খালেদ হোসাইন
একগুচ্ছ কবিতা
জীবনের অম্ল মাদকতা
আমি এখন পৌষের কুয়াশামাখা
তোমার অনুপস্থিতির বিবরণ খুঁজি না আর
বা অকালে আকস্মিক বৃষ্টির ঘ্রাণ—
কেননা এখন পাহাড় থেকে নেমে আসা জল
মরুভূমির দিকেই ছুটে যায়।
সন্ধ্যায় যেমন নৌকাগুলো ফিরে আসে বন্দরের ঘাটে
তেমনভাবে তোমার স্মৃতি এখন আমাকে ঘিরে ফেলছে
দূর-দূরান্ত থেকে
বৃষ্টির পুনর্জন্মে অন্ধকারের থাবা যেমন খুব ধীরে ধীরে
দিনের বক্ষকে চেপে ধরে
আমি তেমন কায়ক্লেশে অনুভব করি
সত্তার নৈঃসঙ্গ ঘোচাতে দীর্ঘস্থায়ী সেতু
কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখে না।
আমি দেখেছি, বৃক্ষের ছায়া বা অনুবর্তী দেয়ালের বুকে
কেবল বিস্ময় থাকে, বক্তব্য থাকে না।
তা-নাহলে উত্তেজিত মহুয়ার বন
আমাকে রিক্তহৃদয়ে আর ধ্বস্ত শরীরে
ফিরিয়ে দিতে পারত না।
তুমি শুধু দূরে যাও, স্বেচ্ছায়, ক্লান্তিহীনভাবে—
সাম্প্রতিক স্বপ্নের ভেতরে তবু ঢুকে যাও, কথা বলো
তালশাঁসের মতো চোখের ইঙ্গিতে;
তারপর স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের ডোরাকাটা কারাগার
গলা-কাটা জন্তুর আর্তনাদ আমাকে
টেনে আনে সেই বাস্তবতায়
যেখানে তুমি সদূর সঙ্গীত—
আর কিছু নও।
অতিক্রান্ত দুর্বৃত্তপনার অপরাধবোধ
আমাকে সর্বক্ষণ ম্রিয়মাণ করে রাখে
কিন্তু এ-থেকে এতটুকু আলোর বিচ্ছুরণ হয় না, হবে না—
কালো হয়ে আসা বিদীর্ণ আকাশে
একটি দুটি নক্ষত্র তবু অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে জ্বলে উঠতে থাকে—
মনে হয়, জীবনের যতটুকু অম্ল মাদকতা—
তা তোমার সান্নিধ্যের সংঘর্ষে উৎসারিত আলোর কোমলতা;
পাপে-অনুতাপে।
দেখবে না বুকে ছিল কতটা অঙ্গার
লুণ্ঠন করেছি আমি যা-কিছু নির্যাস
এমনকি গোলার শস্য স্বচ্ছ তালশাঁস
এমনকি ঘরছোঁয়া শিউলির পাতা
টেবিলে যা-কিছু ছিল বইপত্র খাতা
বিছানায় ছিল যা, তা—বালিশ চাদর
তোমার গায়ের গন্ধ একান্ত আদর
চুলোয় চায়ের পাত্রে টগবগে জল
তোমার নিখুঁত ভুরু চোখের কাজল
বিধ্বস্ত করেছি আমি পুরনো শপথ
ছিনিয়ে নিয়েছি আমি আঙিনা ও পথ
আশেপাশে যত আছে ছোট বড় খাল
তোমার দুপুর রাত এবং সকাল!
দস্যু ভাবো, শত্রু ভাবো বা দখলদার—
কোনোদিনও জানবে না বুকে কী অঙ্গার।
যোগাযোগ ছিন্ন হলে
যোগাযোগ ছিন্ন হলে তোমার কি ভালো লাগে খুব?
পৃথিবীতে কত কোটি মানুষের বসবাস আজ—
আমি কি সবার সঙ্গে রিলেশন তৈরি করতে চাই?
প্রতিভার তেজ থাকে, তাই বলে এত তাতে ঝাঁজ?
কোথাও যাই না আমি তবু তুমি ভাবো বহুগামী।
তার চেয়ে মেরে ফ্যালো কবিতা লেখার অপরাধে!
গলায় মুদ্রিত থাক নিতান্ত তোমার কররেখা
চরাচর এতটুকু কাঁপবে না কারো আর্তনাদে।
যোগাযোগ ছিন্ন হবে এর শেষ-চিহ্ন যাবে মুছে
স্নায়ুসূত্র জেনে যাবে তোমাকে ছোঁবার মাদকতা
তুমি তো সন্তুষ্ট হবে, আমারও তো পাওয়া হবে কিছু—
এই বিশ্বচরাচরে বরফের মতো নীরবতা।
একদিন আমিও কি ভুলে যাবো যোগাযোগ ছিল?
আকাশের হৃৎপিণ্ডে যেইভাবে মিশে যায় চিলও।