘না, না, না, না...।'
তার শক্ত হাতগুলো ক্রমশই বাছুরটার প্রাণহীন টানটান সোজা পাগুলো ভাঁজ করে দিতে থাকে। কিন্তু মৃত বাছুরটার শরীর সাড়া দেয় না। বড় চাচার মুখ থেকে বের হওয়া গোঙ্গানিও তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে, ‘না, না, না, না...।'
‘বাবা! মা!' শফিক ভাইয়ের কণ্ঠে সবাই ফিরে তাকায়। বোধনকে কোলে করে পেছনের বারান্দায এসে কখন দাঁড়িয়েছেন শফিক ভাই, আমরা কেউ টেরই পাই নি। পাশে আধভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভাবি। শফিক ভাইকে দেখে যেন বাঁধ ভাঙে বড় চাচার। চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন তিনি, ‘বাবারে, এইডা আমি কী করলাম? এইডা কী করলাম আমি? আমি নিজ হাতে বাছুরডারে খুন করলাম। নিজ হাতে।’
বড় চাচি, রুবি বু, বাবা, মা, আমি, আমরা সবাই অবাক হয়ে যাই। কী বলছেন বড় চাচা? তিনি বাছুরটার মাথা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন, ‘আমি নিজ হাতে তোরে খুন করছি, নিজ হাতে খুন করছি।’
তারপর আচমকা আমার দিকে চোখ ফেরান তিনি। বাছুরটার মুখের সঙ্গে নিজের গাল চেপে ধরে কেঁদে ওঠেন, ‘আনুরে, ও আনু, আনু...। বেয়ান বেলা পানিতে যে কিছু পড়নের আওযাজ তুই হুনছিলি, তহনই ও হইছে। আর তহনই ও পানিতে গিয়া ঝুপ কইরা পড়ছে রে আনু। আনুরে, আমি তহন কেন গিয়া দেখলাম না, কেন দেখলাম না?’
বড় চাচা দুই হাতে থপথপ করে বুক চাপড়াতে থাকেন। আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মৃত বাছুরটার চোখজোড়া তখনো তাকিয়ে আছে। কাজল কালো জল ছলছলে একজোড়া চোখ। আমি সেই চোখে তাকিয়ে থাকি। চোখ ফেরাতে পারি না। বড় চাচা শফিক ভাইকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। কিন্তু শফিক ভাই হঠাৎ বড় চাচার হাত দুখানা ছাড়িয়ে দিয়ে কঠিন গলায় চেঁচিয়ে ওঠেন,' ‘অনেক হইছে বাবা, অনেক হইছে। আমার এই বাড়িতে আসাটাই ভুল হইছে। একটা বাছুরের জন্য তোমরা জীবন দিয়া দিতেছ। আর এই যে আমি এতদিন পর বাড়িত আসছি, আমার এইটুক ছেলে আসছে, বউ আসছে... তোমাগো কাছে তাগো কোনো মূল্য নাই? একটা বাছুর তোমাগো কাছে এতো দামী?’
শফিক ভাইয়ের কথা কিংবা বলার ভঙ্গি শুনে সব ক'জোড়া চোখ নিমেষেই তার দিকে ফিরে তাকায়। প্রচন্ড রাগে তখন ফুঁসছেন তিনি। তার কপালের শিরা ফুলে ফুলে উঠছে। ঘুমন্ত বোধনকে ভাবির কোলে দিয়ে বারান্দার মাঝখানে এসে দাঁড়ান শফিক ভাই। তারপর চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘মা, রুবি, তোমরা জানো না আজকে আমি আসতেছি ? অগো সবাইরে নিয়া আসতেছি, জানো না তোমরা?' বড় চাচার কান্না পুরোপুরি থেমে গেছে। কালুর সামনে রাখা খড়ের গাদার ওপর বসে পড়েছেন তিনি। শূন্য চোখে তাকিয়ে আছেন শফিক ভাইয়ের দিকে।
‘একটা গরু-ছাগলের বাচ্চার জন্য তোমাগো যতটা মায়া হেইডা তো মনে হয় আমার ছেলের জন্যও তোমাগো নাই। আমার ছেলের জন্য দূরে থাক, আমার জন্যও নাই।’
