ধারাবাহিক উপন্যাস,পর্ব: ৫
অঘ্রানের অন্ধকারে
পর্ব: ৫
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজন ছেলে হল্লা করছে। অযথায়। রাত দশটা কী সোয়া দশটা বাজে। সাড়ে দশটাও হতে পারে। গলির ভেতর পুরোটা জুড়ে অন্ধকার। আবছা ছোপ ছোপ অন্ধকার। দোকানগুলো বন্ধ করেছে আজ আগেভাগে। জোর বৃষ্টি নেমেছে। উথালপাতাল বৃষ্টি, সঙ্গে বেশ বড়ো বড়ো শিল পড়েছে।
ক্লাসের গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্টের প্রিপারেশন শেষ করে বান্ধবীর বাসা থেকে রাস্তায় বেরুতে তুরি পড়ল শিলাবৃষ্টির কবলে। রিকশা পাব পাব করে খানিকদূর হেঁটে আসতে মাতাল বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়ল। তুরি দৌড়ে রাস্তার পাশে দোকানের সরু একফালি করোগেটেড টিনের ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু বৃষ্টির ঝাঁপটা থেকে নিজেকে ঠেকাতে পারল না।
বৃষ্টির প্রবল ঝাঁপটায় বেকায়দায় পড়া তুরির একবারের জন্যও মনে হয়নি, এমন খ্যাপাটে বৃষ্টির ভেতর বাসায় ফিরবে কেমন করে। শুধু মনে হয়েছে, ইস্ যদি ভেজা যেত এই ঝমঝমে বৃষ্টিতে! সেই ছোটোবেলার মতো শিল কুড়ানো। বড়ো’পা গিয়ে মাকে নালিশ করত আর মা বকতেন, ‘শিগগির উঠে আয়, ঘরে ওঠ। জ্বর-জারি বাঁধালে কিন্তু আমি দেখতে পারব না। তোর বাবাকে বলিস তখন।’ মায়ের বকুনিতে জোর ছিল না। কেমন যেন সুখ ছিল। কাঁচামিঠে আমের মতো সুখ। না! শীতের সকালের ওম ওম রোদ্দুরের মতো সুখ। আদতে কোনোকিছুর সঙ্গেই সেই সুখ তুলনা করা যায় না। আজ রাস্তায় নেমে পড়লে মা কি দেখতে পাবেন?
মায়ের কথা মনে পড়ে আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে গেল তুরি। ভাবল, মা কি দেখতে পান ওকে? মা কি সত্যিই ওর আশপাশে কোথাও থাকেন সবসময়! তুরির বুকের ভেতর জমাট কান্না আটকে গিয়ে মনে হয়, মা কেন মরে গেলেন!
বাসার সামনের রাস্তার খোঁড়াখুঁড়ির কাজটা বুঝি এ জনমে কোনোদিন শেষ হবে না। বৃষ্টিতে খানাখন্দে ভরা পানি থইথই করছে। তুরিও কাদাপানিতে মাখামাখি হয়ে ভিজে একশা।
বৃষ্টি খানিকটা থেমে এসেছে। তুরি দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। তখুনি বুঝতে পারল অবস্থা যথেষ্ট খারাপ। রাস্তায় কোনো রিকশা নেই। যাওবা দু-একটা আসছে, তাতেও যাত্রী। খালি রিকশা সহসা দেখা গেলেও বাসার এদিকে আসতে রাজি হচ্ছিল না কেউ।
রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা হেঁটে আসার পর এক রিকশাওয়ালা ৪০ টাকার ভাড়া ৬৫ টাকায় রাজি হলো। বাসার গলির মোড়ে পৌঁছানোর আগে এক চাকার টিউব চুপসে গিয়ে রিকশা আর নড়ল না। অগত্যা তুরিকে হেঁটে বাকি পথটুকু ফিরতে হলো।
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে যে ছেলেগুলো হল্লা করছে তাদের তুরি আগে এখানে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। কখনো-সখনো বাসায় ফিরতে তুরির একটু-আধটু রাত হয় বটে। অন্যদিন মোড়ের দোকান খোলা থাকে, রাস্তায় আলো থাকে, লোক চলাচলও থাকে বেশ। তাই হয়তো আলাদা করে ছেলেগুলোকে চোখে পড়েনি।
