ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১১
স্নানের শব্দ
অফিসে একটা চাপা উত্তেজনা। কারণ নির্ঝর চৌধুরী অবশেষে ইমেইলে তার পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন তিনি। তার বিদায়টা অবশ্য যথাযথ হলো না। যেন একরকম পালিয়ে বাঁচলেন তিনি। যথাসময়ে নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারার মাশুল দিলেন হয়ত। হয়ত ভেবেছিলেন ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই, ফলে জানবে না কেউ। কিন্তু এতদিন মুখ বন্ধ করে রাখা ভুক্তভোগী নিজেই যে জলজ্যান্ত সাক্ষী হয়ে সব কিছু ফাঁস করে দেবে তা কে জানতো? শেষ অবধি তার কর্মের দায় প্রতিষ্ঠান নেয়নি। ফলে নিজ কর্মফল নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিঃশব্দে চলে যেতে হয়েছে তাকে।
সবাই জানে ম্যানেজমেন্ট এখন কোম্পানির জন্য নতুন সিইও খুঁজছে। সেটা তারা প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকেও নিতে পারেন আবার বাইরে থেকেও আনতে পারেন। তাদের মর্জি।
‘ম্যাডাম, ইনহাউজে তো আপনি আর ওসমান গণি সাহেব.. এই দুজনই সিইও হবার যোগ্য।’
মনিরুজ্জামান তার ফাইলে সই নিয়ে চলে যাবার আগে অধোমুখে বলে। শবনম সরাসরি ‘হ্যাঁ বা না’ কিছু বলে না। ‘তবে আমরা মনে করি, সব বিবেচনায় আপনার দিকেই পাল্লা ভারি..’ মনিরুজ্জামান আবার বলে।
’কীভাবে?’ শবনম ভ্রু উঁচিয়ে গম্ভীর মুখে জানতে চায়। কথা বলতে পারার আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে মনিরুজ্জামানের চেহারা, ‘আপনার এতদিনের অভিজ্ঞতা, বিদেশি ডিগ্রি, সিনসিয়ারিটি, স্টাফদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা সব মিলিয়ে ..’
কথার মাঝখানেই ওকে থামিয়ে দেয় শবনম।
‘শোনো, এইসব যাদের বিষয় তাদের ভাবতে দাও, চেয়ারম্যান সাহেব আছেন, বোর্ড অব ডিরেক্টরস আছেন তারাই ভাববেন, তুমি নিজের কাজে মন দাও।’
‘জ্বি ম্যাডাম, জ্বি।’
মনিরুজ্জামান চলে যাওয়ার পর তিনতলার বোর্ডরুমের দিকে এগোয় শবনম। কোম্পানির জুনিয়ার এক্সিকিউটিভ নিয়োগের ভাইবা আছে আজ। লিখিত পরীক্ষায় যারা ভালভাবে পাশ করেছে মৌখিক পরীক্ষায় তাদেরই ডাকা হয়েছে, দেখে শুনে আরেক দফা যাচাই বাছাই করে নেওয়ার জন্য। সিইও সাহেব উপস্থিত থাকলে এ সব কাজে সাধারণত শবনমের ডাক পড়ে না। তার অনুপস্থিতিতে বোর্ডে বসে তরুণ ভীরু, আত্মবিশ্বাসী আশা নিরাশায় দোদুল্যমান নানা ধরনের মুখগুলি দেখছিল শবনম। প্রশ্ন করছিল টুকটাক। তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করছিল অন্য বোর্ড সদস্যদের করা প্রশ্নোত্তর পর্ব আর ফাঁকে ফাঁকে চোখ বুলাচ্ছিলেন টেবিলের উপরে রাখা চাকুরিপ্রার্থীদের সিভিগুলোতে। একটা মেয়ের সিভিতে এসে রেফারেন্সের ঘরে চোখ আটকে গেল ওর। ক্যাপিটাল লেটারে প্রফেসর ইমতিয়াজ মতিন এবং তার ডিপার্টমেন্ট আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম লেখা। সঙ্গে তার কন্টাক্ট নম্বরও দেওয়া আছে। হঠাৎ কি মনে হলো টুক করে সবার অগোচরে নিজের ফোনে ইমতিয়াজের নম্বরটা টুকে নিল শবনম।
বোর্ডের সামনে বসে থাকা ইমতিয়াজের ছাত্রী মেয়েটা দেখা গেল বেশ চটপটে, ঝটপট সবার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। না পারলে দ্রুত বলে দিচ্ছে উত্তরটা তার জানা নেই।
‘ইমতিয়াজ স্যার আপনাদের কি পড়াতেন?’