বড় চাচি, রুবি বু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে শফিক ভাইয়ের দিকে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। শফিক ভাই রুবি বু’র হাত ধরে টেনে দাঁড় করালেন। তারপর ভাবির কোলে ঘুমন্ত বোধনকে দেখিয়ে বললেন, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, কেমন কইরা ঘুমাইতেছে।'
তারপর ভাবিকে দেখিয়ে বললেন, ‘আর এই মহিলাডারে দ্যাখ, নৌকার তন নামতে গিয়া কেমনে গোসল কইরা উঠছে। আর তোরা এইখানে একটা মরা বাছুর লইয়া পূজা করতেছস? এই বাড়িতে আমি কেন আসমু ? বল এই বাড়িতে আমি কেন আসমু? আর ওরাই বা কেন আসব ?’
রুবি বু, বড় চাচি, বড় চাচা সবাই যেন নড়তেও ভুলে গেছেন। স্থির হয়ে আছে প্রতিটি মানুষ। শফিক ভাই যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন, ‘কী, তোমরা কেউ নড়বা না এইখান থেইকা ? পূজা করবা? পূজা? এই মরা বাছুর লইয়া পূজা করবা?'
তিনি হঠাৎ নিচু হয়ে বাছুরটার এক কান ধরে মৃত শরীরটা টেনে নিয়ে গেলেন বারান্দার এক প্রান্তে। কালু কী বুঝলো কে জানে? গলায় বাঁধা দড়িটা ছেঁড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল সে। কিন্তু পারল না। তবে সামনের পা দুখানা দিয়ে সজোরে মাটিতে আঘাত করতে লাগল এক নাগাড়ে। তারপর হঠাৎ আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘হাম্বাআআআ, হাম্বাআআআ...।'
সেই চিৎকারে তীব্র কষ্ট আর আহাজারী। বড় চাচা পাথর হয়ে বসে আছেন। যেন কোনো মানুষ নন তিনি। বরং প্রাণহীন খড়ের গাদারই এক অনিবার্য অংশ।
খোলা বারান্দার মাটির মেঝেতে ছুঁই ছুঁই করছে বন্যার পানি। তীব্র স্রোতে সেই পানি আরও বাড়ার আভাস। শফিক ভাই আচমকা তার চকচকে চামড়ার জুতো পড়া পায়ের ধাক্কায় বাছুরটাকে ঠেলে ফেলে দিলেন সামনে। সেখানে প্রবল পানির স্রোত। বাছুরটার শরীর ঝুপ করে পড়ল সেই স্রোতে। তারপর তলিয়ে গেল ধীরে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এতোক্ষণ ধরে একনাগাড়ে চেঁচাতে থাকা কালু আচমকা শান্ত হয়ে গেল। একদম শান্ত, চুপচাপ।
শফিক ভাইও কথা বললেন না। কথা বলল না অন্য কেউই। যেন এখানে কিছু ঘটেনি। কেউ কিছু করেনি। কেউ দেখেওনি কিছু। শফিক ভাই কেবল বোধনকে ভাবির কোল থেকে নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। মা-বাবাও চুপচাপ তাদের ঘরে চলে গেলেন। খানিক বাদে চলে গেলেন রুবি বু, বড় চাচিও।  কেবল আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বারান্দার বাইরে, আমগাছটায় হেলান দিয়ে। আর সামনে বড় চাচা। তিনি  কালুর সামনে খড়ের গাদায় চুপচাপ বসে আছেন। তার শূন্য দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে বাছুরটার মৃত শরীর যেখানে ডুবেছে, ঠিক সেখানে। কালুও। কালুর বড় বড় চোখ দুটো পলকহীন তাকিয়ে আছে পানির স্রোতে। কান্না কি-না জানি না, তবে তার চোখের কোল ভিজে আরও কালো হয়ে আছে। কালুর চোখ কি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চোখ? গভীর, কালো, মায়াময়। ওই চোখে আমি রোজ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।
কিন্তু আজ সেই চোখে চোখ পড়তেই ভয়ে কেমন কুঁকড়ে গেলাম আমি!