আজ চোখে পড়ল ছেলেগুলো হল্লা করছিল বলেই বুঝি। তুরি সরাসরি একবার তাকিয়ে দেখল ওদের। বয়স টেনেটুনে ২৪/২৫ বছর হবে। তুরির চেয়ে ২ বা ৩ বছরের বড়ো, কি তারচেয়ে একটু বেশি। প্রায় সকলের পরনে থ্রিকোয়ার্টার প্যান্ট। গায়ে টি শার্ট কিংবা গেঞ্জি। বেশিরভাগ ছেলের হাতে সিগারেট জ্বলছে। মাঝেমাঝে তারা সিগারেটে টান দিয়ে অন্ধকারে ধূঁয়া ছাড়ছে। সিগারেটের সাদা ধোঁয়া অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে স্পষ্ট হয়ে উঠছে বারবার।
ছেলেগুলো আশপাশের অ্যাপার্টমেন্টেই থাকে বলে মনে হলো। খুব রিল্যাক্স মুডে গল্প করছে আর আচমকা হল্লা করে উঠছে। ছেঁড়াফাটা ওদের দু-একটা কথা যা কানে ভেসে এলো তাতে তুরি বুঝতে পারল ওরা নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেট করছে ইংরেজিতে। এক ছেলে আচমকা খানিকটা চিৎকার করেই ‘লিনকিন পার্ক’-এর গান গেয়ে উঠল। ‘সামথিং হ্যাজ বিন টেকেন ফ্রম ডিপ ইনসাইড অব মি, আ সিক্রেট আ’হ্যাভ কেপ্ট লকড অ্যায়ে, নো ওয়ান ক্যান এভার সি।’
তুরির মনে হলো ছেলেটা গান গাওয়ার জন্য গান গেয়ে ওঠেনি, গানের কথাগুলো ওর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া ওদের আসল উদ্দেশ্য।
খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছে তুরি। দ্রুত জায়গাটুকু পার হওয়া দরকার। দ্রুত পার হওয়া যাচ্ছে না। রাস্তায় পানি জমে গেছে। অন্ধকার। পুরো রাস্তা গর্ত হয়ে আছে। পা মচকে পড়ে যেতে পারে।
ছেলেগুলোর ভেতর থেকে একজন পায়ের ওপর ইটের টুকরা তুলে নিয়ে ঠিক তুরির সামনে গর্তের ভেতর ছুঁড়ে ফেলল। কাদাপানি ছিটকে পড়ল তুরির গায়ে।
বিস্মিত হয়ে গেছে তুরি। এমন ঘটনা ঘটতে পারে সে ভাবেনি। তারওপর তাদের বাসার রাস্তায়! সাধারণত নিজ মহল্লার ছেলেরা সেই মহল্লার মেয়েদের বিরক্ত করে না। অন্য মহল্লা থেকে এসে কেউ বিরক্ত করার চেষ্টা করলে তাদের শাসিয়ে দেয়। এরা অন্য মহল্লার ছেলে কিনা তুরি বুঝতে পারছে না।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে তুরি। সাঁ করে ঘুরে তাকাল ছেলেগুলোর দিকে। খুব ধীর ঠান্ডা গলায় জিগ্যেস করল, ‘ইটের টুকরো ছুঁড়েছে কে?’
কেউ কথা বলছে না। তুরি একই প্রশ্ন করল ইংরেজিতে।
ছেলেগুলোর হইহল্লা হঠাৎ থেমে গেল। কোনো ব্যাপারে তারা ভয় পেয়েছে। কেউ কোনো কথা বলছে না।
ছেলেগুলো পিছিয়ে ধীরপায়ে গলির মোড় থেকে বড়ো রাস্তার দিকে চলে গেল। একজন গেল না। সে দাঁড়িয়ে আছে। তুরির সামনে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল ছেলেটি।
তুরির মেজাজ খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে এই বেয়াদব ছেলেগুলোকে পিটিয়ে মাংস থেঁতলে হাড় গুঁড়া করে দিতে পারলে ভালো হতো। সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে তুরি বলল, ‘রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে অসভ্য বিহেভ করেন, লজ্জা করে না?’
