ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১০
স্নানের শব্দ
কয়েকদিন ধরে এই অচেনা নম্বর থেকে ফোনটা আসছে। ধরলেই নিঃশব্দে কেটে দিচ্ছে। আজকে অফিসে যাওয়ার পথে গাড়িতে আবার রিং বাজতে শুরু করলে, ‘ধরব না’ ‘ধরব না’— ভাবতে ভাবতেই শেষ পর্যন্ত ফোনটা ধরে শবনম। ওই পাশে কারো গভীর নিশ্বাসের শব্দ তার কানে এসে বাড়ি খায়।
‘কে বলছেন?’
‘জ্বি, আমাকে আপনি চিনবেন না। .. কি যদি অভয় দেন একটা কথা বলতে চাই। .. আসলে অনেক দিন ধরেই বলতে চাচ্ছি, কিন্তু কীভাবে বলব, ঠিক বুঝতে পারছি না। মানে সাহস পাচ্ছি না।’
ওই পাশের ভণিতা শুনে শবনম অস্ফুট পুরুষ কণ্ঠের বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করে। মনে হচ্ছে অল্পবয়সী একটা ছেলে। যার কথা বলার ভঙ্গীতে নার্ভাস ভাব স্পষ্ট। যেন, ‘বলবো কি বলবো না’- এমন লজ্জ্বা ও দ্বিধায় দোদুল্যমান এক নবীন কিশোর।
‘আসলে আমি জানি, আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় হবেন, তবু তবু আপনাকে আমার ভাল লাগে, এই কথাটা জানাতে চাই।’
শবনম হাসবে, না রাগ করবে, ভেবে পায় না।
‘মানে, আমি কি মাঝে মাঝে আপনাকে ফোন করতে পারি, যদি অনুমতি দেন, মানে আপনার বন্ধুত্ব ..’
এবার আর পুরোটা শোনার প্রয়োজন মনে করে না শবনম, ওই পাশের বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বেরসিকের মতো কড়া গলায় বলে,
‘না। শোনো, আর কোনদিন আমাকে ফোন করবে না। এত সাহস হয় কি করে? আচ্ছা, এই কে তুমি, বলো তো, কি নাম তোমার?’
ফোনটা তখনই কেটে যায়। অথবা ওই পাশ থেকে কেটে দেওয়া হয়।
ব্যাগের পকেটে নিজের ফোন সেট রাখতে গিয়ে ঠোটের কোণায় মৃদু একটা হাসি ফুটে ওঠে মিলিয়ে যায় শবনমের। ‘যৌবনের শেষে শুভ্র শরৎকালের’ মতো এই উনপঞ্চাশ বছর বয়সেও নতুন বন্ধুত্বের প্রস্তাব! তার মানে কি এই, যে তার আকর্ষণ বা আবেদন একেবারে ফুরিয়ে যায়নি? (তারেক শুনলে হয়তো গত রাতের উদাহরণ টেনে বলবে, তুমি যে অনন্তযৌবনা, সে তো আমি চিরকালই জানি!) তবে এই ভাবনায় এবার নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হয় শবনম। যে যাই বলুক তার নিজের চেয়ে আর কে বেশি জানে যে, এই শরীর ও মনে দিনের শেষে মন্দমন্থর পায়ে দিন শেষে সন্ধ্যা নামছে। এখন নতুন পরিচয়, নতুন সম্পর্কের এইসব আশ্বাস বার্তা বৃথা। এইক্ষণে আর কোনোভাবেই ‘নতুন প্রণয়ের মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করা’ সম্ভব নয়, এখন ধীরে ধীরে সমস্ত বাসনা ও আকাঙ্ক্ষার অবসান ঘটানোর সময়। আহা, ওই মোহগ্রন্থ’ নওল কিশোর বা যুবক জানে না, এইসব অকিঞ্চিতকর অনুভূতি ভাসতে থাকা ধোঁয়ার মতো, বাস্তবের প্রবল বাতাস এসে এক ধাক্কায় এই কোমল হৃদয়াবেগ ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়ে যায়।
শবনমের সেই কিশোরী বয়সে প্রথম প্রেমের চিঠি পাওয়ার থরো থরো কম্পিত দিনগুলির কথা মনে পড়ে। পাপড়ি মুখরিত রঙিন ফুলের জলছাপ দেওয়া হাল্কা নীল রঙের প্যাডে সবুজ কালির বলপেন দিয়ে খুব যত্ন করে লেখা ছিল সেই চিঠি। ভালবাসার বাসনা প্রকাশের পাশাপাশি অনেকগুলো প্রচলিত বাংলা সিনেমার গানের কলি উদ্ধৃত করেছিল পত্রলেখক। শবনমের এখনো মনে আছে সেই লাইনগুলো-
‘এ আকাশকে সাক্ষী রেখে, এ বাতাসকে সাক্ষী রেখে তোমাকে বেসেছি ভালো, তুমি মোর নয়নেরই আলো’
আরেকটা গানের উল্লেখ ছিল চিঠিতে, আরও আগ্রাসী মনোভাবের, সিনেমাতে সম্ভবত নায়ক ফারুক লিপসিং করে প্রেমিকার উদ্দেশে গাইতো গানটি- ‘মরণের পরে যদি জীবন থাকে, সে জীবনে প্রিয়া তুমি আমার হবে’
ইহজীবনে প্রেমিকাকে পাওয়ার আশাবাদ দিয়ে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে তাকে কেনো কাছে পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিল সেই কিশোর, কে জানে! অবশ্য তার তো ওই চিঠি পাঠানো পর্যন্তই সার, তারপর সে কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছিল। কখনোই প্রকাশ্যে সামনে এসে দাঁড়ায়নি সেই পত্র লেখক। হয়ত সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি, হয়ত সংকোচ কাটাতে পারেনি, হয়ত দ্বিধা আর লজ্জ্বা তাড়াতে পারেনি। হয়ত সেজন্যই মৃত্যু পরের অনিশ্চিত জীবনের প্রতিই আস্থা রেখেছিল সে!