 

ছয়

ভোরের এখনো অনেক বাকি। কিন্তু আমার ঘুম ভেঙে গেছে। শেষরাতে ঠান্ডা পড়েছে বলেই হয়তো। একটা পাতলা কাঁথা হলে ভালো হতো। আরাম করে ঘুমানো যেত। বড় চাচা অবশ্য আরাম করেই ঘুমাচ্ছেন। দেখে ভালো লাগছে। গত দু'রাত একফোঁটা ঘুমান নি তিনি। বানের পানি বেড়েছে হু হু করে। উঠান ডুবে গেছে পুরোপুরি, বারান্দার খানিকটাও। গতকাল সন্ধ্যায় ঘরের ভেতরও পানি উঠে গেছে। শেষ পর্যন্ত মা-বাবাও এ ঘরে উঠে এসেছেন।
সেদিনের পর শফিক ভাই আর বাছুরের ঘটনা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি। কেউ না। বড় চাচাও যেন সব ভুলে গেছেন। সারাদিন কাজ, কাজ আর কাজ। উঠোনে বাঁশের উঁচু মাচা বেঁধেছেন। সেখানে তুলে দিয়েছেন হাঁস-মুরগির খোপ। বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে প্লাস্টিকের নীল পলিথিন দিয়ে সেই খোপ ঢেকেও দিয়েছেন। ধানের গোলা উঁচু করেছেন আরও। ঘরের চৌকিগুলোও। ছোট নৌকাখানা আলকাতরা মেখে শুকাতে দিয়েছেন। বড় বন্যার প্রস্তুতি!
কালুর ঘরেও পানি ঢুকেছে গতকাল। আমাদের ছনের ঘর থেকে চৌকিখানা এনে তার ওপর কালুকে তুলে দিয়েছেন বাবা। কালুর কাছে এ কদিন আর যান নি বড় চাচা। আমাকে বলতেন তার জন্য খড়, খইল, ভুসি দিয়ে দিতে। কালুকে দেখলে কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হয় আমার। সেটা ভয় না কষ্ট আমি জানি না। হয়তো এ কারণেই তার কাছাকাছি যাই না আমি। দূর থেকেই খাবার দিয়ে চলে আসি। সামান্য খড় মুখে নিয়ে চোখ বন্ধ করে খড়ের ভেতর শুয়ে থাকে সে। তার চোয়াল ক্রমাগত নড়তে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে শরীরটা মৃদু কেঁপে ওঠে। চোখের নিচের অনেকটা জায়গা জুড়ে গাঢ় কালো ভেজা দাগ। আমি বড় চাচাকে কিছু বলি না। বড় চাচাও আমাকে না। আমরা কেউই কাউকে না।

শফিক ভাই, ভাবি আজ চলে যাবেন। বড় চাচাকে ঘুম থেকে ডাকা দরকার। চাচা বলেছিলেন আলো ফোটার আগেই বের হবেন। নৌকা করে গঞ্জে দিয়ে আসতে হবে শফিক ভাইদের। আমি বড় চাচাকে ডাকি, ‘চাচা, চাচা, ওঠেন। বেয়ান হইতে চললো মনে হয়।’
আমার আলতো ডাকেই বড় চাচা উঠে বসেন। তার চোখের কোথাও ঘুমের চিহ্ন নেই। বড় চাচা কি তাহলে ঘুমান নি ?
‘তুই ঘুমাস নাই আনু?' বড় চাচার গলা কী শান্ত!
‘ঘুম ভাইঙা গেল চাচা।' আমিও উঠে বসি। জামাটা মাথা গলিয়ে গায়ে জড়াই।
‘পানি তো আরও বাড়ছে রে আনু।' বড় চাচা দড়ির ওপর ঝোলানো গামছাটা কাঁধে ফেলেন। তারপর লুঙ্গিটা হাঁটুর ওপর তুলে দু'ভাঁজ করে কোমরে বাঁধেন। ‘চল, নৌকাটা বাইর করি। আজান দিলে নামাজ পইড়াই বাইর হইতে হইবো।'