ছেলেটি কিছু বলল না। ওরকমভাবে দাঁড়িয়ে থাকল মাথা নিচু করে।
তুরি গলার স্বর আরও কঠিন করে ফেলল। বলল, ‘কী! ক্ষমা চাইবেন এখন? বলবেন স্যরি, ভুল হয়ে গেছে!’
ছেলেটি তাও কিছু বলল না। দাঁড়িয়ে থাকল।
তুরির মেজাজ কেন জানি থিতিয়ে এলো। ছেলেটিকে ভালো করে দেখল। এই ছেলেটিকে ওদের আর-সবার থেকে আলাদা মনে হচ্ছে। পরনে জিনসের প্যান্ট। গায়ে সাদা ফুলহাতা শার্ট। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। পায়ে চমৎকার শু। পরিপাটি করে আঁচড়ানো মাথা ভর্তি চুল।
ছেলেটি ব্যথিত গলায় বলল, ‘ওরকম করা ওদের ঠিক হয়নি। আপনি কিছু মনে করবেন না। ওদের হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।’
তুরি কিছু বলল না। বাসার দিকে রওনা হলো। তুরির মনে হলো ছেলেটি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘুরে পেছনে তাকাল। ছেলেটি ভীষণ মলিন চোখে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছে।
পরদিন ছেলেটির সঙ্গে আবার দেখা হলো তুরির। বাসায়।
ড্রয়িংরুমের সোফার ওপর পা মুড়ে বসে তুরি বই পড়ছিল। ডোর বেল বাজতেই বইয়ের পাতার মাঝে পেজ মার্কার রেখে বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল।
দরজা খুলে তুরি থ’। গতরাতে দেখা সেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। গতরাতের মতো সে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে।
তুরি ছেলেটিকে দেখে চমকাল বটে তবে প্রকাশ করল না। অবাক গলায় বলল, ‘আপনি?’
ছেলেটি কিছু বলল না। মুখ তুলে তাকাল তুরির দিকে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি অসম্ভব বিনয়ী।
ভেতর থেকে বড়ো আপা জানতে চাইলেন, ‘কে এসেছে, তুরি?’
তুরি বলল, ‘পাশের অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। আমার পরিচিত।’
বড়ো আপাকে কেন এ কথা বলল তা তুরির নিজের কাছে বিস্ময় হয়ে থাকল।
তুরি ছেলেটিকে বলল, ‘ভেতরে আসুন।’
ছেলেটি ড্রয়িংরুমের দরজা মাড়িয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকল।
তুরি জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার বলুন তো?’
ছেলেটি বুক পকেট থেকে কলম বের করে এগিয়ে ধরল। শান্ত গলায় বলল, গতরাতে পড়ে গিয়েছিল। আপনার কলম।
তুরি দেখল ছেলেটির হাতে ধরা ওর কলম। এমন আহামরি কিছু না যে ফেরত পেতে হতো। তবুও ভালো লাগছে তুরির। কেন জানি নির্মল হাসি পাচ্ছে। মনে মনে হাসল।
ছেলেটি তখনো দাঁড়িয়ে আছে। খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বিনম্র ভঙ্গিতে।
তুরি বলল, ‘আরে! দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন।’
ছেলেটি ঘুরে তুরির পাশ কাটিয়ে ওপাশের সিঙ্গেল সোফায় গিয়ে বসল। হাতের কলম বাড়িয়ে দিলো তুরির দিকে।
তুরি হাত বাড়িয়ে কলম নিয়েছে। পাশের সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘শুধু শুধু কষ্ট করলেন। এটা তো আমি হারিয়েই ফেলেছিলাম।’
চোখ তুলে ছেলেটি তাকাল তুরির দিকে। অপলক চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ছেলেটির মনে হলো এমন সুন্দর কাউকে এর আগে এই জীবনে তার দেখা হয়নি।
তুরি জিগ্যেস করল, ‘আপনার নামটা! যদি কিছু মনে না করেন।’
‘আমার নাম শাবিন রহমান।’
‘বাহ্। সুন্দর নাম আপনার। মা বুঝি শাবিন বলেই ডাকেন?’
