ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৯
স্নানের শব্দ
মায়ের মৃত্যু শোক এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারেক। মাতৃবিয়োগের যে প্রচণ্ড শক আর শোক, এক জীবনে তার হয়ত কোনো সান্ত্বনাও হয় না। মা চলে যাবার পর থেকে একটা গভীর শূন্যতার হাহাকার যেন প্রচণ্ডভাবে ঘিরে ধরেছে তাকে। যেন এক ঘোর, এক মায়া, এক অদ্ভুত তমসায় সে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে। মা ছিল, এখন নেই, মানে আর কখনোই তাকে পাওয়া যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, দেখা যাবে না, শোনা যাবে না। মা এখন শুধুই কিছু স্মৃতি আর ছবির সমাহার। আগে থেকেই বিশ্বাসী মানুষ তারেক, এখন নিয়মিতই নামাজ পড়ে, সময় মত মসজিদে গিয়ে যেন ভুলে থাকতে চায় মা হারানোর কষ্ট, সেই সঙ্গে দৈনন্দিন ইহলৌকিক কাজ কর্ম। তেমন বৈষয়িক সে আগেও ছিল না, এখন যেন আরও উদাসীন।
দাড়ি কামানোর মত প্রাত্যহিক কর্মটাও ইদানিং ছেড়ে দিয়েছে সে। ফলে এই পনের দিনেই সাদা পাকা অবিন্যস্ত দাড়ি আঙ্গুরলতার মত কয়েক ইঞ্চি বেড়ে নিচের দিকে নেমে এসেছে।
‘দাড়িটা রেখেই দেই, কি বলো?’
পাঁচ আঙ্গুলে বাড়ন্ত দাড়িতে বিলি কাটতে কাটতে শবনমকে উদ্দেশ করে বলে সে।
‘রাখতে চাইলে রাখো। তোমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিয়ে আমি কোনো কথা বলেছি কখনো?’
‘না, তা বলোনি। তবু তোমার মতামতটা শুনি.. ’
তারেক ঘরের কোণায় রাখা ড্রেসিং টেবিলের লম্বাটে আয়নার কাছে গিয়ে ডানে বামে সামনে পেছনে ঘাড় নাড়িয়ে বিভিন্নভাবে নিজেকে দেখে।
‘দাড়িতে আমাকে কেমন লাগবে, মানাবে কিনা, আবার বেশি বুড়ো বুড়ো দেখাবে কি না .. ’
সাতান্ন বছর বয়সী তারেকের এই সৌন্দর্য সচেতনতায় শবনমের ঠোটের কোণায় মৃদু হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়। অফিস থেকে ফিরে কাপড় বদলে সে বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে টিভি দেখছিল। এবার উঠে বসে বলে,
‘তা ওরকম সাদা দাড়ি রাখলে আগের চাইতে একটু বয়স্ক তো দেখাবেই, খানিকটা ভার ভারিক্কীও লাগবে অবশ্য.. আগে তো মানুষ চাচা ডাকতো এবার দাদাজানও ডাকতে পারে। ভেবে দেখো..’
এবার তারেকের ধর্ম বোধের কাছে সৌন্দর্য বোধ হার মানে। আয়নায় চোখ রেখেই সে বলে,
‘নবিজীর সুন্নত। রেখে ফেলছি যখন, তখন আর ফেলি না, থাকুক।’
শবনম আর কোনো মন্তব্য না করে আবার কাত হয়ে শুয়ে টিভি দেখায় মনযোগ দেয়।
‘ভাবছি, আগামী বছর হজে গেলে কেমন হয়?’
আয়নার সামনে থেকে সরে এসে খাটের উপর আধ শোয়া শবনমের পাশে এসে বসে তারেক। শবনম নিউজ দেখছিল বলে তারেকের কথাটা ভাল করে শুনতে পায়নি। তাই রিমোট টিপে টিভির সাউন্ড কমিয়ে আবার জানতে চায় সে।
‘হুম? কি বললা?’