মৌসুমি যেমন একবার বলেছিল, কৈশোর যৌবনের প্রেম হচ্ছে এক ধরনের মায়া, ভ্রান্তি , ইলিউশান। ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো হঠাৎ একটা ধাক্কা। বিনা মেঘে আসা বৃষ্টির মতো আকস্মিক আর গভীর ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্নের মত তীব্র কিন্তু ক্ষণস্থায়ী।
ফোনটা আবার বাজে। আবার কি ওই ছেলেটা নাকি? না, এবার কি আশ্চর্য ফোন করেছে মৌসুমী।
‘তোমার কথাই ভাবছিলাম দোস্ত, একটা কারণে..’
কিছুক্ষণ আগে অপরিচিত যুবকের ফোন কলের বিষয়টি হাসতে হাসতে মৌসুমীকে জানায় শবনম।
‘আরে, এটাতো হাসির বিষয় না। এই বয়সে কেউ যদি তোমার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে তাহলে বুঝতে হবে, সে তোমার রূপের না, তোমার গুণ বা ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছে। আবেগের চেয়ে এই ধরনের সম্পর্কে শ্রদ্ধা, সম্মান, একটা শান্ত সমাহিত ভাব বিরাজ করে। আর কৈশোর যৌবন কোনো ব্যাপার না, প্রেম যেকোনো বয়সেই হতে পারে..’
‘থাক থাক ! বহুত বলছো, আমি কাঠখোট্টা মানুষ, ওসব আমার পোষাবে না।’
‘আচ্ছা, ঠিকাছে, যে জন্য ফোন করছি, কালকে সকালে প্রেস ক্লাবে আমরা কয়েকটা নারী সংগঠন মিলে একটা সমাবেশ করবো। ইস্যু হচ্ছে, ওই যে এখনকার মি টু কে কেন্দ্র করে কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি.. তো তুমি পারবা নাকি আসতে? অনেককেই ডাকছি আমরা, তুমি তো ভাল পজিশনে আছো, একজন সফল নারী। তুমি এসে কয়েকটা কথা বললে ভাল হয়।’
মৌসুমী এক নিশ্বাসে বলে যায়।
‘ইস্যুটা তো খুবই ভাল, দরকারি, কিন্তু আমার সমস্যা আছে। আমাদের অফিসেও কিছুদিন আগে এরকম একটা কেস ঘটেছে..’
‘হ্যাঁ, জানি তো, সেজন্যই তো বলছি।’
মৌসুমী বেশ জোর দিয়ে বললে শবনম একটু ইতস্তত করে,
‘দেখো বন্ধু জলে বাস করে কুমিরের সাথে দ্বন্দ্ব করা কী সম্ভব? এমনিতেই অফিসে আমার বিরোধী একটা গ্রুপ গুজব ছড়াচ্ছে যে আমি নাকি ওই মেয়েদের দিয়ে সিইওর বিরুদ্ধে এসব করিয়েছি, এখন যদি আবার তোমাদের সাথে যোগ দেই, আর যদি সেসব নিউজ হয়, হবে তো বটেই, তখন বুঝতে পারছো, ওরা আমার বিরুদ্ধে রং চড়িয়ে আরও নানা কথা ছড়াবে। এই মুহূর্তে আসলে আমি ঝামেলাটা নিতে চাচ্ছি না..’
‘কী যে বলো, ঝামেলা কেনো হবে! তোমার নিজস্ব মতামত, স্বাধীন একটা অবস্থান থাকতে পারে না! চাকরি করো মানে কি দাসখত দিয়ে বসছো নাকি? খারাপ লোকেরা উল্টা পাল্টা কথা বলবেই, তাতে দমে গেলে চলবে? প্রতিবাদ করতেই হবে, পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ নাই। নইলে অপরাধীরা প্রশ্রয় পেয়ে যাবে!’