‘স্যার বিজনেস কমিউনিকেশনস পড়াতেন, ম্যাম’
মেয়েটি চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণে বলল। ‘এখন তো উনি ডিন। প্রো-ভিসি হয়ে যাবেন কদিন পরে ...
ব্যবসায়িক যোগাযোগের সাধারণ কয়েকটা বিষয় নিয়ে মেয়েটিকে প্রশ্ন করল শবনম। ভালই উত্তর দিল মেয়েটি। ইন্টারভিউ শেষ করতে করতে লাঞ্চ টাইম পার হয়ে গেল। তারপর বোর্ডের অন্যদের সঙ্গে নম্বর মিলিয়ে প্রার্থী সিলেক্ট করে শেষ বিকেলে নিজের রুমে বসে ইমতিয়াজের ফোন নম্বরটা বের করে এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল শবনম। কত কথা যে শরতের মেঘের মতো ভেসে ভেসে মনের মধ্যে এল আর গেল। কিছু মেঘ বৃষ্টি ঝরাল, কিছু মেঘ কালো হাতির মত শুড় তুলে দল বেঁধে অজানায় হারিয়ে গেল আর কিছু মেঘ উড়ে এসে মনের উপর চেপে বসল, ফলে অবচেতনে চাপা পড়ে থাকা স্মৃতিবৃক্ষ থেকে টুপটাপ শুকনো পাতারা ঝরতে থাকল।
শবনমের মনে পড়ে অনেক আগে বন্ধুদের আড্ডায় ইমতিয়াজ একবার কথায় কথায় বলেছিল, ‘ঘরের মধ্যে প্রতিযোগিতা করা তার একেবারেই পছন্দ নয়,’
তবে কি শবনমের মধ্যে প্রতিযোগী মনোভাব খুঁজে পেয়েছিল সে? সেকি ভয় পেয়েছিল, ভেবেছিল ভবিষ্যতে শবনম তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে? সে কি কোনো ধরনের হীনমন্যতায় ভুগছিল? নাকি ডুবেছিল আত্মমগ্নতায়? তার অনভ্যস্ত মন হয়ত প্রচলিত চাওয়া পাওয়া আর গণ্ডিবদ্ধ জীবনের বাইরে গিয়ে শবনমের পরিবর্তিত অবস্থান মেনে নিতে রাজি ছিল না। মুখচোরা স্বভাবের কারণেই হয়ত কোনোদিন স্পষ্ট করে কিছু বলেওনি সে। অথচ শবনম সবসময় তার হাত ধরে, লেফট রাইট করে তালে তালে পা মিলিয়ে পাশাপাশি চলার কথা ভেবেছে, প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা করতে চেয়েছে, সংকটে সাফল্যে, সুখে দুঃখে পাশে থাকতে চেয়েছে। ইমতিয়াজ তাকে পূজা করে মাথায় তুলে রাখুক, আদর করে শোকেসে সাজিয়ে রাখুক এমনটা হয়ত কখনোই চায়নি সে, তবে অবহেলা বা উপেক্ষা? না, সেটা সহ্য করা সম্ভব নয়। একটা নিয়ন্ত্রিত, সমর্পিত, অধস্তন জীবনও তার কাছে যাপনযোগ্য মনে হয়নি কোনোদিন।
কেমন হতো আজ সেও যদি ইমতিয়াজের মতো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হত, দুজন একসঙ্গে গবেষণা করত, সেমিনারে বক্তৃতা করত, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতো.. কে জানে জীবনটা তখন আরও বিরক্তিকর আরও একঘেয়ে বা ক্লান্তিকর হয়ে পরতো কি না।
এখন তো বোঝাই যায় শবনম যেমনটা চেয়েছিল ইমতিয়াজ তেমনটা চায়নি। সেই কারণেই হয়ত ওদের কয়েক ব্যাচ জুনিয়র বাংলা সাহিত্যের সাদাসিধে ছাত্রী উম্মে কুলসুম আঁখিকে বিয়ে করে সুখি হয়েছে সে। সুরাইয়াই বোধহয় জানিয়েছিল একবার, প্রবাসে থাকতেই দুই পুত্রের বাবা হয়েছে ইমতিয়াজ। পিএইচডি শেষে কয়েক বছর বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে দেশে ফিরে মোটা বেতনে একটা নামি-দামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছে সে। অন্যদিকে আঁখি চাকরি বাকরির পথে যায়নি বরং নিপুণ হাতে ঘর সংসার সন্তান সামলেছে।
একবার বছর দুয়েক আগে ফাইনানসিয়াল ইন্টিগ্রিটি নিয়ে মেট্রোপলিটন চেম্বারের একটা রাউন্ড টেবিলে প্রায় আঠারো বছর পরে ইমতিয়াজের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়েছিল শবনমের। ছাত্রজীবনের হালকা পাতলা টিংটিঙে শরীরে স্বভাবতই বয়সের মেদমাংশ লাগা, চুল পড়ে বড় হয়ে যাওয়া কপাল, মুখে মানানসই সাদা কালো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, স্যুটেড বুটেড ইমতিয়াজকে তার ঘন ভ্রু, চশমার কাঁচের নিচে ঢাকা কালো ছোট চোখ দুটোতে প্রখর আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টি আর ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা বাঁকা হাসির জন্যই হয়ত চিনতে এতটুকু কষ্ট হয়নি শবনমের।
‘কি অবস্থা? কেমন আছো?’