‘মা ডাকেন সাবু।’
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সন্তানকে সব মা আলাদা নিজস্ব নামে ডাকেন। বেশিরভাগ সময় মায়ের ডাকা সেই নামটি পরে হারিয়ে যায়।
তুরির গলায় বিষণ্নতা। তাকে নির্লিপ্ত আর উদাসীন দেখাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে সে অতি দুঃখী একজন মানুষ।
তবু তুরির সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে। কেমন স্নিগ্ধ শান্ত কমনীয় কণ্ঠস্বর। স্পষ্ট উচ্চারণ।
শাবিন কী বুঝল কে জানে, হাসল। তার হাসি সুন্দর। অমায়িক এবং আন্তরিক। আগের কথার রেশ ধরে বলল, ‘আপনার নামটাও সুন্দর, তুরি। ‘
‘আমার নাম জানলেন কীভাবে!’
‘ম্যাজিক। ’
‘তুরিন থেকে তুরি। তবে তুরিনের কোনো অর্থ নেই। তুরি হচ্ছে একধরনের বাদ্যযন্ত্র, শঙ্খের মতো। ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয়।‘
মুখে মিষ্টি ভঙ্গি করল তুরি। বলল, ‘আপনি কথা বলেন খুব সুন্দর। অন্যকে মুগ্ধ করার মতো। বুদ্ধিও অনেক। আমাকে অবাক করে দিতে চেয়েছেন। আমি অবাক হয়েছি। তবে কী জানেন, অতি বুদ্ধিমান মানুষরাও মাঝেমাঝে খুব সাধারণ ভুল করে। আপনি ‘ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিঃ হাইড’ পড়েছেন? ডক্টর জেকিল ছিলেন খুব বুদ্ধিমান। কিন্তু শুরুতে নিজের ভুল ধরতে পারেননি। যেমন এখন আপনি করলেন। আমার নাম তুরিন না। শুধু তুরি। বসুন, আপনার জন্য চা নিয়ে আসি।’
শাবিন আগ্রহ নিয়ে তুরির কথা শুনছিল। কেবলই মনে হচ্ছিল মেয়েটি দেখতে যেমন অপরূপ সুন্দর, কথাও বলে তেমনি সুন্দর করে। কথা বলার সময় চোখ দুটো হাসিতে উছলে ওঠে।
তুরি ভেতরে গেলে শাবিন উঠল। অন্য সোফার ওপর একটা বই উলটো করে রাখা। পড়তে পড়তে উলটে রেখেছে। হয়তো তুরি পড়ছিল। বইটা তুলে হাতে নিল। আর্নেস্তো চে গুয়েভারা’র ‘দ্য মোটর সাইকেল ডায়েরি’। শাবিন একটা একটা করে বইয়ের পৃষ্ঠা ওলটাতে থাকল।
ট্রেতে কমলা, কলা, বিস্কিট, চা আর পানি নিয়ে ফিরে এলো তুরি।
হাতের বই দেখিয়ে শাবিন জানতে চাইল, ‘আপনি অনেক বই পড়েন!’
তুরি বলল, ‘যখন অলস সময় কাটাই। যেমন এখন। পড়াশোনার চাপ কম। হাত পা ছড়িয়ে বই পড়ছি। আপনি?’
ম্লান হাসল শাবিন। সোফার ওপর বই রেখে দিলো।
তুরি ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘নিন।’
শাবিন রোদের তাতে মিইয়ে যাওয়া লাউয়ের ক্লান্ত পাতার মতো নুইয়ে গেল। খুব ধীরে সোফায় বসে পড়ল।
(চলবে)