বড় চাচি, রুবি বুও উঠে পড়েছেন। বড় চাচা রুবি বুকে ডেকে বলেন, শফিক ভাইকে তুলে দিতে। আমি বড় চাচার হাত ধরে পানিতে নামি। ঠান্ডা! দরজার বাইরে আবছা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে পানি ঠেলে এগোই আমরা। পেছনের বারান্দার সঙ্গে আম গাছে নৌকাটা বাঁধা। চাচা আমাকে দুহাতে উঁচু করে নৌকায় তুলে দেন। তারপর বৈঠায় ভর দিয়ে নিজেও উঠে পড়েন। ভাঁজ খুলে হাঁটুর নিচে নামিয়ে আনেন লুঙ্গি। নৌকা থেকে কিছুটা ঝুঁকে বন্যার পানিতেই অজু সারেন বড় চাচা। এখনো আজান হয় নি। খানিক আলোকিত হয়ে উঠেছে পুবাকাশ। সেই আবছা আলোয় আমি পেছনের বারান্দায় তাকাই। সেখানে চৌকির ওপর শুয়ে আছে কালু। মৃদু মাথা নাড়ছে সে।
চাচা কাঁধের গামছা বিছিয়ে বসে পড়েন আজানের অপেক্ষায়। ভোরের তাজা হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে বড় চাচার লম্বা দাড়ি। নৌকার খুব কাছেই টুপ করে লাফিয়ে ওঠে ছোট্ট মাছ। শান্ত পানিতে মৃদু ঢেউ তোলে। সেই ঢেউ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে পুরো উঠোন জুড়ে। সেদিকে তাকিয়ে বড় চাচা জিজ্ঞেস করেন, ‘বেয়ান তো হইয়া আইলো, এহনো আজান হয় না কেন রে আনু?'
এই সময় চিৎকারটা কানে এল। আকাশ ফাটানো চিৎকার। ‘বোধন! বোধন!'

যেন প্রবল ভয়ে আরও কেঁপে ওঠে উঠোনের ঢেউ। যেন ঝনঝন শব্দে ভেঙে যায় ঘুমন্ত ভোর। শফিক ভাই, ভাবি, বড় চাচি আর রুবি বু’র চিৎকারের কণ্ঠগুলো আর আলাদা করা যায় না। আমি পাগলের মতো মাথা ঘুরিয়ে তাকাই। খোলা দরজা দিয়ে ঝড়ো হাওয়ার মতো ছুটে আসছে রুবি বু। তার বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরা ভেজা চুপচুপে ছোট্ট এক শরীর, বোধন!
বোধনের গা থেকে গলগল করে ঝরে পড়ছে পানি। কমলা রঙের উলের জামার ভেতর থেকে বোধনের ছোট্ট পেটখানা বেঢপ ফুলে আছে। রক্তহীন সাদা ফ্যাকাশে মুখ। প্রাণহীন!
‘বাবা, বোধন! বোধন... বোধন নাই বাবা! বোধন রাইতে পানিতে ডুবছে বাবা!'
রুবি বু যেন উন্মাদ। তার পেছনে পাগলের মতো ছুটে আসছেন বড় চাচি, ভাবি, শফিক ভাই। হতবুদ্ধি বড় চাচা যেন ঘোরের মধ্যে নৌকা থেকে নামেন। ছলকে ওঠা জল ভিজিয়ে দেয় তার পুরো শরীর। রুবি বু কাটা গাছের মতো ঝাঁপিয়ে পডল বড়চাচার বুকে। বড় চাচার শক্ত হাত দুখানা বোধনের ছোট্ট শরীরটা বুকে চেপে ধরে। শফিক ভাইয়ের গলায় জান্তব আর্তনাদ, ‘বোধন, ও বোধন, ও বাবা, বাবা, আমার বোধন, আমার বোধন!'
শফিক ভাই যেন পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছেন। তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। বড় চাচার গায়ের ভেজা জামাটা শক্ত হাতে টেনে ধরে গোঙাচ্ছেন তিনি। বড় চাচা খুব ধীরে, খুব ধীরে বাঁ হাতে শফিক ভাইকে কাছে টানলেন।
‘আল্লাহু আকবার...আল্লাহু আকবার...’। ফজরের আজান শুরু হয়েছে। বড় চাচা কোমর পানিতে বোধনকে বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার খোলা চোখ জোড়া শূন্যে। নির্বাক, স্থির। শফিক ভাই বোধনের গালের সঙ্গে তার গাল চেপে ধরে আবারও তীব্র আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘বোধন! আমার বোধন।’
ঠিক সেই সময় বজ্র স্বরে গলা ফাটাল কালু, ‘হাম্বাআআআ.! হাম্বাআআআ...!'
শফিক ভাই আর কালুর তীব্র চিৎকারে কেঁপে কেঁপে উঠল ভোরের আকাশ। ভোরের বাতাসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল কালু আর শফিক ভাইয়ের কান্না। দুটো কণ্ঠ যেন একটার থেকে অন্যটাকে আর আলাদা করা গেলো না। 
আর ঠিক তখুনি আমগাছের ডাল থেকে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল একজোড়া নিশাচর পাখি।