এবার সরাসরি সিদ্ধান্তটাই জানায় তারেক।
‘ওইতো, বললাম, আগামী বছর হজে যাওয়ার নিয়ত করেছি আমি।’
তারপর লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘কয় দিনের আর দুনিয়া বলো! আজ আছি কাল নাই! তুমি যদি যেতে চাও বলো, তাহলে দুজন মিলে হজটা করে আসতে পারি। ভাল প্যাকেজ আছে।’
শবনম এবার টিভিটা বন্ধ করে উঠে বসে তারেকের মুখোমুখি হয়। তার দাড়িশোভিত বুড়িয়ে যাওয়া মুখমণ্ডল আর সরল চোখ দুটিতে চোখ রাখে। একটু ইতস্তত করে বলে, ‘আসলে ওইরকম কিছু তো ভাবি নাই। হঠাৎ করে কী বলবো!.. অফিস.. ছুটি নেওয়া ..আপাতত না হয় তুমি একাই করে এসো, আমি দেখি, পরে..’
তারেক আর কথা বাড়ায় না। টুপি মাথায় মসজিদে চলে যায় এশার নামাজ আদায় করতে।
শ্রাবণের ঘরের দরজা লাগানো, ওর কয়েকজন বান্ধবী আজ রাতে থাকতে এসেছে, কি নাকি গ্রুপ স্টাডি করবে সবাই মিলে। ঘরের দরজা ভেদ করে মাঝে মাঝে ওদের হৈ হুল্লোড়ের চাপা অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসছে। কী সুন্দর, ঝলমলে চিন্তাহীন একটা সময় পার করছে ওরা!
বাসার বাধা কাজের লোক রান্নাঘরের পাশে তার নিজস্ব ছোট্ট রুমে ভারতীয় সিরিয়াল দেখায় ব্যস্ত। শবনম একটা হাই তোলে। এটা এমন একটা সময় যখন তার আসলে কিছুই করার থাকে না। এসময় মনের মধ্যে বৈরাগ্য চিন্তা ভর করে। মনে হয় জীবন এক টুকরা মায়া, একটা হঠাৎ দেখা স্বপ্ন, জলের উপর ফুটে ওঠা স্বল্পস্থায়ী বুদ বুদ, মিলিয়ে যাওয়ার মতো একটা করুণ হাল্কা ছায়া। মনে হয় এই জীবনে কিছুই চিরস্থায়ী নয়, কারো উপর রাগ করার কিছু নাই, ঝগড়া বিবাদের কিছু নাই। যেন তার জন্য কোথাও কেউ নাই, কিছু নাই। সমস্তই অনিত্য অস্থায়ী। রুটিন মেনে প্রতিদিন বেলা আসে বেলা যায়, ভাবনার গভীরে, ভেতরে বাইরে মানুষও ধীরে ধীরে নাই হয়ে যায়। একটা অচেনা ধু ধু প্রান্তরে একদম একা দাঁড়িয়ে থাকার মতো অনুভূতি হয় শবনমের। বিচ্ছিন্ন, একাকী, বিষণ্ন। এটা কি তবে মধ্য বয়সের সংকট? মিড লাইফ ক্রাইসিস? এখন যে বয়সে এসে সে দাঁড়িয়েছে সেটা বার্ধক্য নয়, আবার তারুণ্যও নয়। দুয়ের মাঝখানে একটা বয়ঃসন্ধিকাল। যেখান থেকে পালানোর কোনো সুযোগ নেই। নিজের কর্মোদ্যমে ভরা যৌবনকে পেছনে ফেলে এখন অবধারিতভাবে এগিয়ে যেতে হবে বার্ধক্যের দিকে। চাই বা না চাই যৌবনকে বিদায় জানিয়ে এখন গ্রহণ করতে হবে প্রৌঢ়ত্ব কিংবা বার্ধক্যকে। সকলেই তাই করে। শবনমের মা, নানী, নানীর মা সবাই, পৃথিবীর সব মানবীই এই স্তর পেরিয়ে অনন্তে চলে গেছেন। সরল আর স্বাভাবিকভাবেই তো তারা গ্রহণ করেছেন পরিবর্তনকে! মেনে নিয়েছেন। না মেনে নিস্তার নেই বলে?