প্রথম ইমতিয়াজই জিজ্ঞেস করেছিল ভদ্রতা করে। তারপর পাশের ভদ্রলোককে ক্যাজুয়াল ভঙ্গীতে হাসিমুখে বলেছিল,
‘আমরা কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ক্লাসমেট ছিলাম।’
শবনম মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল। হ্যাঁ, ক্লাসমেটই তো, একই শ্রেণিকক্ষে দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসেছি, আড্ডা দিয়েছি। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পাশ দেওয়া হলে, যার যার অর্জিত জ্ঞান নিয়ে আমরা চলে গিয়েছি নিজস্ব গন্তব্যে। পুরনো প্রেমের গল্পগুলো তখন টুপ করে ডুবে গিয়েছিল সমুদ্রের গভীর অতলে। নিজেদের আত্মকেন্দ্রের চারপাশে আত্মপ্রতিষ্ঠার নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুরছিলাম আমরা, সেই ঘূর্ণন দুইজনকে দুই মেরুতে নিয়ে ফেলেছে। এখন বাকি সব পরিচয় ঢেকে গিয়ে সহপাঠী পরিচয়টিই প্রধান ও একমাত্র পরিচয় হয়ে উঠেছে।
শবনম তার ফোন থেকে ইমতিয়াজের নম্বরটা আস্তে করে বোতাম টিপে ডিলিট করে দেয়। একবার যা হারায় তা একেবারেই হারায় আর ফিরে আসে না, তবে খামোখা কেন যোগাযোগের ক্ষীণ সূত্রটা জিইয়ে রাখা? তারচে নিজেকে একেবারে প্রত্যাহার করে নেওয়াই ভাল। এ সব আসলে সুন্দর ফাঁদ, তোমাকে আটকে ফেলবে আবেগের জালে, কষ্ট দেবে, মিছিমিছি দুঃখ বাড়াবে। নিজেকে বোঝায় সে। কোনো দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। তারচে নিজের স্বাধীন, স্বাবলম্বী, অর্থপূর্ণ জীবনকে উদযাপন করো। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দাও, উচ্চকণ্ঠে বলো, থ্রি চিয়ার্স ফর শবনম। নিজের পেশাগত জীবনের সম্মান, অনিশ্চয়তা, টেনশনের পাশাপাশি এত দূর পর্যন্ত দম ধরে রেখে যে দৌড়ে যাচ্ছো, তার গৌরব ও আনন্দকে গুরুত্ব দাও। উল্লাস কর। উদযাপন কর।
হ্যাঁ, তোমার এ অর্জন এমনি এমনি আসেনি। সেজন্য মূল্য দিতে হয়েছে, সকাল সন্ধ্যা গাধার খাটুনি খাটতে হয়েছে, হাড়ভাঙা পরিশ্রমও করতে হয়েছে। কারো আদরের বিড়াল হয়ে কোলে উঠে মিউ মিউ করার স্বভাব বাদ দিয়ে বাঘিনীর মতো নিঃসঙ্গ সতর্ক গর্জনশীল জীবন বেছে নিতে হয়েছে। তবে দিনশেষে প্রাপ্তিটাও তো কম নয়। নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে কাউকে তোয়াক্কা না করে, স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে চলতে চাইলে আরাম আয়েশের কিছু ঘাটতি তো হতেই পারে, তাই না?
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>