Header Ad
Header Ad

মুন্নী সাহার স্থগিত ব্যাংক একাউন্টে পাওয়া গেল ১৪ কোটি টাকা

মুন্নী সাহা। ছবি: সংগৃহীত

টেলিভিশন উপস্থাপক ও সাংবাদিক মুন্নী সাহার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে বেতনের বাইরে জমা হয়েছে ১৩৪ কোটি টাকা। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালানোর পর পরই এসব আমানতের মধ্যে ১২০ কোটি টাকাই উত্তোলন করা হয়েছে। স্থগিত করা হিসাবে এখন স্থিতি আছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা।

মুন্নী সাহা, তার স্বামী কবির হোসেন তাপস এবং তাদের মালিকানাধীন এমএস প্রমোশনের হিসাবে এই অর্থ পেয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ ছাড়া গুলশান-তেজগাঁও লিংক রোড এলাকায় শান্তিনিকেতনে ১৬৫, রোজাগ্রীণে তাদের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ির সন্ধান মিলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বেসরকারি ওয়ান ব্যাংকের কারওয়ানবাজার শাখায় মুন্নী সাহার স্বামী কবির হোসেনের মালিকানাধীন এমএস প্রমোশনের নামে ২০১৭ সালের ২ মে একটি হিসাব খোলা হয়। যেখানে নমিনি হিসেবে নাম রয়েছে মুন্নী সাহার।

অন্যদিকে, ব্যাংকটির চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় জনৈক মাহফুজুল হকের মালিকানায় প্রাইম ট্রেডার্সের নামে ২০০৪ সালের ২১ জুলাই একটি হিসাব খোলা হয়। দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকটি থেকে ৫১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণ নেওয়া হয়। ঋণ পরিশোধ না করে বারবার সুদ মওকুফ ও নবায়ন করেছে ব্যাংকটি। এর মধ্যে কেবল ২০১৭ সালেই সুদ মওকুফ করা হয় ২৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকার।

যদিও প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে পারস্পারিক ব্যবসায়ীক কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ বিভিন্ন তারিখে হিসাব দু’টির মধ্যে বিপুল অংকের অর্থ লেনদেন হয়েছে।

২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরের একটি উদাহরণ তুলে ধরে বলা হয়েছে– ওই দিন আলাদা তিনটি চেকের মাধ্যমে এমএস প্রমোশনের হিসাব থেকে প্রাইম ট্রেডার্সের হিসাবে ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়, যা সন্দেহজনক। এই অর্থ পাচার হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে বিএফআইইউ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়ান ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় প্রাইম ট্রেডার্সের নামে চলতি হিসাব খোলা হয় ২০০৪ সালের ২১ জুলাই। নথি অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করে। গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৩ আগস্ট স্থানীয় বাজার থেকে সাড়ে ১১ হাজার টন মটর কেনার জন্য ৯০ দিন মেয়াদি ২৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করে ব্যাংক।

তবে নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় দুইবার মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপরও ঋণ শোধ না করায় ২০১১ সালের জানুয়ারিতে সুদ মওকুফসহ পুনর্গঠন করা হয়। এরপর ২০১২ সালের জুনে দ্বিতীয়বার এবং ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৃতীয়বার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। তৃতীয় দফা পুনর্গঠনের সময় সুদ মওকুফ করা হয় ২৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে তিন মাসের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১২ বছরে মেয়াদ এবং ভবিষ্যৎ সুদ আদায় বন্ধ রাখা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তির ফলে পরবর্তীতে ঋণটি ছয় ধাপে ৬ বছরে ১৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা পরিশোধের সময় দেয় ব্যাংক। গ্রাহক ২০১৯ সাল পর্যন্ত কিস্তি দিলেও ২০২০ সালে আর পরিশোধ করেননি। পরবর্তীতে আবার ২০২১ সালে ৮ কোটি ৬১ লাখ টাকার ঋণ ৩৯টি সমান কিস্তিতে ২০২৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংকটির কারওয়ানবাজার শাখায় মুন্নী সাহার স্বামী কবির হোসেন ২০১৭ সালের ২ মে এমএস প্রমোশন নামের একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার চলতি হিসাব খোলেন। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৬ জুন ১৮ কোটি টাকার ওভার ড্রাফট (ওডি) ঋণ দেওয়া হয়। ঋণের দায় পরিশোধ না হওয়ায় গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারির সভায় ঋণটি নবায়ন করা হয়।