বিপ্লবী নেতার মতো ফোনের অন্য প্রান্তে মৌসুমী জোরালো বক্তৃতা ঝাড়ে। ওকে বাস্তব অবস্থাটা বোঝানোর চেষ্টা বৃথা শবনম বুঝতে পারে। বাস্তব বিবেচনাবোধের চাইতে এখন ন্যায়ের প্রশ্নে অনড় তার অবস্থান, ফলে শিশুকে প্রবোধ দেওয়ার মতো শবনম তার কথায় সায় দেয়।
‘তাতো ঠিকই বলেছ। দেখি, আমি আসব সুযোগ পেলে, জরুরি মিটিং সিটিং না থাকলে.. চলে আসব।’
মৌসুমী এবার সন্তুষ্ট হয়। কিন্তু শবনম জানে, এই সমাবেশে যোগ দিলে অফিশিয়ালি সেটা তার জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। সমাবেশে নিশ্চয়ই নির্ঝর চৌধুরীর ঘটনাটাও আলোচনায় আসবে। স্বাভাবিকভাবে কোম্পানির নাম ধামও তখন সামনে আসবে। এইসব জায়গায় কেউ তো আর রেখে ঢেকে কথা কইবে না। সুযোগসন্ধানীরা তখন হয়ত এটাকেই পূঁজি করবে। শত্রুতা করে ম্যানেজমেন্টকে গিয়ে জানিয়ে আসবে যে শবনমই ওই সমাবেশের মূল হোতা। ইচ্ছাকৃতভাবে কোম্পানির ভাবমূর্তি নষ্ট করছে সে। দুষ্ট লোকেরা কে যে কোনদিকে বসে কী ঘোট পাকাচ্ছে কে জানে? অনেকের কাছে মনে হতে পারে এসব শবনমের অতিভাবনা বা অতি সতর্কতা, কিন্তু শবনম তো জানে প্রতিনিয়ত এরকম সতর্ক পদক্ষেপই তাকে এখনকার পর্যায়ে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে।
মাঝে মাঝে তার প্রাণ মন যে একসঙ্গে বিদ্রোহ করে না, তা তো নয়, অসহায়ও লাগে, রাগ হয় অবস্থার ওপর, বিরক্তি আসে নিজের অতি সাবধানী মনের উপর। কিছু একটা করতে চায় সে, সহবন্ধুদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রতিবাদ করতে চায় কিন্তু আবার মনে হয় এতদিন ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা তার ক্যারিয়ার একটা সামান্য ভুল পদক্ষেপে ধসে পড়লে এই সমাজে তার পাশে এসে দাঁড়াবার মত কেউই থাকবে না। তার এতদিনের অর্জিত সুনামের কোনো মূল্যায়নই হবে না। আজ উচ্চ পদে ভাল অবস্থানে থেকে স্বাবলম্বী ও আত্মনির্ভরশীল হতে পেরেছে বলেই না এই নিষ্ঠুর সমাজে সম্মানের সঙ্গে মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে টিকে আছে। শবনমের ভেতর থেকে আরেকটা মন চোখ রাঙিয়ে প্রশ্ন করে, নিরাপদ বৃত্তের ভেতরে এভাবে আটকে থাকা তোমার কাছে সম্মানের হলো? এটা তো পরিস্থিতির সামনে কোনো আপত্তি না তুলে বোবা হয়ে, হাত পা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
‘না, না, এভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যাবে না। প্রতিবাদেরও নানা ধরণ আছে, সব সময় যে মাঠে গিয়ে সভা সমাবেশ করে প্রতিবাদ করতে হবে হবে এমন তো নয়.. ‘শবনম তার ভেতরের মনটার সঙ্গে অবিরাম তর্ক চালিয়ে যায়। ‘আমি সবসময়ই সব ধরনের নিপীড়ন নির্যাতনের বিরোধী। অফিসের ভেতরেও তো এক ধরনের সংগ্রাম আমি এককভাবে করেই যাচ্ছি। করছি না? এই যে আমি এত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে আছি, সেটাও তো এক ধরনের প্রতিবাদ। এখন হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে অযথা বিপদে পড়লে কে আমাকে উদ্ধার করবে, কে এসে পাশে দাঁড়াবে? কেউ না।
হ্যাঁ, অনেকেই হয়ত এটাকে আপোষ বলবে, বলবে ক্যারিয়ার বাঁচানোর ধান্দা। কিন্তু শবনম জানে, লড়াইয়ের মাঠে সম্মুখ সমরে নামার যোগ্যতা সবার থাকে না। কেউ কেউ আছে যুদ্ধের মাঠে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে জেনেও বুক চিতিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। তারাই হয়ত প্রকৃত বীর, তারাই পরিবর্তনের নায়ক, তারাই নমস্য। তাদের জন্য শবনমের শ্রদ্ধা ও সালাম অশেষ। নিজের এই না-পারা টুকু, এই সীমাবদ্ধতাটুকু অতিক্রমের সুযোগ তার এই জীবনে কোনোদিন আসবে কি না জানে না শবনম।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>