সেই যে স্নানঘরে, বার্ধক্যের প্রথম চিহ্ন দেখে চমকে উঠেছিল শবনম, সেটা কি ভয়ে, না বিস্ময়ে? নাকি পরিবর্তনের আভাসকে মানতে না পারার বেদনায়! সময় চক্ষুহীন নিষ্ঠুর, সময় ক্ষমাহীন, রুদ্র কঠিন। সময়ের হাত ধরে আমাদের ভেসে যেতে হয় জীবনের প্রতিটি ধাপে।
এই যে ইদানিং এক নতুন উপদ্রব শুরু হয়েছে মাঝরাতে হঠাৎ ভয়ানক গরম লাগা, গলা, বুক, পিঠ অচেনা ঘামে ভিজে যাওয়া, অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে বুক ধড়ফড় করে ওঠা, ভীষণ অস্থির লাগা এও তো মধ্যবয়সের এক অস্বস্তিকর লক্ষণ, বার্ধক্যের দিকে ঠেলে দেওয়া। সুন্দর করে বললে, জীবনের আরেকটি অধ্যায়ে পা রাখার সূচনা হলো তোমার শবনম। ফুল্লকোমল বসন্ত শেষ আসছে হিম আচ্ছাদিত শীতকাল। জীবনের প্রতিটি সম্পর্কের কাছে প্রত্যাশা এবার কমিয়ে আনো, নৈর্ব্যক্তিক হও, নয়তো অযথাই দুঃখ পাবে।
তারেক এরই মধ্যে মসজিদ থেকে ফিরে এসেছে। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজানোর টুংটাং শব্দ হচ্ছে। একটু পরেই শ্রাবণ আর তার বন্ধুদের কলকল্লোলের আভাস পাওয়া গেল। হৈ হৈ করে রাতের খাবার খাচ্ছে ওরা। সামান্য কথায় হিল্লেলিত ঝর্ণার মতো হেসে ভেঙে পড়ছে। ওদের দেখলে কেন যেন তরতর করে বেড়ে ওঠা কচি সবুজ লাউ ডগার উপমাই মনে আসে শবনমের। ওরা যেন কলির মোড়ক সরিয়ে সদ্য মুখ বের করা এক দল আলোময় ফুল। যেন লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, বর্ষায় স্নাত সবুজ পাতা। শবনম হাসি হাসি মুখে ডাইনিং এ এসে দাঁড়ায়।
‘ভালভাবে খাও মেয়েরা .. সাদমা, তোমার প্লেট খালি কেনো? রুম্পা, তুমি আরেক পিস চিকেন নাও।’
‘জি, আন্টি..’
মেয়েগুলো বিনীত ভঙ্গীতে বলে। শবনমের উপস্থিতিতে তাদের স্বতঃস্ফূর্ততায় সম্ভবত বাঁধা তৈরি করে। এতক্ষণের কলরব থামিয়ে তারা প্লেটে ঝুঁকে খাওয়ায় মনোযোগী হয়।
‘আমরা আমাদের মতো নিয়ে খাচ্ছি মা, চিন্তা করো না।’
শ্রাবণ মুখ তুলে বলে। তবু দুয়েকটা ভদ্রতাসূচক বাক্য বলে শবনম নিজের ঘরে ফিরে আসে। করুক, এবার ওরা প্রাণ খুলে কোলাহল করুক। মেতে থাকুক নিজেদের আনন্দে। কয় দিনের আর এই নির্মল আনন্দ কোলাহল!