পরবর্তীতে নির্বাহী কমিটির একই বছরের ২৪ নভেম্বরের সভায় অপরিশোধিত ঋণ হিসাবটি নবায়নসহ ওডি ঋণ সীমা বাড়িয়ে ২৫ কোটি টাকা করা হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালে ঋণ হিসাবটি ৫ বছর মেয়াদি ঋণে পুনঃতপশিল করা করা হয়েছে।

Header Ad
Header Ad

ডিএনএ মিলেছে, সেই মাহমুদুর রহমানই বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী

সেই মাহমুদুর রহমানই বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

বিএনপি নেতা আবুল হারিছ চৌধুরীর পরিচয় নির্ধারণে কবর থেকে তুলে করা ডিএনএ টেস্ট তার পরিবারের সঙ্গে মিলেছে। এখন পরিবারে পছন্দমতো কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হারিছ চৌধুরীর মরদেহ দাফন করতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের পর বুধবার (৪ ডিসেম্বর) বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মুবিনা আসাফের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মাহদীন চৌধুরী।

এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর তার মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিনের করা এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ আবুল হারিছ চৌধুরীর পরিচয় নির্ধারণে কবর থেকে তুলে করা ডিএনএ টেস্ট করার নির্দেশ দেন।

২০২১ সালে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ওই সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ও বিএনপির সাবেক নেতা আবুল হারিছ চৌধুরী ‘মাহমুদুর রহমান’ পরিচয়ে ঢাকার সাভারের জালালাবাদ এলাকায় একটি মাদ্রাসার কবরস্থানে দাফন করা হয়।

হারিছ চৌধুরীর মেয়ে জানান, সদ্য বিদায়ী স্বৈরাচারী সরকার ওদের গোয়েন্দা বিভাগ একটা নাটক রচনা করে বাবার মৃত্যুকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মিডিয়া একটার পর একটা রিপোর্ট করেছে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। এটা নিয়ে যেন কখনো প্রশ্ন না উঠে সেটা ডিটারমিন করার জন্য এ রিট করেছি। আমার বাবার মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ থাকবে সন্তান হিসেবে এটা খুব মর্মান্তিক, কষ্টদায়ক। এখনো মানুষ জিজ্ঞেস করে সত্যিই কি মারা গেছেন! আমাদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তাই এটা শেষ করতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। আদালত নিরাশ করেননি।

সাভারের জামিয়া খাতামুন নাবিয়্যিন মাদ্রাসার কবরস্থানে মাহমুদুর রহমান নামে কবর দেওয়া হয় আবুল হারিছ চৌধুরীকে। তার পরিচয় নির্ধারণে কবর থেকে তুলে ডিএনএ টেস্ট করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর আবুল হারিছ চৌধুরীর নামে ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হবে না ও তার নামে থাকা ইন্টারপোল রেড নোটিশ কেন প্রত্যাহার করা হবে না, তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী নিজ জেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধার যথাযথ সম্মান দিয়ে কেন কবরস্থ করা হবে না এই মর্মে রুল জারি করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, রেজিস্ট্রার জেনারেল( জন্ম ও মৃত্যু), সিআইডির পরিচালক, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার ও সাভার মডেল থানার ওসিকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর হারিছ চৌধুরী সস্ত্রীক তার গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দর্পনগরে যান। রাত ১২টার পর তার ব্যক্তিগত সহকারী আতিক মোবাইল ফোনে জানান, ঢাকায় বিএনপি নেতাদের বাসভবনে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। কয়েক ঘণ্টা পর যৌথ বাহিনী হারিছের বাড়িতে হানা দেয়। কিন্তু তার আগেই তিনি সটকে পড়েছিলেন। কিছুদিন সিলেটে এখানে-ওখানে লুকিয়ে থাকার পর ওই বছরের ২৯ জানুয়ারি জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে ভারতে চলে যান। ভারতের আসামের করিমগঞ্জ জেলার বদরপুরে তার নানাবাড়ি। সেখানেই তিনি ওঠেন। সেখান থেকেই বিদেশে যাতায়াত করতেন।

