ঈদ শুধু উৎসব নয় শিক্ষার অনুষঙ্গও বটে
এবারের কোরবানির ঈদ আমাদের মাঝে যখন এসেছে, তখন দেশের একটি বড় অংশ পানিবন্দী অবস্থায়। এবছর বেশ বড় ধরণের বন্যার সম্মুখীন আমরা হয়েছি। এর মাঝেই ঈদ তার আত্মত্যাগের বাণী নিয়ে উপস্থিত। একইসাথে ঈদের প্রাক্কালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদ্মাসেতু উন্মুক্ত করে দিয়ে ঈদের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা দেখছি মানুষ স্বাচ্ছন্দের সাথে ঢাকা থেকে গাড়ি ভরে বাড়ি ফিরছে এবং এক জেলা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া আসা করছে। সবার মধ্যেই ঈদের উৎসবের ছোঁয়া লেগে গিয়েছে দেখতে পাচ্ছি।
ঈদ একটি সার্বজনীন উৎসব। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এটি আমাদের জাতীয় উৎসব। ঈদের আনন্দ সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মাঝেই আমাদের বিশেষ এই ধর্মীয় উৎসবের প্রকৃত স্বার্থকতা। ধনী দরিদ্র বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে সমবেত হয়ে ঈদের জামাতে শরিক হয়ে, কোলাকুলির মাধ্যমে সম্প্রীতির বন্ধনে প্রতিবছর আমরা আবদ্ধ হই। ঈদ আমাদের জন্য শুধু উৎসব নয় শিক্ষার অনুষঙ্গও বটে।
শৈশবের ঈদের কথা যদি আমরা স্মরণ করি, আমাদের কিছুতেই মনে পড়েনা, খুব দামী অথবা অনেকগুলি পোশাক পড়েছি। খুব বেশি চাহিদা আমাদের ছিল না। বাবা মায়ের সাথে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে গিয়েছি, কোরমা পায়েশ খেয়েছি, সালামি পেয়েছি হয়তো অতি সামান্য, গায়ের মেলায় গিয়েছি। এসবই ছিল বিশেষ আনন্দের আমাদের কাছে। আমাদের সময়ে মানুষে মানুষে সৌহার্দ বেশি ছিল। মানুষের চাওয়া পাওয়া ছিল খুবই অল্প। আমি মনে করি একজন দুখি মানুষ অথবা একটি শিশুর মুখে অথবা একটি পরিবারেও যদি হাসি ফোটানো যায়, সেটিই হচ্ছে বিশেষ আনন্দের বিষয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যেমন সবসময় বলে গিয়েছেন, সবার সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে বলেছেন, মানুষের সুখে সুখি হবার যে প্রত্যয়, আসলে সেখানেই পূর্ণতা।
আজকাল আমরা নিজেদের নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত থাকি, আমাদের চারপাশের মানুষ, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশি কারও প্রতিই আমাদের সেরকম কোন দায়বদ্ধতা আছে বলে মনে হয় না। এখন ঈদ, পূজা পার্বনে বিভিন্ন উৎসবে দেখা যায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বেড়ে যায়, কালোবাজারিরা ট্রেনের টিকিটের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। বাসে ট্রাকে অকারণে ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু আমরা ভাবি না যে, সারাবছরইতো আমরা লাভ করছি, উৎসবের সময়টা আমরা লাভ কম করি। মানুষের জন্য সহজ করে দিই সবকিছু। কিন্তু সেকথা আমরা কখনও বলি না। এই যে আমাদের নৈতিকতার অভাব, মানবিক দীনতা, এই যে শুধু নিজ স্বার্থচিন্তা করা, সেটিই ক্ষতিকর।
কোরবানির ঈদ আত্মত্যাগের শিক্ষা। মহান আল্লাহ্ র কাছে পশু কোরবানির চেয়ে মানব মনের পশুত্ব কোরবানি দেওয়াটা বেশি প্রিয়। আল্লাহ্ মানুষের অন্তর দেখেন। কোরবানির গোস্ত আল্লাহ কাছে পৌঁছায় না, পৌঁছায় তাকওয়া। আমরা জানি, কোরবানির পরে সেই কোরবানির মাংস বিতরণ করারও কিছু নিয়ম কানুন আছে। আত্মীয় স্বজন ও গরীব মানুষকে বিতরণ করার নিয়ম আছে। নিজেদের খেয়াল খুশিমতো কোরবানির মাংস বিতরণ করলেই হবে না। নিয়ম অনুযায়ী বন্টন করতে হবে। সেটিও শিক্ষার অংশ। কিন্তু আমরা সেটি দেখি না। কোন অসৎ পথে অর্জিত অর্থে কোরবানি দিলে হবে না। ঋণগ্রস্ত ব্যাক্তির কোরবানি হবে না। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি ধর্ম মানুষের কল্যাণে নিহিত অর্থাৎ ধর্ম মানুষের কল্যাণে নিহিত। ধর্মকে যেন আমরা শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখি। মানব কল্যাণে কাজে লাগাই।
আমরা যদি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের দিকে তাকাই, সেই সময় সবাই আমরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে দেশ মাতৃকাকে সুরক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছি। আমাদের বুকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে প্রিয় স্বদেশ। সেখানে কোনটি মুসলমানের রক্ত, কোনটি হিন্দুর রক্ত, কোনটি মুক্তিযোদ্ধার রক্ত সেই হিসেব আমরা করিনি। সদ্য স্বাধীন বাংলদেশেও আমরা উৎসব পালন করেছি। অনেকের পক্ষেই হয়তো সম্ভব হয়নি। অনেক কিছুরই অভাব হয়তো ছিল, কিন্তু সাম্য ছিল, সম্প্রীতি ছিল, সৌহার্দ ছিল।এক অন্যরকম মায়া ছিল। পরস্পরকে সহযোগিতা করার মনোভাব ছিল। মনে হতো কি করে সদ্য স্বাধীন ভগ্মপ্রায় দেশের মঙ্গল সাধন করা যায়। পরস্পরকে সাহায্য সহযোগিতা করা যায়। এক কথায় কিভাবে মানবতার মেলবন্ধন প্রতিষ্ঠা করা যায়। আজ অনেককেই সময়ের স্রোতে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এখন সায়াহ্ন বেলার দিকে সবাই আমরা ধাবিত হচ্ছি, কিন্তু সেইদিন, সেই সময়গুলি খুব অনুভব করি। পরিশেষে আমি শুধু এটুকুই বলবো, আমাদের ধর্মীয় উৎসবগুলি থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা নিয়ে আমরা যেন আরও বেশি মানবিক অনুভূতি সমৃদ্ধ মানুষ হই। মানুষের জন্য কাজ করি এবং মানবতার মঙ্গলে এগিয়ে যেতে পারি। এটিই হোক আনন্দ উৎসবের পাশাপাশি আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা আমাদের প্রত্যয়।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়