নির্মলেন্দু গুণ
একগুচ্ছ কবিতা
অন্ধকারের শক্তি যখন ক্ষয় হতে শুরু করে
এই স্তব্ধ গভীর রজনীতে, আমি জানি,
অধিকাংশ মানুষই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি সব মানুষের কথা বলছি না।
আমি বলছি অধিকাংশ মানুষের কথা,
অধিকাংশ ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ মানুষের কথা।
ছোটোদের ঘুমকে আমি ঘুম বলি না।
এটা মাতৃগর্ভ থেকে নিয়ে আসা অভ্যাস,
তাদের ঘুম আমার বিবেচ্য নয়।
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও যারা জেগে থাকে,
আমি শুধু তাদের কথাই বলছি।
আমি জানি, তাদের সংখ্যা খুবই কম।
আমি জানি, আমি ঘুমাতে সক্ষম।
স্বাস্থ্যবিধিও আমার অজানা নয়।
তারপরও আমি মনে করি—
অন্ধকারের শক্তি যখন ক্রমশ ক্ষয়
হতে শুরু করে, যখন দিগন্তপটে
প্রথম আলোর রেখা ফোটে,
ভোর হলো ভেবে যখন ভুল করে
ডেকে ওঠে কোনো পাখি, আমি তখন
নিদ্রার জন্য প্রস্তিত করি নিজেকে।
বুঝি, আমার দেহের অভ্যন্তরে কোথাও
জন্ম নিচ্ছে ঘুমফুলের প্রথম ভ্রূণ।
আমি ঘুমাই ডিমের কুসুমের মতো।
ভাবুন, কী অনুপম এই চিত্রকল্প!
আমাকে জাগ্রত দেখে আমার দুয়ার
থেকে শূন্য হাতে ফিরে যাচ্ছে যম।
(রচনাকাল: ২৬ ডিসেম্বর ২০২১)
খুন করেছি সোনার মাছি
কেউ আমাকে খুন করেছে,
বল না সখি, কে আমাকে
ভালোবেসে খুন করেছে?
ইস্ ঢঙ দেখে আর বাঁচি না,
আমার কি আর ভিন্ন দশা?
তুইও যে কারণে,
আমিও সেই কারণেই
অকূলের কূলে বসা।
হেঁয়ালি করিস না বোন,
আমারটা তো আমি জানি
এবার বল, তোরটা শুনি—
তোর এ-দশা কে করেছে?
কাউকে বলবি না তো?
কথা দে মাথা ছুঁয়ে।
মলো যা! আমি মরছি
আমার জ্বালায়,
নদীর ঘাটে এই অবেলায়
আমি কি এমনি আসি?
সে এক বংশীবাদক
আমি তার হাতের বাঁশি।
যে সুরে সে বাজায় বাজি,
যে সাজে সে সাজায় সাজি।
আর বলতে হবে না সই,
এবার আমি বুঝে গেছি
আমাদের দুই সইকে
একই মাঝি খুন করেছে।
নির্মলেন্দু গুণ করেছে।
(রচনাকাল: ৩০ ডিসেম্বর ২০২১)
আরও যা-যা ঘটতে পারতো
এখন আমার ছুটি? ও, বুঝেছি,
এবার তুমি বাঁধবে চুলের ঝুঁটি।
কেউ যেন বুঝতে না পারে,
—তোমার চুলের গন্ধ নিতে
—তোমার ফুলের গন্ধ নিতে
—তোমার কোনো প্রেমিক
এসেছিল তোমার অভিসারে।
আমি কি বলছি কিছু বানিয়ে?
নাহ্, আমার কবিতাগুলো
আমি লিখি, যা ঘটে, তা নিয়ে।
জানি, তোমার অজানা তা নয়।
আমি তো দিয়েছি তোমাকে
আমার সুপ্তোত্থিত কামের প্রণয়।
রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন না কেন,
সব সঙ্গীত ইঙ্গিতে থামে নাই।
সেইসব অবাধ্য কিছু সঙ্গীতই
আমি তোমাকে শোনাতে চাই।
লিখতে পারতাম কিন্তু লিখিনি,
আরও যা-যা ঘটতে পারতো—
ঘটি-ঘটি ক'রেও যা ঘটে নাই।
(রচনাকাল: ২৩ ডিসেম্বর ২০২১)