Header Ad
Header Ad

৭০ জঙ্গিসহ ৭০০ বন্দি এখনও পলাতক, ৬৯ কারাগারের ১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের তোপে গত ৫ আগস্ট দেশের পটপরিবর্তন ঘটে। এসময় পালিয়ে যাওয়া কারাবন্দিদের মধ্যে এখনও গ্রেপ্তার করা যায়নি ৭০০ অপরাধীকে, যাদের মধ্যে ৭০ জন জঙ্গিও রয়েছে। এ ছাড়া, দেশের ৬৯টি কারাগারের মধ্যে ১৭টি কারাগার এখনও ঝুঁকিপূর্ণ।

বুধবার (৪ ডিসেম্বর) সকালে কারা অধিদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, কারাগার থেকে পালানোর ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে আর না ঘটে, সে জন্য প্রতিটি ঘটনাকে আলাদাভাবে পর্যালোচনা করে কাজ করছে কর্তৃপক্ষ।

পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ কারাগার সংস্কার দরকার জানিয়ে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, বর্তমানে দেশে মোট ৬৯টি কারাগার রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি কারাগার অনেক পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ। সরকার বিষয়গুলো জানে, এগুলো দ্রুত সংস্কার, মেরামত ও পুনর্নির্মাণ দরকার।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, কোনো আসামিকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার পর আর কোনো দায় থাকে না কারা কর্তৃপক্ষের। কোনো কয়েদিকেই অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। আর যারা ডিভিশন পাওয়ার যোগ্য, তাদের তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।

কারা মহাপরিদর্শকের বক্তব্যে উঠে আসে, ৫ আগস্ট দেশের পটপরিবর্তনের আগে ও পরে বিভিন্ন কারাগার থেকে ২২শ’ আসামি পালিয়ে যায়, যাদের ১৫শ’ জনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে ৭০ জন ফাঁসি ও আলোচিত মামলার আসামি এখনও পলাতক।

এদিকে, কারারক্ষী কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

Header Ad
Header Ad

সর্বশেষ সংবাদ

মুন্নী সাহার স্থগিত ব্যাংক একাউন্টে পাওয়া গেল ১৪ কোটি টাকা
ডিএনএ মিলেছে, সেই মাহমুদুর রহমানই বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী
৭০ জঙ্গিসহ ৭০০ বন্দি এখনও পলাতক, ৬৯ কারাগারের ১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ
ভারত নয়, এবার পাকিস্তান থেকে আসছে ২৫ হাজার টন চিনি
জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় আমু ও কামরুলকে গ্রেপ্তার দেখাল ট্রাইব্যুনাল
ভারতের উচিত বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতা উপলব্ধি করা: মাহফুজ আলম
‘শেখ হাসিনার আমলের চেয়ে হিন্দুরা এখন বেশি নিরাপদে আছে’
চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তার নিয়ে প্রশ্নে যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র
বাসায় চুরি, পুলিশের দ্বারস্থ ওমর সানী
ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আজ বৈঠকে বসছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
শীত জেঁকে বসেছে দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা চুয়াডাঙ্গায়
আবারও সাজেক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা
সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক আজ
১৫ বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে বাংলাদেশের টেস্ট জয়
বিদ্যুৎ খাতে ১৫ বছরে ৭২ হাজার কোটি টাকার লুটপাট
সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের অভিযোগে ভারতীয় নাগরিক আটক
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশি জানলেই হয়রানি
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের গোলামি করতে স্বাধীনতা অর্জন করিনি: সোহেল তাজ
মাইক্রোসফটের সমীক্ষায় ভুয়া খবর ছড়ানোর শীর্ষে ভারত
আগরতলার বাংলাদেশ হাইকমিশনে কনস্যুলার সেবা বন্ধ