তারেক শুয়ে পড়েছিল আগেই। সংসারের খুটিনাটি তদারকি সেরে প্রায় আধঘণ্টা পর একটা ঢিলেঢালা সুতির ম্যাক্সি পড়ে শুতে এলো শবনম। ভেবেছিল তারেক বুঝি ঘুমিয়ে গেছে। আসলে যে ঘুমায়নি, শবনম সেটা বুঝলো তারেক যখন পেছন থেকে দুই হাত বাড়িয়ে তাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল। এই স্পর্শ ও আলিঙ্গন একটা গভীর সংকেত, একটা গূঢ় ইঙ্গিত, কয়েক বছর আগেও এই ইঙ্গিত শবনমের সমস্ত শরীরে একটা অন্যরকম শিহরণ ছড়িয়ে দিতো কিন্তু ইদানিং কি হয়েছে, সেই আবেশটা আর শরীরে জাগে না। বরং তারেক হাত বাড়ালেই কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনীহা, অস্বস্তি আর অবসাদের সঙ্গে একটা সূক্ষ্ম বিরক্তি ছড়িয়ে পড়ে তার সমস্ত শরীরে মনে। কপালটা অজান্তেই একটু কুঁচকে যায়। তারেক এবার আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে। শবনমের ঘাড়ে তার ঘন উষ্ণ নিশ্বাসের আঁচ এসে লাগে। ঘরের মৃদু আলোতে শবনমের অনিচ্ছুক চেহারা চোখে পড়ে না তারেকের। তার ভালবাসার দীর্ঘ হাত বরাবরের মতো শবনমের দেহরেখা ধরে আরও বিবিধ পথে অগ্রসর হতে চায়। এবার আস্তে করে তারেকের হাতটা নামিয়ে রেখে সামান্য ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দেয় শবনম।
‘উহু! না.. আজকে থাক প্লিজ.. ’
‘কেনো?’
তারেক নিজেকে সামলে নিয়ে নরম গলায় জানতে চায়, ‘কোনো সমস্যা?’
‘না, কেমন যেন ড্রাই লাগে, বুঝছো, মানে, ঠিক.. কি বলবো! জ্বালা পোড়া হয়! প্রিমেনোপজ সিনড্রম কিনা!’
তারেক এবার হাতটা গুটিয়ে নেয়। পাশ ফিরে চিৎ হয়ে শুয়ে একটা লম্বা হাই তুলে বলে,
‘এখন অনেক রকম লুব্রিকেন্ট পাওয়া যায়। নেটে দেখে নিও। আমরা কিন্তু ট্রাই করতে পারি।’
‘হুম.. একটা আর্টিকেলে ন্যচারাল অয়েলের কথা পড়েছিলাম..’
‘উন্নত দেশে অনেকে পঞ্চাশের পর বিয়ে করে জানো তো! মানসিক প্রস্তুতিটাই আসল। মনের দুয়ারটা আগে খুলে দাও, বন্ধ করে রেখো না.. ’
তারেক সাইকোলোজিস্টের সাইকো থেরাপি দেওয়ার মতো ভঙ্গী করে বলে। বহুদিন পর তারেকের পক্ষ থেকে আসা আহ্বান অগ্রাহ্য করে শবনমের একটু খারাপই লাগে। এবার সেই পাশ ফিরে তারেককে জড়িয়ে ধরলে তারেক অন্য হাতে তাকে বুকে টেনে নেয়। ঘোর লাগা গলায় বলে,
‘শোনো, তুমি তো বুড়ি হয়ে যাও নাই। এখনো অনেক ফিট আছো। মনের বাধাটা সরিয়ে দেও, তারপর দেখো কি হয়, সব বরফ গলে যাবে, ষাট বছরের পর মধ্য বয়সের শুরু বুঝলে?’
শবনম উত্তরে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু তারেকের ভেজা মোটা ঠোঁট দুটো, তার দাড়িবহুল মুখখানি শবনমের ঠোটের উপর চেপে বসলে সে আর কথা বলতে পারে না। কথা বলার দরকারও পড়ে না। জমাট বাধা হিম বরফ কোনো শব্দ না করেই গলতে থাকে।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>